চীনের বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণের আসল লক্ষ্য কি শুধুই পানি নিয়ন্ত্রণ?

বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু করেছে চীন। তিব্বত মালভূমির পূর্ব প্রান্তে বাঁধটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ইয়াংসি নদীর ওপর নির্মাণ করা থ্রি গর্জেস বাঁধের পর এটি চীনের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। নির্মাণকাজ শেষ হলে এটি হবে থ্রি গর্জেস বাঁধের চেয়েও চারগুণ বড়। বর্তমানে থ্রি গর্জেস বাঁধই বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ বাঁধ হিসেবে পরিচিত।
চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং প্রকল্পটিকে 'শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রকল্প' হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার এই মূল্যায়ন একাধিক দিক থেকে যথার্থ। প্রকল্পটির বিশালতা চীনের ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার একটি প্রতিফলন।
তবে বাঁধটির সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত দিক হলো এর ভৌগোলিক অবস্থান। এটি নির্মাণ করা হচ্ছে তিব্বতীয় মালভূমির পূর্ব প্রান্তে ইয়ারলুং জাংবো নদীর নিম্নপ্রবাহে। এই নদী ব্রহ্মপুত্র নদ নামে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ ও আসাম রাজ্যের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই নদ বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য পানির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস। আর এ কারণেই উভয় দেশই প্রকল্পটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তবে ভারতের উদ্বেগ কিছুটা বেশি। কারণ, ব্রহ্মপুত্র নদ অরুণাচল প্রদেশ হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছ। অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরে চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু। চীন এ অঞ্চলকে নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে। তারা অঞ্চলটিকে জাংনান নামে এবং দক্ষিণ তিব্বতের একটি অংশ হিসেবে মনে করে।
একইসঙ্গে বাঁধটির অবস্থান চীনকে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি কৌশলগত সুবিধাও এনে দেবে। এর মাধ্যমে চীন চাইলে ভারতের পানিপ্রবাহে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।
ইতিপূর্বে, ২০১৯ সালে চীনের মেকং নদীর অববাহিকায় নির্মিত বাঁধ প্রকল্পগুলো ডেল্টা অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই ধারণা করা যায়, এ প্রকল্প চীনের প্রতিবেশি দেশগুলোর ওপর তার কূটনৈতিক প্রভাব আরও জোরদার করতে পারে।
আরও পড়ুন: চীনের বিশাল বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশের উদ্বেগ কেন?
এক দেশের দ্বারা অন্য দেশের ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নতুন নয়। এই প্রেক্ষাপটে চীনের মেগা ড্যাম প্রকল্প দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
যেমন, চলতি বছরের এপ্রিলে কাশ্মীরের পেহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহতের ঘটনায় পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, পাকিস্তান আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস দমন না করা পর্যন্ত চুক্তিটি কার্যকর হবে না।
তাই চীনের এই বাঁধের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা দক্ষিণ এশিয়ার ইতোমধ্যেই উত্তেজনাপূর্ণ ভূরাজনীতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে, সেই আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
চীনের নদী নিয়ন্ত্রণের ঐতিহাসিক লড়াই
চীনের নদী নিয়ন্ত্রণের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যা চীনা সভ্যতা ও রাষ্ট্র গঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। নদী ব্যবস্থাপনা একদিকে যেমন রাজ্য পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, অন্যদিকে তা চীনা সংস্কৃতি, সাহিত্য ও পুরাণেও গভীর ছাপ ফেলেছে। দেশটির সাহিত্য ও কাব্যে নদী নিয়ন্ত্রণের প্রাসঙ্গিকতা বারবার উঠে এসেছে। বন্যা প্রতিরোধে মানব হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা সেখানে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
১৪৪১ সালে ইয়াংসি নদীর ভয়াবহ বন্যা মিং রাজবংশের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছিল। ১৯৩১ সালের বন্যায় এই নদীর পানিতে প্রাণ হারায় আনুমানিক ২০ লাখ মানুষ।
তবে বর্তমানে এই নদী নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য নয়, বরং এটি চীনা রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত।
আজকের পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির মতো প্রাকৃতিক সম্পদ ক্রমশ সীমিত হয়ে পড়ছে। গঙ্গা নদীকে ইতোমধ্যে পানিস্বল্পতার দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চীনের বিপুল জনসংখ্যার পানির চাহিদা পূরণ ছাড়াও, এই বাঁধ থেকে উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ চীনের স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে বড় একটি পদক্ষেপ।
পাঁচ ধাপে বিন্যস্ত জলবিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে বছরে ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা যুক্তরাজ্যের মোট বার্ষিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় সমান। এর মাধ্যমে চীন বিদ্যুৎ উৎপাদনে আরও শক্তিশালী হবে। আর এই সক্ষমতা চীনকে উৎপাদন খাতে একটি পরাশক্তিতে পরিণত হওয়ার পথ তৈরি করেছে।
প্রকল্পটির নির্মাণকাজ সবেমাত্র শুরু হলেও, এটি ইতোমধ্যেই চীনের উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি এটি এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি সম্ভাব্য মোড় ঘোরানো উদ্যোগও বটে, যা চীনকে আঞ্চলিক পানিসম্পদ নিয়ন্ত্রণে আরও বেশি সক্ষম করে তুলবে। এর ফলে এ অঞ্চলের ভূরাজনীতি নিয়ন্ত্রণে চীনের প্রভাব যে আরও বাড়বে, তা বলা বাহুল্য।