ভারতের উচ্চশিক্ষা: গবেষণা ও প্রকাশনায় জালিয়াতি চরমে

ভারতের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাক্ষেত্রে এক ধরনের নৈতিক সংকট দানা বাঁধছে। গবেষণার মান নয়, এখন সফলতার মাপকাঠি হয়ে উঠেছে—কতটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হলো, কোন জার্নালে ছাপা হলো, কিংবা সেই গবেষণার ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর কত। এই রেটিং-র্যাঙ্কিং নির্ভর কাঠামো গবেষকদের ওপর ফেলছে অতিরিক্ত চাপ, যা অনেককেই ঠেলে দিচ্ছে অনৈতিক পথের দিকে।
২০২১ সালের জুলাইয়ে বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিকাল সায়েন্সেস তাদের একটি গবেষণা নিবন্ধ 'নেচার কেমিক্যাল বায়োলজি' থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। কারণ? গবেষণার তথ্যচিত্রে ছিল জালিয়াতির ছাপ। অথচ আগে একে রাসায়নিক জীববিদ্যায় যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসেবে দেখা হয়েছিল।
এমনই আরেকটি ঘটনা ঘটে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে। বানারাসের হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের কোভ্যাক্সিন-সম্পর্কিত গবেষণা 'ড্রাগ সেফটি' জার্নাল থেকে প্রত্যাহার করা হয়। কারণ গবেষণায় উল্লিখিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো উপস্থাপন করা হয়েছিল এমনভাবে, যা বিভ্রান্তিকর বা ভুল ব্যাখ্যার জন্ম দিতে পারত।
এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। গত দুই দশকে ভারতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা অন্তত ৫৮টি গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করেছেন, যার বেশিরভাগই চৌর্যবৃত্তি ও পুনরাবৃত্তির অভিযোগে।
'বিকশিত ভারত ২০৪৭'-এর লক্ষ্যে উন্নত রাষ্ট্র গড়তে চাওয়া ভারতের সামনে গবেষণা জালিয়াতি, তথ্য বিকৃতি, নকল ও ভুয়া রিভিউয়ের মতো অসাধুতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা পর্যবেক্ষণভিত্তিক সংস্থা রিট্র্যাকশন ওয়াচ-এর তথ্য অনুযায়ী, গবেষণাপত্র প্রত্যাহারের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতারণা, গুরুতর ভুল, নৈতিকতা লঙ্ঘন, প্রকাশনা নীতিমালা ভাঙা ও আইনি জটিলতা।
এই ধরনের অনিয়ম কেবল একটি গবেষণার মানই ক্ষুণ্ন করে না, বরং গোটা দেশের একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের ওপরই আস্থার সংকট তৈরি করে। আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব ও গবেষণা অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
গবেষণা বাড়ছে, বাড়ছে প্রত্যাহারও
গত এক দশকে ভারতের গবেষণা কার্যক্রমে এসেছে ব্যাপক গতি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল ক্ষেত্রে গবেষণাপত্র প্রকাশে ভারত এখন চীন ও আমেরিকার পরেই অবস্থান করছে।
স্কোপাস-এর তথ্যমতে, ১৮৬৭ সালের পর থেকে ভারতে ৩৬.৭ লাখ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে ৩ হাজার ৪৪৬টি (০.০৯ শতাংশ) প্রত্যাহার করা হয়েছে। যদিও আনুপাতিক হার হিসেবে এটি কম, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রত্যাহারের হার দ্রুত বাড়ছে। ১৯৯১–২০০০ সময়কালের তুলনায় ২০০১–২০১০-এ তা বেড়েছে ৬.৩ শতাংশ, আর ২০১১–২০২০ সময়কালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ শতাংশে।
পরিমাণ বনাম গুণমান
পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের ভাষায়, 'যখন একজন বিজ্ঞানীর পেশাগত টিকে থাকা নির্ভর করে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের উপর, তখন নৈতিকতা কেবল তাদের জন্য যারা বিলাসিতা করে তা বজায় রাখতে পারে।'
ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর মানে হলো, কোনো জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ কতবার উদ্ধৃত হচ্ছে তার গড় হার। এই সূচক এখন নিয়োগ, পদোন্নতি, র্যাঙ্কিং ও গবেষণা অনুদান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, যা গবেষকদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে।
এই চাপই অনেক সময় গবেষকদের অনৈতিক শর্টকাটে ঠেলে দেয়। যেমন: চৌর্যবৃত্তি, তথ্য জালিয়াতি, কিংবা ভুয়া পিয়ার রিভিউ।
গবেষণা ও প্রকাশনার নৈতিকতা বজায় রাখতে আন্তর্জাতিক সংস্থা 'কমিটি অন পাবলিকেশন এথিক্স' দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন নির্দেশিকা দিয়ে আসছে। ভারতের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েও পিএইচডি শুরুর আগে গবেষণার নৈতিকতা নিয়ে কোর্স বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব গবেষণাকাজে এসব নির্দেশনার প্রতিফলন কতটা ঘটছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বর্তমানে ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে এক ভয়ঙ্কর প্রবণতা বিস্তার লাভ করছে, যাকে বলা হয় 'পাবলিশ অর পেরিশ'—অর্থাৎ, গবেষণা প্রকাশ করুন, নইলে হারিয়ে যান। এই মানসিকতায় পদোন্নতি, চাকরি রক্ষা ও অনুদান পাওয়ার একমাত্র মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকাশনার সংখ্যা। ফলে গুণগত গবেষণা অনেক সময়েই পেছনে পড়ে যাচ্ছে। এর চাপ অনেককে অনৈতিক পথে পরিচালিত করছে, যা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলছে।
গবেষণার সততা নিশ্চিতকরণ
গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতে গবেষণা প্রত্যাহারের সবচেয়ে বড় কারণ ভুয়া পিয়ার রিভিউ (৩৩ শতাংশ)। এরপর তথ্য জালিয়াতি (১৭.২ শতাংশ) ও চৌর্যবৃত্তি (১৪.৮ শতাংশ)। প্রতিষ্ঠানভেদে সবচেয়ে বেশি প্রত্যাহার ঘটছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে (৬০ শতাংশ), এরপর আছে সরকারি প্রতিষ্ঠান (৩৩.৭ শতাংশ) এবং চিকিৎসাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান (৬.৭ শতাংশ)।
শুধু নীতিমালা থাকলেই গবেষণায় নৈতিকতা রক্ষা সম্ভব নয়; দরকার গঠনমূলক সংস্কার। একাডেমিক মূল্যায়নের পদ্ধতি ও প্রণোদনার কাঠামোয় পরিবর্তন না আনলে অনৈতিকতা প্রতিরোধ কঠিন।
বিশ্বের অনেক দেশেই গবেষণায় জালিয়াতি রোধে আইনগত কাঠামো ও কঠোর সহকর্মী পর্যালোচনার ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে নগদ পুরস্কারের প্রচলন আছে, সেখানে অনৈতিকতার ঝুঁকিও তুলনামূলক বেশি।
গবেষণায় অনৈতিকতা মোকাবিলায় দরকার একটি বহুমাত্রিক কৌশল—যা একদিকে গবেষকদের স্বাধীনতা রক্ষা করবে, অন্যদিকে নৈতিকতার সীমারেখা কঠোরভাবে নির্ধারণ করবে।
ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় গবেষণা পরিবেশ, অর্থায়ন কাঠামো ও প্রশাসনিক বাস্তবতায় একটি একক সমাধান সবক্ষেত্রে কার্যকর না-ও হতে পারে। তবে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নেওয়া পদক্ষেপ কিছুটা আশাব্যঞ্জক।
'ইউজিসি-সিএআরই' তালিকা বাতিল করে এখন প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের উপযোগী মানদণ্ড অনুযায়ী জার্নাল নির্ধারণ করতে পারবে। ইউজিসি জানায়, পূর্বের তালিকায় অনেক ভুয়া ও অর্থের বিনিময়ে প্রকাশিত সাময়িকী ঢুকে পড়েছিল, অথচ অনেক মানসম্মত ভারতীয় ভাষার জার্নাল বাদ পড়ে গিয়েছিল। নতুন ব্যবস্থায় বিস্তৃত পরিসরের জার্নালে গবেষণা প্রকাশের সুযোগ পাবেন শিক্ষকরা।
ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এখন প্রয়োজন—গবেষণা নৈতিকতা নিয়ে একটি বাধ্যতামূলক নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, প্রশিক্ষণ চালু করা এবং গবেষণার আচরণ তদারকির জন্য বিশেষ কমিটি গঠন।
একইসঙ্গে উন্মুক্ত পিয়ার রিভিউ পদ্ধতি উৎসাহিত করা এবং গবেষণার তথ্য ও পদ্ধতি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুললে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। এই ধরনের উদ্যোগ গবেষণাকে যেমন সমাজ ও গবেষণা মহলের বৃহত্তর নজরদারির আওতায় আনবে, তেমনি প্রতারণা বা অনৈতিকতার ঝুঁকিও কমাবে।
অনুবাদ-নাফিসা ইসলাম মেঘা