বিক্রি কমলেও মদের ব্যবসায় রেকর্ড ১৯০ কোটি টাকা মুনাফা কেরুর

বিক্রি কিছুটা কমলেও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেকর্ড ১৯০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যা প্রায় নয় দশকের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
বিদেশি মদ আমদানিতে কঠোর বিধিনিষেধ ও চড়া মুনাফার সুবাদে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই ডিস্টিলারিটি দারুণ সাফল্য পেয়েছে, যা কোম্পানিটির মুনাফা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে।
লোকসানি চিনি ইউনিটের ৬২ কোটি টাকা লোকসান সমন্বয় করার পরও কেরুর সমন্বিত নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১২৮ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ৫২ শতাংশ বেশি। শুধু ডিস্টিলারি ইউনিট থেকেই মুনাফা গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ বেড়েছে। এ থেকেই স্পষ্ট, মদের ব্যবসাই এখন কোম্পানিটির মূল আর্থিক চালিকাশক্তি।
তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ডিস্টিলারিটির মোট আয় ৩ শতাংশ কমে ৪৪৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। মূলত গত বছরের জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে উৎপাদন ও মদের ব্যবহার কমে যায়।
তা সত্ত্বেও এই পরিসংখ্যান গত দুই বছরের কাছাকাছি। কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরসহ টানা তিন বছর ধরে ডিস্টিলারি ইউনিটটি ধারাবাহিকভাবে ৪০০ কোটি টাকার বেশি মোট রাজস্ব ও ১০০ কোটি টাকার বেশি নিট মুনাফা অর্জন করেছে। এই ইউনিটে প্রায় বারো ধরনের মদ উৎপাদন হয়।
মুনাফার পাশাপাশি রাজস্ব বৃদ্ধির তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১৯ অর্থবছর থেকে শুরু করে গত সাত বছরে প্রতিবারই মুনাফার ক্ষেত্রে আগের বছরকে ছাড়িয়ে গেছে কেরু। ডিস্টিলারি ইউনিটের নিট মুনাফার হার ৪৩ শতাংশ। অন্যদিকে চিনির ব্যবসা এখনও অলাভজনক রয়ে গেছে।
নিট মুনাফার মার্জিন একটি কোম্পানির লাভজনকতা নির্দেশ করে। সব খরচ বাদ দেওয়ার পর মোট রাজস্বের কত শতাংশ মুনাফা হিসেবে থাকে, তা-ই উঠে আসে নিট মুনাফায়। নিট মুনাফার হার বেশি হলে সেটি কোম্পানির দক্ষতা ও আর্থিক সক্ষমতার পরিচায়ক। এর অর্থ, কোম্পানি তাদের বিক্রি থেকে বেশি আয় ধরে রাখতে পারছে।
১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ও ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা কেরু অ্যান্ড কো (বাংলাদেশ) মূলত একটি চিনিকল পরিচালনা করে। এর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি দর্শনায় অবস্থিত লাইসেন্সপ্রাপ্ত ডিস্টিলারিতে চিনির উপজাত ঝোলাগুড় থেকে স্থানীয়ভাবে অ্যালকোহল তৈরি করে।
এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি আখ থেকে চিনি তৈরির পর অবশিষ্টাংশ বা ছোবড়া থেকে জৈব-সার উৎপাদন করে। কোম্পানিটির বাণিজ্যিক খামার ও একটি ফার্মাসিউটিক্যাল ইউনিটও রয়েছে।
কেরুর কর্মকর্তারা জানান, ২০২১ সালে সরকার বিদেশি মদ আমদানিতে বিধিনিষেধ কঠোর করার পর থেকে কেরু ব্র্যান্ডের মদের চাহিদা বেড়েছে। এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে কেরুকে তার সক্ষমতা ও উৎপাদন দুটিই বাড়াতে হয়েছে।
কেরুর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কোম্পানির ইতিহাসে ডিস্টিলারি ইউনিট থেকে এত বেশি মুনাফা আর কখনও হয়নি। বিদেশি মদ আমদানিতে কঠোর বিধিনিষেধের কারণে দেশে উৎপাদিত কেরু ব্র্যান্ডের মদের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'শুধু ডিস্টিলারি ইউনিটই নয়, কেরুর অন্যান্য ব্যবসায়িক বিভাগ—খামার, জৈবসার ও ফার্মাসিউটিক্যাল ইউনিটগুলোও এ বছর ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুনাফা করেছে।'
অধিক মুনাফা সত্ত্বেও বিক্রি কমে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, গত বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বিক্রি কিছুটা কমে গিয়েছিল। তবে বছরের শেষের দিকে তা আবার বাড়ে, যা মুনাফা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
রাব্বিক আরও বলেন, 'কারখানার অভ্যন্তরীণ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও ডিস্টিলারি ইউনিটের বকেয়া পাওনা আদায়ের মতো বেশ কিছু উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা মুনাফার প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছি। এছাড়া গত বছর আমরা মদের দামও বাড়িয়েছি।'
চিনি ইউনিটের জন্য ১০২ কোটি টাকার বিএমআরই প্রকল্প
মদ থেকে বিপুল মুনাফা এলেও কেরুর চিনি উৎপাদন কার্যক্রম কেরুর আর্থিক স্থিতিশীলতার ওপর বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬২ কোটি টাকা লোকসানের ফলে এর মোট পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৯৩১ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
কেরুর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, 'আমরা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী চিনি উৎপাদন করতে পারছি না। ফলে আখ মাড়াই করে উৎপাদিত চিনিতে বড় ধরনের লোকসান হচ্ছে। এর সঙ্গে ঋণের উচ্চ সুদ চিনি ইউনিটের লোকসানকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।'
চিনি ইউনিটকে পুনরুজ্জীবিত করতে কেরু ১০২ কোটি টাকা ব্যয়ে এর আধুনিকায়নের কাজ করছে। এর মধ্যে ৯২ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে ও ১০ কোটি টাকা কোম্পানির নিজস্ব তহবিল থেকে আসছে।
বিএমআরই (ব্যালেন্সিং, মডার্নাইজেশন, রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড এক্সপ্যানশন) প্রকল্পটি ২০১২ সালে দুই বছর মেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে শুরু হলেও বারবার বিলম্বের শিকার হয়েছে এবং ১৩ বছর পরেও পরীক্ষামূলক উৎপাদন শেষ করতে পারেনি। সম্প্রতি আখ মাড়াই মৌসুম সময়ের আগেই শেষ হয়ে যাওয়ায় পরীক্ষামূলক উৎপাদন ব্যর্থ হয়। এরপর প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে।
এই বিনিয়োগ চিনি ইউনিটকে লাভজনক করতে পারবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে রাব্বিক হাসান বলেন, 'সরকার আধুনিকায়নের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। এটি শেষ হলে আগামী বছর নতুন প্রকল্পটি চালু হবে। তখনই কেবল বলা সম্ভব হবে এটি আসলেই লাভজনক হবে কি না।'