স্থানীয় শ্রমিকদের জন্য প্রকল্পগুলোতে ৩০% শ্রম ব্যয় বরাদ্দ রাখা বাধ্যতামূলক করলো বিশ্বব্যাংক

স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান ও দক্ষতা বাড়াতে বড় ধরনের নীতিগত পরিবর্তন এনেছে বিশ্বব্যাংক। দাতাসংস্থাটি তাদের অর্থায়িত প্রকল্পগুলোতে শ্রম ব্যয়ের অন্তত ৩০ শতাংশ স্থানীয় কর্মী নিয়োগে ব্যয় করার নতুন বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে।
বিশ্বব্যাংকের পাঠানো এক অফিসিয়াল চিঠিতে জানানো হয়, আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে এই নিয়ম কার্যকর হবে। এটি তাদের ইনভেস্টমেন্ট প্রজেক্ট ফাইন্যান্সিং (আইপিএফ) স্কিমের আওতায় আন্তর্জাতিকভাবে দরপত্র আহ্বানকৃত কাজের চুক্তিগুলোতে প্রযোজ্য হবে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের আওতায় যেসব ঠিকাদার কাজের জন্য দরপত্র জমা দেবে, তাদেরকে এই নিয়ম মানতে হবে। তারা কীভাবে স্থানীয় কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে ৩০ শতাংশ শ্রম ব্যয়ের লক্ষ্য পূরণ করবে, সেটিও ব্যাখ্যা করে দরপত্র জমা দিতে হবে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশসহ ঋণ গ্রহণকারী দেশগুলোকে এই নিয়মের বাস্তবায়ন তদারকি করতে হবে। নিয়ম না মানলে প্রয়োজনে অর্থছাড় আটকে রাখা যেতে পারে বলেও জানানো হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এই উদ্যোগকে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইআরডির এক কর্মকর্তারা বলেন, "এতদিন বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চলা প্রকল্পগুলোতে স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের জন্য কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। ঠিকাদাররা ইচ্ছামতো স্থানীয় কর্মী নিয়োগ দিত এবং এ খাতে কত টাকা খরচ হচ্ছে, তা নির্ধারণে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল না।"
তবে নতুন এই নিয়ম কার্যকরে দক্ষ ও অদক্ষ—দুই ধরনের কর্মীরই কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে বলে মনে করেন তিনি। একইসঙ্গে এতে স্থানীয় কর্মীদের দক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে।
বিশ্বব্যাংকের নতুন এই নিয়ম চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর বা তার পরে যে সব কাজের দরপত্র আহ্বান করা হবে, সেগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। তবে শর্ত হচ্ছে, কাজগুলো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে এবং বিশ্বব্যাংকের স্ট্যান্ডার্ড প্রোকিউরমেন্ট ডকুমেন্ট ব্যবহার করে আহ্বান করা হতে হবে।
শ্রম ব্যয়ের ৩০ শতাংশ স্থানীয় কর্মী নিয়োগে ব্যয়ের বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি, প্রয়োজনে দরপত্রদাতাদের প্রস্তাবের সঙ্গে স্থানীয় স্বল্প ও আধা-দক্ষ শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নের পরিকল্পনাও জমা দিতে বলা যেতে পারে।
এই নীতির বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে, অর্থগ্রহণকারী দেশগুলোকে তাদের প্রজেক্ট প্রোকিউরমেন্ট স্ট্র্যাটেজি ফর ডেভেলপমেন্ট (পিপিএসডি) হালনাগাদ করতে হবে, যাতে এই নতুন নির্দেশনা প্রতিফলিত হয়। সেইসঙ্গে, স্থানীয় শ্রমবাজারের একটি বিস্তারিত মূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত করাও বাধ্যতামূলক করা করেছে সংস্থাটি।
'চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম'
এদিকে, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, "এই নীতিটি বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল করপোরেট পলিসিরই অংশ, যার মূল উদ্দেশ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। বর্তমান বিশ্বের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে 'কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি'। এই প্রেক্ষাপটে এটা একধরনের 'চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম' ধাঁচের উদ্যোগ।'
তিনি বলেন, "এই নতুন নিয়ম অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোতে শ্রম ব্যয়ের অন্তত ৩০ শতাংশ ব্যয় স্থানীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে। এর মাধ্যমে প্রকল্প পোর্টফোলিওর সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের কর্মসংস্থান এজেন্ডার সংযোগ ঘটানো হচ্ছে।"
ড. জাহিদ হোসেন আরও বলেন, "অনেক দিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে, বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে অর্থের একটি বড় অংশ পরামর্শক ব্যয়ের মাধ্যমে সেই দেশেই ফেরত চলে যায়। ফলে প্রকৃত অর্থে অর্থগ্রহণকারী দেশগুলো তেমন সুবিধা পায় না। নতুন এই নিয়ম সেই বদনাম লাঘবে সহায়ক হতে পারে।"
তিনি বলেন, "ধরে নেওয়া যায়, এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোতে বাংলাদেশে শ্রম ব্যয় ৩০ শতাংশের নিচেই ছিল। তাই বিশ্বব্যাংক এখন বাধ্যতামূলকভাবে এই নিয়ম প্রবর্তন করছে। তবে বাস্তবে এই কোটার বাস্তবায়ন কতটা কার্যকর হয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।"
ঋণ গ্রহণকারী দেশ ও ঠিকাদারদের জন্য নতুন বাধ্যবাধকতা
বিশ্বব্যাংকের নথি অনুযায়ী, প্রতিটি দরপত্রদাতাকে প্রস্তাবের সঙ্গে একটি 'লোকাল লেবার মেথড স্টেটমেন্ট' জমা দিতে হবে। এই বিবৃতিতে স্থানীয় শ্রমিক নিয়োগে ৩০ শতাংশ ব্যয় নিশ্চিত করার পরিকল্পনা এবং স্থানীয় শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নের কৌশল স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে।
এই নীতি বাস্তবায়নে নিশ্চয়তা আনতে, ঋণ গ্রহণকারী দেশগুলোর (যেমন বাংলাদেশ) হাতে ক্ষমতা থাকবে—যেসব ঠিকাদার তাদের দেওয়া 'লোকাল লেবার মেথড স্টেটমেন্ট'-এর প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হবে, তাদের অর্থপ্রদান স্থগিত করতে পারবে। প্রকল্প প্রকৌশলীর মূল্যায়নের ভিত্তিতে সেই অর্থ ছাড়া হবে কেবল নিয়ম মানার নিশ্চয়তার ভিত্তিতেই।
এছাড়াও, ধারগ্রহণকারী দেশগুলোকে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংকের কাছে নিয়মিত অগ্রগতির প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এরজন্য একটি নির্ধারিত প্রতিবেদন ফরমেট বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে সরবরাহ করা হবে।
নতুন নিয়ম কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের সুবিধার্থে, বিশ্বব্যাংক ধারগ্রহণকারী দেশ, বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও ঠিকাদারদের জন্য বিস্তারিত নির্দেশিকা এবং ই-লার্নিং প্রশিক্ষণ উপকরণ প্রস্তুত করছে।
নতুন এই উদ্যোগকে বিশ্বব্যাংকের ২০১৬ সালের প্রোকিউরমেন্ট ফ্রেমওয়ার্কের হালনাগাদ অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে—যেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফ্রেমওয়ার্কে বৈশ্বিক সেরা অনুশীলন যুক্ত করার পাশাপাশি ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর সক্ষমতা ও উন্নয়ন অগ্রাধিকার বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর সুফল যেন স্থানীয় জনগণের মধ্যে আরও ন্যায্যভাবে বণ্টিত হয়—এই লক্ষ্যেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।