পৃথিবীর এই সংকটকালে ভালো থাকার মন্ত্র: ইউভাল নোয়াহ হারারি, ররি স্টুয়ার্ট এবং মারিয়া রেসা

এক মঞ্চে যখন বসেন একজন বিশ্বখ্যাত ইতিহাসবিদ, একজন নোবেলজয়ী সাংবাদিক এবং একজন রাজনীতিবিদ—তখন কী হয়? আলোচনায় ছিলেন ইউভাল নোয়াহ হারারি, যাঁর 'স্যাপিয়েন্স' বইটি ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভাবনা বদলে দিয়েছে; মারিয়া রেসা, ফিলিপিন্সের সেই নির্ভীক সাংবাদিক যিনি সত্য বলার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতেছেন; এবং ররি স্টুয়ার্ট, ব্রিটেনের প্রাক্তন মন্ত্রী ও একজন গভীর চিন্তাবিদ।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান থেকে গণতন্ত্রের সংকট—কোনো কিছুই বাদ যায়নি তাঁদের আলোচনা থেকে। কিন্তু সবকিছুর কেন্দ্রে ছিল একটি প্রশ্ন: এই সংকটময় পৃথিবীতে ভালোভাবে বেঁচে থাকার উপায় কী?
ইউভাল নোয়াহ হারারি: হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে। আধুনিক উদারনীতিবাদ ও গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র ছিল: 'ভিন্নমত নিয়েও একসঙ্গেই বাঁচা'। অর্থাৎ, ভালো জীবন নিয়ে মানুষের নানা ধারণা থাকতে পারে, কিন্তু কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে তারা একসঙ্গে থাকতে পারে। সমস্যা তখনই হয়, যখন কোনো গোষ্ঠী ভাবে যে ভালো জীবনের একমাত্র সঠিক উত্তর শুধু তাদেরই জানা এবং তা বাকিদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেক মতাদর্শের মূল ভিত্তিই হলো নিজেদের 'ভালো জীবন'-এর ধারণা সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়া। আর প্রায়শই দেখা যায়, নিজে সেই জীবনযাপনের চেয়ে অন্যের ওপর তা জোর করে চাপানো অনেক সহজ। ভাবুন মধ্যযুগের ক্রুসেডের কথা: একদল মানুষ নিজেরা বিনয় ও সহানুভূতির খ্রিস্টীয় জীবনযাপন ছেড়ে হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছিল অন্যকে খুন করতে, শুধু নিজেদের নীতি জোর করে মানানোর জন্য। আজকের দুনিয়াতেও সেই একই নাটকের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
ররি স্টুয়ার্ট: ইউভালের কথার কেন্দ্রে রয়েছে উদারনীতিবাদের ধারণা। উনিশ শতকে এটি শক্তিশালী হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নতুন রূপ পায়। আমরা সেই উত্তরাধিকারই বহন করছি। এই ধারণাটি নিয়ম-ভিত্তিক বিশ্ব, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সহনশীলতা, মানবাধিকার এবং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার ওপর দাঁড়িয়েছিল। ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মনে হতো, মানবজাতির এটাই স্বাভাবিক গন্তব্য।
কিন্তু তারপরই সব লাইনচ্যুত হতে শুরু করে। আজ সেই সুন্দর মডেলটির প্রতিটি অংশই অন্ধকার রূপ নিয়েছে। গণতন্ত্রের জায়গায় এসেছে স্বৈরাচারী শাসন, মুক্ত বাণিজ্যের বদলে উঠেছে সুরক্ষার দেয়াল, আর নিয়মের শাসনের জায়গায় চলছে 'জোর যার মুলুক তার'-এর নীতি। আর এই অবক্ষয়ে ঘি ঢালছে সোশ্যাল মিডিয়া এবং এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।

মারিয়া রেসা: আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো: শেষ পর্যন্ত কি অন্যায়েরই জয় হবে? কারণ বাস্তব ও ভার্চুয়াল জগতে যা ঘটছে, তাতে স্পষ্ট যে আন্তর্জাতিক আইনকানুনের শাসন আর চলছে না। আপনি ভালো থাকবেন কী করে, যখন প্রযুক্তি-দৈত্যরা শুধু মুনাফার জন্য আমাদের ওপর নজরদারি চালাচ্ছে এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে? এই প্রযুক্তি গণতন্ত্রের কোষে কোষে আঘাত হানতে পারে।
সব বড় ধর্মই বলে, ভালো জীবনের আসল যুদ্ধটা হয় নিজের ভেতরে—নিজের ভালো সত্তার সঙ্গে খারাপ সত্তার লড়াই। "অন্যের সাথে তেমন ব্যবহার করো, যা তুমি নিজের জন্য আশা করো"—কত সহজ কথা! কিন্তু এই মূল্যবোধগুলো আমরা টিকিয়ে রাখব কীভাবে, যখন আমাদের যোগাযোগের মাধ্যমটাই বিষাক্ত?
ইউভাল নোয়াহ হারারি: আজকের পরিস্থিতির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো, এখন আমাদের হাতে মানুষকে 'হ্যাক' করার প্রযুক্তি আছে, যা তাদের ভেতরের যুদ্ধকে প্রভাবিত করতে পারে। মধ্যযুগে বা এমনকি বিংশ শতাব্দীতেও এটা কল্পনার বাইরে ছিল। বড় কর্পোরেশনগুলো আমাদের মনের ইচ্ছা ও ভাবনাকে শুধু পড়তেই পারে না, নিজেদের ইচ্ছেমতো বদলে দেওয়ার অভূতপূর্ব ক্ষমতাও রাখে। আঠারো-উনিশ শতকের উদার গণতন্ত্র এই নতুন দৈত্যের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত নয়।
ররি স্টুয়ার্ট: আরেকটা ভয় হলো, প্রযুক্তি হয়তো আমাদের অস্তিত্বকেই ছোট করে দেবে। সভ্যতার ইতিহাস তো নায়ক বা আদর্শদের গল্প, যারা মানবিক সম্ভাবনার সীমানাকে প্রসারিত করেছেন। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি আক্ষরিক অর্থেই 'অতিমানব' হয়ে ওঠে? যখন একটি যন্ত্র অনায়াসে আমার চেয়ে ভালো কবিতা লিখবে বা নাটক বানাবে, তখন মানুষ হিসেবে আমাদের মূল্য কি কমে যাবে না?
মারিয়া রেসা: এই প্রযুক্তি যদি ১০০% নির্ভুল হতো, তবে দারুণ হতো। কিন্তু তা নয়! আমরা এমন যুগে বড় হয়েছি যেখানে ছাপা অক্ষরকে বিশ্বাস করা হতো, তাই আমাদের বোকা বানানো সহজ। সমাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-কে যেভাবে আনা হয়েছে, তার সঙ্গে সত্যের সম্পর্ক সামান্যই। আমি জানি ইউভাল বলেন, তথ্য মানে শুধু ফ্যাক্টস নয়, বরং গল্প। কিন্তু বাস্তব তথ্যই তো সেই নোঙর, যা আমাদের সম্মিলিত বাস্তবতাকে ধরে রাখে।

আমি একটা প্রশ্ন করি: মানুষ কি আসলে ভালো, নাকি খারাপ? উত্তরটা জরুরি, কারণ গণতন্ত্রের পতন এবং স্বৈরাচারী নেতাদের উত্থানের একটা বড় কারণ হলো, আমরা মানবতার ভালো দিকটার গলা টিপে ধরেছি। আমি যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষের নৃশংসতা দেখেছি, কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর অবিশ্বাস্য উদারতাও দেখেছি। রদ্রিগো দুতার্তের মতো শাসকের দুঃশাসন আমরা পার করতে পারতাম না, যদি না কিছু ভালো মানুষ 'র্যাপলার'-কে অর্থ দিয়ে ও শ্রম দিয়ে সাহায্য করত। মানবতার এই ভালো দিকটাই আজ ঝুঁকির মুখে।
ইউভাল নোয়াহ হারারি: একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য হলো, ভালো হওয়ার সাথে বুদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়তো সবচেয়ে শক্তিশালী প্রযুক্তি, কিন্তু বুদ্ধিমান হলেই কেউ ভালো বা জ্ঞানী হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হোমো স্যাপিয়েন্স এই গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান, আবার একই সাথে সবচেয়ে বিভ্রান্ত প্রজাতি। মানুষ এমন সব গাঁজাখুরি গল্প বিশ্বাস করে যা কোনো শিম্পাঞ্জিও করবে না। এখন আমরা এক 'অতি-বুদ্ধিমান' শক্তি তৈরি করছি, এবং এটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, সে হবে 'অতি-মাত্রায় বিভ্রান্ত'।
ররি স্টুয়ার্ট: ইউভাল হয়তো ২০০ বছর পরের কথা ভাবতে পারেন, কিন্তু চলুন আগামী ২০ বছরের কথা ভাবি। আমরা সিলিকন ভ্যালির চোখে ভবিষ্যৎ দেখি, কিন্তু বাস্তবতা হলো, আগামী দশকগুলোতে কোটি কোটি মানুষ দৈনিক ২ ডলারের কম আয়ে জীবন কাটাবে। যুদ্ধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। প্রযুক্তি-সম্পন্ন ধনী দেশগুলো সামান্য ঝুঁকি নিয়েই প্রতিবেশীদের ওপর ভয়ঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে, যার প্রমাণ গাজা ও ইউক্রেন।
বিশ্বজুড়ে বাড়ছে অস্ত্র প্রতিযোগিতা। ইউরোপ প্রতিরক্ষা খাতে জিডিপির ৫% খরচ করতে চলেছে, যা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা থেকে শত শত বিলিয়ন ইউরো কেড়ে নেবে।এমন সময়ে ঘটছে যখন অর্থনীতি স্থবির আর জনসংখ্যা বৃদ্ধ হচ্ছে। তাই খুব সম্ভবত, আগামী ১০-২০ বছরে এ আই-এর বিকাশের পাশাপাশি বিশ্ব আরও দরিদ্র ও সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠবে।
মারিয়া রেসা: আমি ররির সাথে একমত, কিন্তু আমার ভয়টা আরও বেশি। আমার মনে হয় না ২০ বছর লাগবে। ফিলিপিন্সে প্রতি বছর গড়ে ২০টি টাইফুন আঘাত হানে, দ্বীপগুলো চোখের সামনে ডুবে যাচ্ছে, আর পশ্চিমারা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তর্ক করছে। আমার তো মনে হয়, সাংবাদিকতার মৃত্যু দরজায় কড়া নাড়ছে—হয়তো আর ছয় মাস বা এক বছর বাকি। ইন্টারনেট দিন দিন এক শিকারি জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে, যার প্রভাব আমাদের বাস্তব জীবনেও পড়ছে।
ইউভাল নোয়াহ হারারি: গত কয়েক বছর আমি মূলত উদ্বেগ বাড়ানোর কাজ করেছি—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি নিয়ে। কিন্তু এখন আমাদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার কাজ করতে হবে। কারণ ভয় আর অবিশ্বাসের মধ্যে কোনো কিছুই সম্ভব নয়। গণমাধ্যম, সরকার এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা সবচেয়ে জরুরি। প্রশ্ন হলো, কীভাবে?
ররি স্টুয়ার্ট: এর জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেতর থেকে ঠিক করতে হবে। রাজনীতিবিদ হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা হলো, সরকার আমার কল্পনার চেয়েও অনেক খারাপ। আমার বস লিজ ট্রাস যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন, তিনি ভাবতেন তাঁর কাজ হলো ইনস্টাগ্রাম আর প্রচার চালানো। নীতির বাস্তব প্রভাব নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা ছিল না। পুরো ব্যাপারটাই একটা খেলায় পরিণত হয়েছে।

মারিয়া রেসা: দুনিয়া যখন খাদের কিনারায়, তখন আমরা আর কতদিন নির্বাচনের সততার ভান করব? আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন একসময় কাজ করত, কারণ আমেরিকা বৃহত্তর মঙ্গলের কথা ভাবত। কিন্তু এখন যখন সবচেয়ে শক্তিমানরাই শুধু নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত, তখন বাকিদের কী হবে? তার মানে কি সব মূল্যবোধ বিসর্জন দিতে হবে?
ইউভাল নোয়াহ হারারি: অদ্ভুতভাবে, পুরোনো রাজতন্ত্রের ধারণা ফিরে আসছে। আজকের নেতারা বিংশ শতাব্দীর স্বৈরাচারীদের মতো নন। ট্রাম্প রাজনীতিকে রাষ্ট্র বা জনগণের সম্পর্ক হিসেবে দেখেন না, বরং ব্যক্তি, রাজা ও রাজবংশের খেলা হিসেবে দেখেন। তিনি মনে করেন, চুক্তি রাষ্ট্রের মধ্যে হয় না, হয় ব্যক্তির মধ্যে। তাঁর জায়গায় অন্য কেউ এলে, চুক্তিরও শেষ। আজকের নেতাদের কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শ নেই, যা বিংশ শতাব্দীর স্বৈরাচারীদের ছিল। তাই এদের কাজ করার স্বাধীনতা অসীম।
ররি স্টুয়ার্ট: আধুনিক যুগের একটি অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আমরা নেতাদের বিচার করার নৈতিক ভাষাটাই হারিয়ে ফেলেছি। ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্লজ্জ। সংবিধান, সংখ্যালঘু বা সত্যের প্রতি তাঁর যে অবজ্ঞা, তা অ্যারিস্টটল বা আমেরিকান সংবিধানের প্রণেতারাও কল্পনা করতে পারতেন না। আর আমরা দর্শকরাও যেন এই নোংরা নাটক উপভোগ করতে করতে হতবাক হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি।
মারিয়া রেসা: হোয়াইট হাউসে রিপোর্টাররা ট্রাম্পের মিথ্যাগুলোই তোতাপাখির মতো আওড়ে যাচ্ছিলেন। তাদের উচিত ছিল 'ট্রুথ স্যান্ডউইচ' ব্যবহার করা: সত্যটা আগে ও পরে বলা, আর মাঝখানে মিথ্যাটাকে তুলে ধরা। সাংবাদিক হিসেবে আমাদের বলতে হবে, "এই লোকটি মিথ্যা বলছে।" কারণ এটাই ফ্যাক্ট। মুনাফার জন্য নজরদারির এই ব্যবস্থায় আমরা বাঁচতে পারি না, কারণ এটা আমাদের ভেতরের পশুটাকে জাগিয়ে তোলে। গণতন্ত্রের হাজারটা সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু এর চেয়ে ভালো কোনো ব্যবস্থা আমরা আজও খুঁজে পাইনি। সব শেষ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু আমরা লড়াই ছাড়ব না।
ইউভাল নোয়াহ হারারি: আমাদের বুঝতে হবে যে, আসল কঠিন কাজটা নিজেদেরই করতে হবে। এই ভাবার কোনো কারণ নেই যে, বাস্তবতা নিজে থেকেই সব ঠিক করে দেবে। যারা সত্যকে অস্বীকার করে, ইতিহাস তাদের সবসময় শাস্তি দেয় না। তাই আপনি যদি সত্যকে জেতাতে চান, তবে আমাদের প্রত্যেককে নিজের ভাগের কাজটা করতে হবে। যেকোনো একটি বিষয় বেছে নিন, সেটির ওপর মনোযোগ দিন এবং আশা করুন যে অন্যরাও তাদের দায়িত্ব পালন করবে। এভাবেই আমরা চরম হতাশার অন্ধকার থেকে বাঁচতে পারি।