ট্রাম্প কি শান্তিতে নোবেল জিতবেন? যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে নিজের মনোনয়নের জন্য প্রচারে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে বিশেষজ্ঞ ও দীর্ঘদিনের নোবেল পর্যবেক্ষকরা বলছেন, তার এই পুরস্কার জেতার সম্ভাবনা খুবই কম।
ট্রাম্প প্রায়ই দাবি করেন যে, তিনি এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। তিনি উল্লেখ করেছেন ২০২০ সালের আব্রাহাম চুক্তি, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে তার যোগাযোগ, এবং সম্প্রতি গাজা যুদ্ধ শেষ করার প্রস্তাব—এই তিনটি বিষয়ই তাকে সম্মান দেওয়ার কারণ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
তিনি সম্প্রতি সমর্থকদের বলেছেন, 'সবাই বলে আমার নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত।' তিনি আরও বলেন, তিনি কমপক্ষে দুইটি পুরস্কার পাওয়ার দাবিদার, যেহেতু সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০০৯ সালে একটি পেয়েছিলেন। এই তথ্য দিয়েছে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস।
চলতি বছরে নোবেল কমিটি মোট ৩৩৮টি মনোনয়ন পেয়েছে—ব্যক্তি ও সংগঠন উভয়ের কাছ থেকে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের পুরস্কার জেতার সম্ভাবনা 'খুবই ক্ষীণ'।
স্বীকৃতির জন্য প্রচেষ্টা
নোবেল শান্তি পুরস্কারের স্বীকৃতি পাওয়ার লক্ষ্যে ট্রাম্পের প্রচারণায় রয়েছে সর্বজনীন বক্তব্য, তার দূত স্টিভ উইটকফসহ সহযোগীদের মাধ্যমে লবিং কার্যক্রম, এবং সিনেটর মার্কো রুবিওসহ মিত্রদের সমর্থনের বার্তা।
তার মনোনয়নটি আনুষ্ঠানিকভাবে জমা দিয়েছেন নিউইয়র্কের কংগ্রেসওমেন ক্লাউডিয়া টেনি। তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং পাকিস্তান সরকারের সমর্থনপত্র ১ ফেব্রুয়ারির সময়সীমা পেরিয়ে জমা পড়ায়, সেগুলো ২০২৫ সালের পুরস্কারের জন্য গণ্য হবে না বলে জানিয়েছে আল জাজিরা।
ট্রাম্পের এসব দাবি আব্রাহাম চুক্তি, যার মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে একাধিক আরব দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয় এর উপর দাঁড়ানো। তিনি এ পর্যন্ত দাবি করেছেন তিনি 'সাতটি যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছেন'। এছাড়া সাম্প্রতিক '২০ দফা গাজা শান্তি পরিকল্পনা', যা তার মতে বর্তমান সংঘাতের সমাধানে সহায়ক হতে পারে। এসব কারণে তিনি শান্তিতে নোবেল পাওয়ার দাবিদার।
মানদণ্ডের অমিল
তবে নোবেল বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের রেকর্ড নরওয়ের নোবেল কমিটির দীর্ঘদিনের মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
অসলোতে এক নোবেল ইতিহাসবিদ বলেন, 'কমিটি সাধারণত টেকসই, বহুপাক্ষিক শান্তি প্রচেষ্টাকে পুরস্কৃত করে, যা দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।' কিন্তু ট্রাম্পের উদ্যোগগুলো সাধারণত স্বল্পমেয়াদি চুক্তি ও শিরোনাম-কেন্দ্রিক পদক্ষেপে সীমাবদ্ধ।
তিনি যে গাজা শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন, তা পুরস্কার ঘোষণার কয়েক দিন আগেই উন্মোচন করা হয়। এক বিশ্লেষক একে বলেছেন 'এখনও বেটা সংস্করণে থাকা শান্তি পরিকল্পনা', আরেকজন একে বলেছেন 'সংবাদ সম্মেলনের নাটক'—যে ধরনের কূটনীতি সাধারণত নোবেল কমিটি স্বীকৃতি দিতে অনিচ্ছুক।
সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
ট্রাম্পের খোলামেলা বক্তব্যের ধরণ এবং সর্বসমক্ষে পুরস্কারের জন্য প্রচারণা চালানো তার সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
অসলো'র বিয়র্কনেস ইউনিভার্সিটি কলেজের অধ্যাপক হিলদে রেস্টাড বলেন, 'সাংস্কৃতিকভাবে ট্রাম্প নরওয়ের বিপরীত চরিত্রের মানুষ। নরওয়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নম্রতা ও ঐক্যমত্যকে মূল্য দেওয়া হয়, আত্মপ্রচারকে নয়।'
অসলো শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক নিনা গ্রেগার বলেন, ট্রাম্পের বক্তৃতা ও ভাষা শান্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটায় না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নোবেল কমিটি রাজনৈতিক চাপ থেকে স্বাধীনতা বজায় রাখতে চায়। ট্রাম্প যেভাবে বারবার ঘোষণা দিচ্ছেন যে তিনি এই পুরস্কারের 'প্রাপ্য', তাতে কমিটি হয়তো আরও বেশি করে তাকে পুরস্কার না দেওয়ার দিকে ঝুঁকবে, যাতে তাদের নিরপেক্ষতা অক্ষুণ্ন থাকে।
বিস্তৃত সমালোচনা
সমালোচকরা আরও বলেন, ট্রাম্পের বহুপাক্ষিক চুক্তি থেকে সরে আসা, বিতর্কিত নীতিমালা গ্রহণ, এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সংশয়ী মনোভাব—যা অনেক নোবেল পর্যবেক্ষকের মতে বিশ্ব শান্তির অন্যতম কেন্দ্রীয় ইস্যু—এই সবকিছুই তার মনোনয়নের বিরুদ্ধে কাজ করছে।
সম্ভাবনা ও পূর্বাভাস
বেটিং মার্কেটের হিসাব অনুযায়ী, ট্রাম্প বর্তমানে রুশ ভিন্নমতাবলম্বী ইউলিয়া নাভালনায়া ও সুদানের ইমার্জেন্সি রেসপন্স রুমস-এর মতো শীর্ষ প্রার্থীদের পিছনে রয়েছেন। তবে অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে, এ ধরনের সম্ভাবনা বা বাজির হার সাধারণত বিশ্বাসযোগ্য নয়।
বিশ্লেষকদের মতে, ফলাফল যাই হোক না কেন, ট্রাম্প তা তার রাজনৈতিক বার্তা জোরদার করার জন্য ব্যবহার করবেন।
যদি তিনি পুরস্কার পান, তার সমর্থকরা একে বলবেন 'ইতিহাসের সেরা নোবেল'।
আর যদি না পান, তাহলে ট্রাম্প একে 'বৈশ্বিক অভিজাতদের পক্ষপাতিত্বের' আরেকটি উদাহরণ হিসেবে সমালোচনা করবেন।
অসলো-ভিত্তিক এক বিশ্লেষক বলেন, 'নোবেল কমিটি আগেও অনেক সময় চমক দেখিয়েছে, কিন্তু ট্রাম্পকে পুরস্কার দেওয়া হলে সেটা হবে ইতিহাসের অন্যতম বড় চমক।'