বিপুল খরচে প্রশিক্ষণ, নেই আশানুরূপ ফল: যেভাবে ব্যর্থ হচ্ছে দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো

বিগত সরকারের সময়ে গত এক দশকে উদ্যোক্তা তৈরি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
কিন্তু যুব বেকারত্ব মোকাবিলার জন্য নেওয়া এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই টেকসই কর্মসংস্থান বা আয়ের সুযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
উদ্বেগের বিষয় হলো, এসব ঘাটতি সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকার এখন দুর্বল পরিকল্পনা ও ভুল লক্ষ্য নির্ধারণের মতো ত্রুটি নিয়ে আরও এক দফা একই ধরনের বড় আকারের প্রশিক্ষণ প্রকল্পের পরিকল্পনা করছে।
সম্প্রতি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ৩৮ হাজার ৪০০ তরুণ-তরুণীকে মোবাইল সার্ভিসিং প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৫০৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে।
'চাকরিপ্রার্থীদের জন্য মোবাইল সার্ভিসিং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি' শীর্ষক এই প্রকল্পে জেলা পর্যায়ে তিন মাস মেয়াদি কোর্স পরিচালনা করা হবে এবং প্রশিক্ষণার্থীদের খাবার ও অন্যান্য খরচের জন্য দৈনিক ভাতা দেওয়া হবে।
অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, আন্তর্জাতিক মানের দক্ষ টেকনিশিয়ান তৈরির জন্য একটি জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হবে। ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সি, উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি/এ-লেভেল সমমান) পাশ এবং দারিদ্র্যপ্রবণ জেলার বাসিন্দারা প্রত্যেক জেলায় তিন মাস (৩০০ ঘণ্টা) প্রশিক্ষণ পাবেন। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তারা খাবারের জন্য দৈনিক ৩০০ টাকা ও ভাতা হিসেবে ২০০ টাকা পাবেন।
অধিদপ্তরের প্রস্তাবিত দ্বিতীয় একটি প্রকল্পে ৪৬.৩৫ কোটি টাকা বাজেটে ৯ হাজার ৬০০ তরুণকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) বেসিক ও অ্যাডভান্সড টুলস বিষয়ে প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
'স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) টেকনোলজি ফর আইসিটি-লিটারেট ইয়ুথ' শীর্ষক এ প্রকল্পের লক্ষ্য হলো মাইক্রোসফট, কোর্সেরা ও 'এআই ইঞ্জিনিয়ারিং: বিল্ডিং অ্যাপ্লিকেশনস উইথ ফাউন্ডেশন মডেলস'-এর মতো বৈশ্বিক রিসোর্সের সহায়তায় অংশগ্রহণকারীদের ১১টি বেসিক ও ১৬টি অত্যাধুনিক এআই অ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
এই প্রকল্পে প্রশিক্ষণার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম এইচএসসি পাশ হতে হবে। ন্যূনতম ৩০ শতাংশ নারীকে এই প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হবে। প্রশিক্ষণার্থীদের কম্পিউটার ও আইসিটি বিষয়ে মৌলিক ধারণা থাকতে হবে এবং ইংরেজিতে দক্ষ হতে হবে। প্রশিক্ষণার্থীদের বয়স হতে হবে ১৮ থেকে ৩৫ বছর। প্রশিক্ষণার্থীদের অনলাইন মার্কেটপ্লেস থেকে আয়ের বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হবে। অধিদপ্তরের মতে, এই দক্ষতা 'ডিজিটাল উদ্যোক্তাদের একটি প্রজন্ম' তৈরিতে সহায়তা করতে পারে।
তবে আগের প্রকল্পগুলো যেখানে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে যথাযথ পরিকল্পনা বা বাজার বিশ্লেষণ ছাড়া গৃহীত ও বাস্তবায়িত এ ধরনের প্রকল্প সফল হতে পারবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
দীর্ঘ, ব্যয়বহুল ব্যর্থতার খতিয়ান
বিগত সরকারের আমলে নেওয়া প্রশিক্ষণের দীর্ঘ তালিকা হতাশাজনক ফলই দিয়েছে।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) জুনে প্রকাশিত একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে নেওয়া বেশিরভাগ প্রশিক্ষণ প্রকল্পই দুর্বল পরিকল্পনা, ভুল লক্ষ্য নির্ধারণ ও ফলো-আপের অভাবে ভুগছে।
এমনই একটি প্রকল্প হলো 'অনগ্রসর ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন'। এই প্রকল্পের আওতায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত লালমনিরহাট, জামালপুর, ভোলা ও পটুয়াখালী—এই চার জেলায় ৫ হাজার ১৮৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতে ব্যয় হয় ৩৮ কোটি টাকা।
এই প্রশিক্ষণের ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। ড্রাইভিং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২ হাজার ৫৪৫ জনের মধ্যে মাত্র ৭২ জন বা ২.৮২ শতাংশ তিন বছরে এই পেশায় যুক্ত হয়েছেন। অপরদিকে কম্পিউটার ও আইটিবিষয়ক ২ হাজার ৬৪০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্তের মধ্যে মাত্র ১২১ জন বা ৪.৫৭ শতাংশ এ খাতে চাকরি পেয়েছেন।
এছাড়া প্রকল্পটি স্বল্প-শিক্ষিত, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য হলেও প্রায় অর্ধেক (৪৬ শতাংশ) ছিলেন স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী।
আইএমইডির প্রতিবেদন অনুসারে, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশ বর্তমানে চালক হিসেবে কর্মরত আছেন। অন্যদিকে ৭৩ শতাংশই এই পেশার বাইরে রয়েছেন। প্রশিক্ষণ শেষে প্রায় ৬০ শতাংশ প্রশিক্ষণার্থী কিছু আয় করতে পারলেও ৩৩ শতাংশ এখনও পুরোপুরি বেকার।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পটির কাঠামো ও বাস্তবায়ন ছিল 'ত্রুটিপূর্ণ' এবং এর কর্মসংস্থানের ফলাফল ছিল 'প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম'।
অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোতেও একই ধরনের চিত্র পাওয়া যায়।
আইসিটি দক্ষতার মাধ্যমে নারীদের আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে ৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ে জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলাভিত্তিক মহিলা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রকল্প চালু হয়।
কিন্তু ২০২১ সালে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের মধ্যে মাত্র ০.৬২ শতাংশ উদ্যোক্তা হয়েছেন এবং ১.৮৭ শতাংশ আউটসোর্সিং কাজে যুক্ত হয়েছেন। সরকারি ডাটাবেজে যাদের 'উদ্যোক্তা' হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তাদের অনেকেই বাস্তবে বেকার।
আরেকটি উদাহরণ হলো বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) উদ্যোক্তা তৈরি ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প। ২০১৯ সালে চালু হওয়া এই প্রকল্পে দুই বছরে ২৪ হাজার ৯০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ২৪৫ জন (১৭ শতাংশ) উদ্যোক্তা হতে পেরেছেন। বেশিরভাগই প্রধান বাধা হিসেবে অর্থায়নের অভাবকে দায়ী করেছেন।
আইসিটি বিভাগের ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট-এর (এলইডিপি) আওতায় ৭৭ হাজার মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বিশাল বরাদ্দ সত্ত্বেও মাত্র ৩২ হাজার মানুষ সক্রিয়ভাবে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আয় করছেন।
প্রকল্পগুলো কেন ব্যর্থ হয়
অর্থনীতিবিদ ও নীতি নির্ধারকরা এমন কিছু পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা উল্লেখ করেন, যা সব সরকারের আমলেই ছিল।
বেশিরভাগ প্রশিক্ষণ প্রকল্পে ফলাফলের মানের চেয়ে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। পাঠ্যক্রমগুলো প্রায়ই চাকরির বাজারের চাহিদা প্রতিফলিত করতে পারে না। এছাড়া প্রযুক্তি ও শিল্পের চাহিদা বদলালেও বছরের পর বছর একই পাঠ্যক্রম বারবার ব্যবহার করা হয়।
সরকারি কর্মকর্তারা নিজেরাই স্বীকার করেন যে, প্রকল্পগুলো সাধারণত দুই থেকে তিন বছর চলে, এরপর তদারকি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষণার্থীদের কর্মসংস্থান বা আয়ের অবস্থার খোঁজ আর রাখা হয় না বললেই চলে।
অনেক প্রশিক্ষণার্থী, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার, কম্পিউটার বা আর্থিক সংস্থান থাকে না থাকায় শেখা অনুশীলন করতে পারেন না। নারীদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পেশা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রায়শই পারিবারিক বা সামাজিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়।
এদিকে বৈশ্বিক ডিজিটাল বাজারেও প্রতিযোগিতা তীব্রতর হয়েছে। ফলে শুধু প্রাথমিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা অনেক পিছিয়ে পড়ছেন।
কাঠামোগত পরিবর্তনের আহ্বান বিশেষজ্ঞদের
অর্থনীতিবিদ এবং ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে. মুজেরি টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশে সরকারি প্রশিক্ষণ প্রকল্পগুলো তাদের 'মূল উদ্দেশ্যে পৌঁছাতে পারছে না'।
তিনি বলেন, 'শুধু প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা কর্মক্ষেত্রে সেই জ্ঞান কতটা কাজে লাগাতে পারছেন, সেটাই আসল প্রশ্ন। আইসিটি বা কারিগরি যেকোনো প্রশিক্ষণ যদি বাস্তবে প্রয়োগের সুযোগ না পান, তাহলে সেটি ফলপ্রসূ হয় না।'
তিনি আরও বলেন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সহায়ক ব্যবস্থা—যেমন ঋণসুবিধা, কর্মসংস্থানের লিংকেজ বা উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার সহায়তা—না থাকলে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি কার্যকর হয় না। 'একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি হয়তো উদ্যোক্তা হতে পারেন, কিন্তু তার জন্য দরকার আর্থিক সহায়তা, বাজারে সংযোগ, কিংবা নেটওয়ার্কিং সুযোগ। এসব না থাকলে প্রশিক্ষণটা শুধু সার্টিফিকেটেই সীমাবদ্ধ থাকে ।'
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও প্রভাব মূল্যায়নের প্রায় অনুপস্থিতিরও সমালোচনা করেন এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, কিন্তু এর মান যাচাই বা ফলাফল মূল্যায়ন খুব কম হয়। প্রশিক্ষণের পর যারা অংশগ্রহণ করেছে, তাদের জীবনে কোনো গুণগত পরিবর্তন এসেছে কি না, সে বিষয়টাও দেখা হয় না। এসব প্রকল্পে মূল সমস্যা হলো প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের মধ্যে কোনো কার্যকর সংযোগ নেই। ফলে বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও বাস্তব উন্নয়ন বা কর্মসংস্থান তেমন সৃষ্টি হচ্ছে না।'
প্রশিক্ষণ নিয়ে নতুন ভাবনা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে 'ইনপুট-নির্ভর' মডেল থেকে বেরিয়ে 'ফলাফল-নির্ভর' মডেলে যেতে হবে।
একটি সম্ভাব্য সংস্কার হতে পারে 'প্রশিক্ষণ → ইন্টার্নশিপ → চাকরির লিংকেজ' কাঠামো, যা দক্ষতা উন্নয়নকে সরাসরি বাজারের চাহিদা ও কর্মসংস্থানের সুযোগের সঙ্গে যুক্ত করবে। প্রকল্পগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণ, মেন্টরিং বা পরামর্শ এবং আত্মকর্মসংস্থানের জন্য আর্থিক সহায়তাও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
বিশ্লেষকরা বলেন, এসব পরিবর্তন ছাড়া মোবাইল সার্ভিসিং ও এআই প্রশিক্ষণের মতো নতুন প্রকল্পগুলোও একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করার ঝুঁকিতে পড়বে। এতে সামান্য কিছু কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিপরীতে জনগণের অর্থের অপচয় হবে।
মুস্তফা কে. মুজেরি বলেন, 'প্রশিক্ষণে টাকা খরচ করে মনে করা হচ্ছে আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করছি—এই ধারণা ভুল। প্রশিক্ষণের মান, প্রয়োগযোগ্যতা ও পরবর্তী সহায়তা না থাকলে এটা কেবল টাকার অপচয়।'