যে কারণে গত ছয় মাসে ব্যাংক খাতে নারী কর্মীর সংখ্যা হঠাৎ কমে গেছে
ব্যাংকখাতে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিতভাবে বাড়লেও চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে হঠাৎ ১,৮৬৭ জন কমে গেছে।
ব্যাংকারদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একাধিক ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার পর স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়ার পাশাপাশি অনেক কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জেন্ডার ইক্যুইটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংকখাতে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫,৭৮২ জন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এ সংখ্যা ছিল ৩৭,৬৪৯ জন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বিশেষায়িত বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিদেশি ব্যাংকে নারী জনবল সামান্য বেড়েছে। তবে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
২০২৫ সালের জুন শেষে এসব ব্যাংকে নারী কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪,০৫০ জন, যা ছয় মাস আগের তুলনায় প্রায় ২,০১৪ জন কম।
ছাঁটাই ও অনিশ্চয়তা দায়ী
এই পতনের জন্য ব্যাপক ছাঁটাই ও স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়াকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংকখাতে মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা (পুরুষ ও নারী) দাঁড়িয়েছে ২,১৩,২৬৭ জন। ছয় মাস আগের তুলনায় এ সংখ্যা কমেছে ৯৮৭ জন।
তবে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে নারী কর্মকর্তার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। গত ছয় মাসে এখানে নারী কর্মকর্তা কমেছে ২,০১৪ জন। বিপরীতে পুরুষ কর্মকর্তার সংখ্যা বেড়েছে ১,১৬৮ জন।
২০২৫ সালের জুন শেষে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে নারীর অংশ দাঁড়িয়েছে ১৬.৬২ শতাংশ, যা ছয় মাস আগের ১৭.৯০ শতাংশ থেকে কম।
আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, গত এক বছরে তাদের ব্যাংক থেকে ৫৪৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিচ্যুত হয়েছেন। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মই এর প্রধান কারণ। চাকরিচ্যুতদের প্রায় ১০ শতাংশ নারী।
তিনি আরও জানান, ইউনিয়ন ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (এফএসআইবি), গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংক থেকেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মকর্তা চাকরি হারিয়েছেন। সর্বমোট ২,০০০ এর বেশি কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা প্রায় ২০০ জন। তবে এত বড় সংখ্যক কর্মকর্তা চাকরি হারানোর পেছনে অন্য কারণও থাকতে পারে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নতুন সরকার আসার পর যেসব ব্যাংক একক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেসব ব্যাংক থেকে অনেক কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন। একই সঙ্গে অনিশ্চয়তার কারণে অনেক কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়েছেন।
তিনি আরও বলেন, "অনিশ্চয়তা থাকায় নারীরা ব্যাংক খাত থেকে অন্য খাতে চলে যাচ্ছেন। পাশাপাশি গত ছয় মাসে নতুন নিয়োগেও নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম।"
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের পরিচালক চৌধুরী লিয়াকত আলী জানান, গত ছয় মাসে বেশ কিছু ব্যাংকের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ধরা পড়েছে। এ কারণে অনেক কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন, একই সময়ে নতুন নিয়োগও কম হয়েছে।
তিনি বলেন, "এই ছয় মাসে প্রায় ২,০০০ নারী জনবল কমে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কেন হঠাৎ এভাবে নারীর সংখ্যা কমে গেল তা বিশ্লেষণের জন্য আমরা একটি গবেষণা টিম গঠন করবো।"
একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ডিএমডি টিবিএসকে বলেন, "শুধু বোর্ড ভাঙা ব্যাংকেই নয়, বিভিন্ন সূচকে শীর্ষে থাকা ব্যাংকগুলোতেও ব্যাপক হারে চাকরিচ্যুতি হচ্ছে।"
ব্যাংকের বিভিন্ন পদে বয়সভেদে নারী কর্মীদের অংশগ্রহণ
২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংকের বোর্ড সদস্য পদে নারীর অংশগ্রহণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৩.৬১ শতাংশ। এর মধ্যে বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকে নারীর অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি ১৭.৫৪ শতাংশ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে সবচেয়ে কম ৬.২৫ শতাংশ।
প্রারম্ভিক পর্যায়ে নারীর উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি। এ পর্যায়ে অংশগ্রহণের হার ১৮.৮৭ শতাংশ। মধ্যম পর্যায়ে এ হার ১৫.৯৬ শতাংশ হলেও উচ্চ পর্যায়ে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯.৭৩ শতাংশ।
তফসিলি ব্যাংকগুলোতে বয়সভেদেও নারীর অংশগ্রহণে বড় ফারাক দেখা গেছে। ৫০ বছরের বেশি বয়সী নারী কর্মকর্তাদের হার ১০.৩৬ শতাংশ, যেখানে ৩০ বছরের কম বয়সী নারী কর্মকর্তাদের হার ২১.৯০ শতাংশ।
তবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিদেশি ব্যাংকগুলোতে নারী কর্মীদের চাকরি পরিবর্তনের হার (এমপ্লয়ী টার্নওভার) রাষ্ট্রায়ত্ত, বিশেষায়িত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের তুলনায় অনেক বেশি।
