এখন থেকে প্রত্যেক ট্রেড লাইসেন্সের সঙ্গে ‘বাংলা কিউআর’ বাধ্যতামূলক

'ক্যাশলেস বাংলাদেশ' গড়ার লক্ষ্যে বড় ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এখন থেকে সব ট্রেড লাইসেন্সের সঙ্গে বাংলা কিউআর পেমেন্ট সিস্টেম সংযুক্ত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিডি) থেকে জারি করা নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, এখন থেকে খুচরা ব্যবসা ও মার্চেন্টদের ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন বা নতুন করে ইস্যুর ক্ষেত্রে বাংলা কিউআর সংযুক্তি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এই পদক্ষেপের লক্ষ্য হলো দেশে ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থাকে দ্রুত সম্প্রসারণ করা, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) মধ্যে, এবং সারাদেশে ক্যাশলেস লেনদেন সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে—যা এতদিন কাগজের নোট মুদ্রণ ও বিতরণে ব্যয় হতো।
তবে এ নির্দেশনা এক মাসেরও বেশি আগে জারি হলেও এখনো অনেক সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত নয়। তারা জানিয়েছে, আনুষ্ঠানিকভাবে নির্দেশনা পাওয়ার পর ধাপে ধাপে এ ব্যবস্থা চালু করা হবে।
বাংলা কিউআর ও 'ক্যাশলেস বাংলাদেশ' এর উদ্যোগ
'ক্যাশলেস বাংলাদেশ' উদ্যোগটি সরকারের একটি সামগ্রিক কৌশল, যার লক্ষ্য নগদ টাকার ওপর নির্ভরতা হ্রাস করে নিরাপদ, কার্যকর ও স্বচ্ছ ডিজিটাল লেনদেনকে উৎসাহিত করা। এই উদ্যোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাংলা কিউআর—একটি মানসম্মত ও আন্তঃব্যবহারযোগ্য (ইন্টারঅপারেবল) কুইক রেসপন্স (কিউআর) কোড ব্যবস্থা।
একক কোনো ব্যাংক বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) সঙ্গে সীমাবদ্ধ অন্যান্য কিউআর কোডের বিপরীতে বাংলা কিউআর একটি সর্বজনীন (ইউনিভার্সাল) ব্যবস্থা। অর্থাৎ, কোনো ব্যবসায়ীর কাউন্টারে একটি মাত্র বাংলা কিউআর কোড থাকলেই সেটির মাধ্যমে যেকোনো ব্যাংকের মোবাইল অ্যাপ, বিকাশ বা নগদের মতো যেকোনো মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, কিংবা যেকোনো পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাপ থেকে সহজেই পেমেন্ট করা যাবে।

এই আন্তঃসংযোগযোগ্যতা বা ইন্টারঅপারেবিলিটি বাংলাদেশের ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থায় এক বড় পরিবর্তন আনছে।
ব্যবসায়ীদের জন্য এটি বহুমাত্রিক সুবিধা তৈরি করছে—এখন আর বিভিন্ন ব্যাংক বা মোবাইল পেমেন্ট সেবাদাতাকে একাধিক কিউআর কোড পরিচালনা করতে হবে না। অন্যদিকে, গ্রাহকদের জন্য এটি আরও সহজ ও সুবিধাজনক; তারা তাদের পছন্দের ব্যাংক বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে এক স্ক্যানেই পেমেন্ট সম্পন্ন করতে পারবেন, ব্যবসায়ীর সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ভিন্ন হলেও।
বাংলা কিউআর সংযুক্তি বাধ্যতামূলক হওয়ায় এখন ব্যবসায়িক পেমেন্ট প্রক্রিয়া হবে আরও সহজ, একীভূত ও কার্যকর। এর আগে ডিজিটাল পেমেন্ট চালু করতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে আলাদাভাবে আবেদন, যাচাই এবং বিভিন্ন সেবা প্রদানকারীর সঙ্গে প্রযুক্তিগত সমন্বয় করতে হতো—যা ছিল সময়সাপেক্ষ ও জটিল একটি প্রক্রিয়া।
নতুন নীতিমালার আওতায় ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু বা নবায়নের সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাংলা কিউআর নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে—যা উদ্যোক্তাদের জন্য ডিজিটাল অর্থনীতিতে প্রবেশের বাধা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেবে।
নির্দেশনা থেকে স্থবিরতা: বাস্তবায়নে ঘাটতি
সরকার বড় ধরনের অর্থনৈতিক রূপান্তরের পথে অগ্রসর হলেও মাঠপর্যায়ে বাস্তবতা অবশ্য ভিন্ন। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা ও স্থানীয় প্রশাসনের সচেতনতার মধ্যে অসামঞ্জস্য অনেকটাই স্পষ্ট—যা পুরো কর্মসূচির বাস্তবায়নে সংশয় তৈরি করছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সিস্টেম অ্যানালিস্ট মো. আবু তাইয়েব রকন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাংলা কিউআর সংযুক্তি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে—এটি আমরা জানতাম না। তবে আমরা আগেই ডিজিটাল পেমেন্ট প্রচারের কাজ শুরু করেছিলাম। এখন যেহেতু এটি বাধ্যতামূলক হয়েছে, মাঠপর্যায়ে দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। আজই প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেব।"

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (জোন–৭) ট্যাক্সেশন অফিসার এ এফ এম জোবায়ের ইসলাম ভূঁইয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা পাইনি। অনলাইন পেমেন্ট বাধ্যতামূলক হলে আমাদের সেবাও আরও সহজ ও কার্যকর হবে। নির্দেশনা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দ্রুত বাস্তবায়ন করব।"
খুলনা সিটি করপোরেশন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন, সাভার পৌরসভা ও চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, এখনো বাংলা কিউআর পেমেন্ট ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। কেউ কেউ বলেছেন, তারা এখনও নির্দেশনাটিই পাননি।
চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার লাইসেন্স পরিদর্শক মো. মতাহার উদ্দিন মোল্লা বলেন, "আমরা ক্যাশলেস পেমেন্ট বিষয়ে একটি নোটিশ পেয়েছি, তবে গ্রাহকদের কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে—সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা পাইনি। সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।"
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের 'ক্যাশলেস অর্থনীতি' গড়ার উদ্যোগ কাগজ-কলমে যতই সাহসী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হোক না কেন, মাঠপর্যায়ে সমন্বয় ও যোগাযোগ দুর্বল থাকলে তা ব্যাহত হতে পারে। বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে দীর্ঘদিনের সমন্বয়হীনতা ও যোগাযোগ ঘাটতি দূর না হলে এই সময়োপযোগী উদ্যোগটিও গতি পাওয়ার আগেই থমকে যেতে পারে।
তবে যদি প্রশাসনিক সমন্বয়ের চাকা ঘুরতে শুরু করে, তাহলে সারাদেশের খুচরা ব্যবসা ও ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তারা (এসএমই) নগদবিহীন লেনদেনের সুফল ভোগ করতে পারবেন—লেনদেনে স্বচ্ছতা বাড়বে, সময় ও খরচ কমবে, এবং নগদ অর্থের ওপর নির্ভরতা অনেক কমে আসবে। আর তাতে সরকারের উচ্চাভিলাষী 'ক্যাশলেস বাংলাদেশ' ভিশন কেবল কাগজে-কলমে নয়—বাস্তবে রূপ নেবে।