ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন: মরীচিকার বেশি কিছু নয়
আবারও ওয়াশিংটন মুখর হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যে "শান্তির নতুন সম্ভাবনা" নিয়ে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সর্বশেষ উদ্যোগের ঘোষণায় বলা হয়েছে, তার প্রশাসনই নাকি এবার মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের চূড়ান্ত সমাধান দিতে পারবে—চুক্তিনির্ভর কূটনীতি ও আমেরিকান প্রভাবের জোরে। এমন প্রতিশ্রুতি আমরা অতীতেও শুনেছি, এবং অভিজ্ঞতা বলছে, এবারও শেষ পর্যন্ত হতাশাই অপেক্ষা করছে।
সমস্যাটা ট্রাম্পের দরকষাকষির দক্ষতায় নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতার মধ্যকার মৌলিক ফারাকে। এই অঞ্চলের শক্তির ভারসাম্য, ঐতিহাসিক ক্ষোভ এবং কৌশলগত স্বার্থের যে জটিলতা, তা আমেরিকার পরিকল্পনার সঙ্গে মেলে না।
আমেরিকান শক্তির সীমাবদ্ধতা
আমেরিকার নীতিনির্ধারকেরা দীর্ঘদিন ধরে এই ভ্রান্ত ধারণায় ভুগছেন যে ওয়াশিংটন চাইলেই মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতাকে পাল্টাতে পারে। তারা মনে করেন, পর্যাপ্ত চাপ, প্রণোদনা বা কূটনৈতিক দক্ষতা প্রয়োগ করলেই হবে—শতাব্দীব্যাপী জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় বিভাজন ও ভূখণ্ডসংক্রান্ত বিরোধ যেন সহজেই মীমাংসা করা সম্ভব।
ট্রাম্প প্রশাসনের পদ্ধতিটিও সেই পুরোনো আমেরিকান আশাবাদের প্রতিফলন: গুরুত্বপূর্ণ পক্ষগুলোকে টেবিলে আনা, কিছু অর্থনৈতিক প্রণোদনা দেওয়া, তারপর "চুক্তি" করিয়ে ফেলা। আব্রাহাম চুক্তির ক্ষেত্রে এটি কিছুটা সফল হয়েছিল, যেখানে ইসরায়েল ও কয়েকটি উপসাগরীয় আরব দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে।
কিন্তু সেই সাফল্য এসেছিল মূলত এমন এক প্রেক্ষাপটে, যেখানে আগেই বাস্তব সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল—ইরানবিরোধী কৌশলগত মিত্রতা ও ফিলিস্তিনি প্রশ্নের গুরুত্ব হ্রাস পাওয়া উপসাগরীয় রাজনীতিতে।
তবে এই মডেলটিকে যদি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন মূল বিরোধ কিংবা বৃহত্তর আঞ্চলিক শান্তির প্রক্রিয়ায় প্রয়োগ করতে চাওয়া হয়, তাহলে বিষয়টা একেবারে ভিন্ন হয়ে যায়। আব্রাহাম চুক্তিতে কোনো পক্ষকেই নিরাপত্তা বা ভূখণ্ডসংক্রান্ত মৌলিক স্বার্থে ছাড় দিতে হয়নি, কিন্তু প্রকৃত শান্তির জন্য সেটিই প্রয়োজন।
অপরিবর্তিত আঞ্চলিক বাস্তবতা
হোয়াইট হাউসে যে-ই থাকুন না কেন, মধ্যপ্রাচ্যে কিছু কাঠামোগত বাধা অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।
ফিলিস্তিন প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত। বহু দশকের আলোচনার পরও সীমান্ত, জেরুজালেমের মর্যাদা, শরণার্থী ইস্যু ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কোনো ঐকমত্য তৈরি হয়নি। উভয় পক্ষেরই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আপস করা প্রায় অসম্ভব।
ইসরায়েলি সমাজ ক্রমশ ডানদিকে সরে গেছে—তারা নিরাপত্তাকে জমি ছাড়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনিরা রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত—পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও হামাসের মধ্যে—যাদের কারোরই বৈধতা বা ক্ষমতা নেই এমন কোনো সমাধান বাস্তবায়নের।
ইরানের ভূরাজনৈতিক উচ্চাভিলাষও অপরিবর্তিত। তেহরানের পৃষ্ঠপোষকতায় লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইরাক ও সিরিয়ার মিলিশিয়া বাহিনী, ইয়েমেনের হুথিদের কার্যক্রম ইসলামী বিপ্লবের আগেরই কৌশলগত নীতির ধারাবাহিকতা। ইরান চায়, আঞ্চলিক প্রভাব এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা।
কোনো মার্কিন শান্তি পরিকল্পনাই এসব ইস্যু সমাধান করতে পারবে না, যতক্ষণ না যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে মৌলিক পরিবর্তন আনে—যা ওয়াশিংটন করতে প্রস্তুত নয়।
আঞ্চলিক শক্তিগুলোর নিজস্ব এজেন্ডা রয়েছে। সৌদি আরব, তুরস্ক, মিশরসহ অন্যান্য রাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থেই কাজ করে, যা অনেক সময় আমেরিকার অগ্রাধিকারের সঙ্গে মেলে না। তারা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে অংশ নেয় কেবল তখনই, যখন তা তাদের স্বার্থে কাজে লাগে।
অর্থনৈতিক প্রণোদনার মরীচিকা
ট্রাম্পের পরিকল্পনাগুলিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে শান্তির চাবিকাঠি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়—যেন সমৃদ্ধি সব রাজনৈতিক ক্ষোভ মুছে দেবে। এটি আসলে পুঁজিবাদের রূপান্তরমূলক শক্তিতে আমেরিকার এক ধরনের ধর্মবিশ্বাসের প্রতিফলন।
কিন্তু ইতিহাস বলছে, অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা জাতীয়তাবাদী আবেগ বা নিরাপত্তা-ভীতিকে অতিক্রম করতে পারে না। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত অর্থনৈতিক নয়, এটি ভূমি, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের পরস্পরবিরোধী দাবির সংঘাত।
ফিলিস্তিনিদের কিছু অর্থনৈতিক সুযোগ দিয়ে মূল রাজনৈতিক ইস্যুগুলো অমীমাংসিত রাখলে শান্তি আসবে না—বরং ক্ষোভ বাড়বে।
একইভাবে, আরব দেশগুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিনিময়ে অর্থনৈতিক সুবিধা দেওয়া কার্যকর হয় কেবল তখনই, যখন তারা আগেই সে পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু যেখানে তাদের জনগণ এই পদক্ষেপকে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখে, সেখানে এমন চুক্তি রাজনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনে।
যা সত্যিকারের শান্তির জন্য প্রয়োজন
মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তির জন্য যা প্রয়োজন, তা ওয়াশিংটনের কোনো কূটকৌশল নয়, বরং বাস্তববাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি।
প্রথমত, স্থানীয় মালিকানা: বাইরের শক্তির চাপিয়ে দেওয়া সমাধান কখনও স্থায়ী হয় না। শান্তি তখনই স্থায়ী হয়, যখন সেটি আঞ্চলিক শক্তির বাস্তবতা প্রতিফলিত করে এবং স্থানীয় পক্ষগুলোর মধ্যেই আলোচনার মাধ্যমে আসে।
দ্বিতীয়ত, বাস্তব প্রত্যাশা: নিকট ভবিষ্যতে সর্বাত্মক শান্তি সম্ভব নয়। তাই সংঘাত ব্যবস্থাপনাই হওয়া উচিত মূল লক্ষ্য, সমাধান নয়।
তৃতীয়ত, আমেরিকার সংযম: ওয়াশিংটনের লাগাতার হস্তক্ষেপ অনেক সময় পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। বরং তুলনামূলক হালকা উপস্থিতি আঞ্চলিক পক্ষগুলোকে নিজেদের মতো করে সমঝোতায় পৌঁছাতে সাহায্য করতে পারে।
চতুর্থত, সীমাবদ্ধতার স্বীকৃতি: কিছু সংঘাত এখনই সমাধানের উপযুক্ত নয়। তাই "বড় চুক্তি"র মোহে না পড়ে সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ ও মানবিক ক্ষয়ক্ষতি কমানোই বুদ্ধিমানের কাজ।
চেনা ধারা, নতুন মুখ
এই দৃশ্যপট নতুন নয়। আমেরিকার প্রতিটি নতুন প্রশাসনই বিশ্বাস করে, আগের সরকার যা পারেনি, এবার তারা সেই "ম্যাজিক ফর্মুলা" খুঁজে পেয়েছে। শুরুতে আশাবাদ, তারপর বাস্তবতার ধাক্কা, শেষে হয় জোরপূর্বক চাপ প্রয়োগ নয়তো চুপিসারে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়া—এই পুরোনো চক্র বারবারই ফিরে আসে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনাও সম্ভবত সেই পুরোনো ধারা অনুসরণ করবে। কারণ ব্যর্থতার কারণ ট্রাম্প নন, বরং শান্তির মৌলিক শর্তগুলোই এখনো তৈরি হয়নি। পক্ষগুলো প্রস্তুত নয়, আঞ্চলিক ভারসাম্য সমর্থন করছে না, আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব—যদিও এখনও বিশাল—এই বাধাগুলো অতিক্রম করার মতো নয়।
যে পথটি হয়তো কার্যকর হতে পারে
বড় কোনো "ঐতিহাসিক শান্তি পরিকল্পনা"র ব্যর্থতার চক্র থেকে বের হতে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে—
সংঘাত নিয়ন্ত্রণে মনোযোগ দেওয়া: সহিংসতা ঠেকানো ও উত্তেজনা কমানোই প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত।
নির্বাচিত সম্পৃক্ততা: যেখানে মার্কিন স্বার্থ সরাসরি ঝুঁকিতে, কেবল সেখানেই হস্তক্ষেপ করা।
আঞ্চলিক কাঠামোকে উৎসাহ দেওয়া: আমেরিকা-নির্ভর নিরাপত্তা কাঠামো চাপিয়ে না দিয়ে, আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে নিজেদের ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে দেওয়া।
প্রত্যাশা কমানো: মার্কিন কূটনীতির ক্ষমতা নিয়ে অবাস্তব প্রচারণা বন্ধ করা।
এটি হয়তো ওয়াশিংটনের "ঐতিহাসিক সাফল্যের" খিদে মেটাবে না, কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে এটাই খাপ খায়। এতে অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতির পরিণত হতাশা থেকে অন্তত মুক্তি মিলবে।
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আপাতত আসছে না—ট্রাম্পের কোনো পরিকল্পনাই এই সত্য পাল্টাতে পারবে না। যত দ্রুত বিশ্ব এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে নিজেদের নীতি সে অনুযায়ী সাজাবে, ততই মঙ্গল।
লেখক: লিওন হাদার একজন পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক ও স্যান্ডস্টর্ম: পলিসি ফেইলিওর ইন দ্য মিডল ইস্ট গ্রন্থের লেখক। উপরে আলোচিত এই নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় তার সাবস্ট্যাক-এ এবং এশিয়া টাইমসে পুনঃপ্রকাশিত হয় আজ সোমবার, ৬ অক্টোবর। মূল নিবন্ধ থেকে পরিমার্জিত ও সংক্ষেপিত আকারে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পাঠকের জন্য এটি অনূদিত করা হলো।
