নিজ দেশে ফিরলেন ভারতের গুহা থেকে উদ্ধার হওয়া রুশ মা ও দুই সন্তান

দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে ভারতের কর্ণাটকের এক জঙ্গলের গুহায় বসবাস করে বিশ্বজুড়ে আলোচনায় এসেছিলেন রুশ নারী নিনা কুতিনা। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে তিনি তার সন্তানদের নিয়ে নিজ দেশ রাশিয়ায় ফিরে গেছেন।
গত ৯ জুলাই দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের একটি জঙ্গলে নিয়মিত টহলের সময় পুলিশের একটি দল ৪০ বছর বয়সী নিনা কুতিনা এবং তার ছয় ও পাঁচ বছর বয়সী দুই মেয়েকে একটি গুহায় খুঁজে পায়। ভারতে থাকার কোনো বৈধ কাগজপত্র না থাকায় সন্তানদেরসহ নিনাকে বিদেশিদের জন্য নির্ধারিত একটি আটক কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
পর্যটন কেন্দ্র গোয়ার সীমান্তবর্তী গোকর্ণ জঙ্গলের রামতীর্থ পাহাড়ের কাছে টহল দেওয়ার সময় পুলিশ একটি গুহার কাছে উজ্জ্বল রঙের কাপড় ঝুলতে দেখে। কাছে গিয়ে তারা দেখে, রঙিন শাড়ি দিয়ে গুহার প্রবেশপথ ঢাকা। হঠাৎ ভেতর থেকে 'ছোট্ট স্বর্ণকেশী এক মেয়েকে' দৌড়ে বেরিয়ে আসতে দেখে পুলিশ সদস্যরা অবাক হন। তারা মেয়েটিকে অনুসরণ করে ভেতরে ঢুকলে নিনা ও তাঁর অন্য সন্তানকে দেখতে পান।
গুহাটির ভেতর থেকে পানি চুইয়ে পড়ছিল এবং সেখানে তাদের সামান্য কিছু জিনিসপত্র ছিল—কয়েকটি প্লাস্টিকের মাদুর, কিছু কাপড়, ইনস্ট্যান্ট নুডলসের প্যাকেট এবং আরও কিছু মুদিপণ্য।
গুহায় বসবাসের এই জীবনযাত্রাকে অদ্ভুত মনে হলেও নিনা একে স্বাভাবিকভাবেই দেখতেন। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তিনি ও তাঁর সন্তানরা এভাবেই সুখে ছিলেন এবং 'প্রকৃতি সুস্বাস্থ্য দেয়'।
যখন পুলিশ তাকে উদ্ধার করতে যায়, তখন তিনি বলেছিলেন, 'পশু ও সাপ আমাদের বন্ধু। মানুষ বিপজ্জনক।' পুলিশ জানায়, নিনা দাবি করেছেন, উদ্ধারের আগে তাঁরা এক সপ্তাহ ধরে ওই গুহায় থাকছিলেন। এর আগে তিনি গোয়াতেও একটি গুহায় থাকতেন এবং তার ছোট মেয়ের জন্মও গোয়ার এক গুহায়।
তবে বর্ষাকালে ওই এলাকা ভূমিধসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পুলিশ কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি হয়নি।
নিনার এই অদ্ভুত জীবনযাত্রার খবরের পাশাপাশি সামনে আসে এক আইনি লড়াইয়ের গল্প। গোয়ায় বসবাসকারী দ্রোর শ্লোমো গোল্ডস্টেইন নামে এক ইসরায়েলি ব্যবসায়ী নিজেকে শিশু দুটির বাবা দাবি করে আদালতের দ্বারস্থ হন। তিনি সন্তানদের রাশিয়ায় পাঠানো বন্ধ করে নিজের জিম্মায় নেওয়ার আবেদন করেন।
গোল্ডস্টেইন এক টিভি চ্যানেলকে জানান, নিনা তাকে না জানিয়েই গোয়া ছেড়ে চলে যান এবং তিনি এ বিষয়ে পুলিশে অভিযোগও করেছিলেন। তার দাবি, তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিনা ও তার দুই মেয়ের ভরণপোষণ দিয়ে আসছিলেন।
তবে কর্ণাটক হাইকোর্ট তাদের আদেশে বলেন, গোল্ডস্টেইনের দাবি সত্ত্বেও মা ও শিশুরা 'রহস্যজনকভাবে' একটি বিচ্ছিন্ন গুহায় বসবাস করছিলেন। আদালত আরও বলেন, 'কর্তৃপক্ষ তাদের পুনর্বাসনের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করার আগ পর্যন্ত' কেন তারা গুহায় বসবাস করছিল, গোল্ডস্টেইন তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
অবশেষে দেশে ফেরা
আদালতে গোল্ডস্টেইনের আইনজীবী শিশুদের স্বার্থে তাদের ভারত থেকে না পাঠানোর পক্ষে যুক্তি দেন। তবে ভারত সরকারের আইনজীবী আদালতকে জানান, নিনা নিজেই রুশ দূতাবাসে চিঠি লিখে দেশে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তাই এটিকে 'নির্বাসন' বলা যায় না।
আদালতের নথি অনুযায়ী, রুশ দূতাবাস নিনা ও তাঁর সন্তানদের জন্য ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবরের মধ্যে দেশে ফেরার একটি জরুরি ভ্রমণের সুবিধা দেয়। এরপর কর্ণাটক হাইকোর্ট গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় সরকারকে নিনা ও তার সন্তানদের দেশে ফেরার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ইস্যু করার নির্দেশ দেয়।
বিবিসি হিন্দির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসের (এফআরআরও) একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ২৮ সেপ্টেম্বর নিনা তার দুই মেয়েকে নিয়ে রাশিয়ার উদ্দেশে ভারত ছাড়েন। পরে গোয়ায় বসবাসরত অন্য এক সম্পর্কের সূত্রে জন্ম নেওয়া নিনার কিশোর ছেলেও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
গোল্ডস্টেইন এই আদেশের বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেননি। তার কাছে আপিল করার সুযোগ থাকলেও, রায় তার পক্ষে গেলে শিশুদের ভারতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
ঘটনার পেছনে আইনগত জটিলতাও ছিল। গোয়ায় বসবাসরত ইস্রায়েলি ব্যবসায়ী দ্রর শ্লোমো গোল্ডস্টেইন দাবি করেন, তিনি দুই কন্যার বাবা এবং তাদের ফেরাতে আদালতের মাধ্যমে কাস্টডি চাইছেন। তবে আদালত জানিয়েছে, মা ও কন্যাদের একাকী গুহায় থাকা "বিরক্তিকর" এবং গোল্ডস্টেইন কেন তারা সেখানে ছিলেন তা ব্যাখ্যা করতে পারেননি।
পুলিশ জানিয়েছে, উদ্ধারকালে তাদের সঙ্গে শুধুমাত্র কিছু প্লাস্টিকের ম্যাট, কাপড় এবং সামান্য খাবারের জিনিস ছিল। গুহার ভেতরের পরিস্থিতিও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। নিনা কুতিনা পুলিশের কাছে বলেছিলেন, তিনি ও তার সন্তানরা প্রকৃতির মাঝে জীবনযাপনে খুশি এবং "প্রকৃতি ভালো স্বাস্থ্য দেয়।"
পুলিশের সতর্কবার্তা এবং চিকিৎসা পরীক্ষার পর মা ও কন্যাদের ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হয়। গোল্ডস্টেইনের আইনজীবী দাবি করেছিলেন, ভারত শিশু অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি ও গোয়া চিলড্রেন অ্যাক্ট অনুযায়ী কন্যাদের দেশে ফেরানো উচিত নয়। তবে রাজ্য সরকারের আইনজীবী জানিয়েছেন, এটি ডিপোর্টেশন নয়, কারণ নিনা নিজেই রাশিয়ায় ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। রাশিয়ান দূতাবাসও জরুরি ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছিলেন।