শি’র সাথে একই মঞ্চে পুতিন-কিম: কুচকাওয়াজে পশ্চিমকে সামরিক সক্ষমতার জানান দিল চীন
ছয় বছর পর আজ (৩ সেপ্টেম্বর) চীনের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে জাপানের আত্মসমর্পণের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান ঘিরে পুরো শহরজুড়েই যেন সাজ সাজ রব।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আয়োজনে এই কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তের শীর্ষ নেতারা। ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনও। কিমের জন্য এটি ২০১৯ সালের পর প্রথম চীন সফর।
চীনা রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সিসিটিভি অনুযায়ী, প্রায় ৫০ হাজার মানুষের সমাগম হয়েছে এ অনুষ্ঠানে।
বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টায় চীনের জাতীয় সঙ্গীত ও শি জিনপিং-এর বক্তব্যের মাধ্যমে শুরু হয় এ কুচকাওয়াজ। ভাষণে শি জিনপিং বলেছেন, বিশ্ব এখন শান্তি নাকি যুদ্ধ—এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
তিনি বলেন, চীনের জনগণ ইতিহাসের সঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে এবং শান্তি রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। শি জোর দিয়ে বলেন, চীনের সামরিক বাহিনী সর্বদা কমিউনিস্ট পার্টি ও জনগণের প্রতি বিশ্বস্ত।
তিনি আরও বলেন, চীন একটি মহান, অপ্রতিরোধ্য শক্তি, যা কোনো হুমকিকে ভয় পায় না। স্বনির্ভর ও শক্তিশালী এ দেশের জনগণ ও সামরিক বাহিনী একযোগে কাজ করে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ করবে।
শি আশা প্রকাশ করেন, পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) চীনের মহান পুনর্জাগরণের জন্য কৌশলগত সহায়তা প্রদান করবে এবং বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নে আরও বড় অবদান রাখবে।
এরপর শি জিনপিং তিয়ান'আনমেন স্কয়ারে সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার সেনাদের পরিদর্শন করেন। তিনি তার কালো রঙের হংচি গাড়িতে দাঁড়িয়ে সেনাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন।
শি প্রথমে বলেন, 'কমরেডস, কেমন আছো?' সেনারা জবাব দেয়, 'চেয়ারম্যান, ভালো আছি!' এরপর শি বলেন, 'তোমাদের কষ্টের জন্য ধন্যবাদ।' জবাবে সেনারা বলে ওঠে, 'জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকা আমাদের দায়িত্ব!'
সামরিক মহড়ায় নতুন প্রযুক্তি প্রদর্শন করছে চীন। এর মধ্যে রয়েছে স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, একাধিক রকেট নিক্ষেপ ব্যবস্থা এবং মানববিহীন যুদ্ধবিমান বা স্টেলথ ড্রোন প্রদর্শিত হয়েছে। এছাড়া দেখা গেছে হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল, ওয়াইজে-২১ অ্যান্টি-শিপ ক্রুজ মিসাইল এবং জেএল-৩ সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ব্যালিস্টিক মিসাইল।
সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি কাড়ে নতুন ডংফেং-৫সি আন্তঃমহাদেশীয় পারমাণবিক ব্যালিস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম)।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আলেকজান্ডার নিলের মতে, এ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা দীর্ঘ এবং একসঙ্গে ১২টি ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম। এটি দুই ধাপবিশিষ্ট তরল জ্বালানি চালিত ক্ষেপণাস্ত্র, যা ভূগর্ভস্থ সাইলো থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। কৌশলগত প্রতিরোধ হিসেবেই এটি তৈরি করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক কৌশলবিষয়ক গবেষণা সংস্থা আইআইএসএস-এর চায়না প্রোগ্রামের প্রধান মেইয়া নুভেন্স মনে করেন, কুচকাওয়াজে প্রদর্শিত প্রযুক্তি ভবিষ্যতে তাইওয়ান আক্রমণের কোনো ইঙ্গিত দেয় কি না, তা গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হবে। তবে তিনি বলেন, 'সেনাবাহিনীকে কার্যকর করে তুলতে কেবল অস্ত্রশস্ত্রই যথেষ্ট নয়। এর পেছনে রয়েছে মতবাদ, কৌশল এবং বাহিনীগুলোর পারস্পরিক সমন্বয়, যা কোনো কুচকাওয়াজে দৃশ্যমান হয় না।'
চমক দেয়া আরেকটি অস্ত্র হলো ডংফেং-৬১ ক্ষেপণাস্ত্র। এটি আংশিক কক্ষপথে গিয়ে হাইপারসনিক অস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারে। বিশ্লেষক নিল জানান, এই ক্ষেপণাস্ত্রের বিশেষত্ব হলো এর গতিশীলতা। এটি রাস্তা থেকেই সরাসরি মোতায়েনযোগ্য এবং ট্রান্সপোর্ট-ইরেক্টর-লঞ্চার (টিইএল) এর মাধ্যমে সহজে গোপন রাখা যায়।
তিনি যোগ করেন, এটি দ্রুত জ্বালানি ভরে বিভিন্ন স্থান থেকে নিক্ষেপ করা সম্ভব, যা শত্রুর জন্য অবস্থান অনুমান করা কঠিন করে তুলবে।
চীনের স্টেট কাউন্সিল জানিয়েছে, ভি-ডে উদযাপনে ২৬ জন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাদের মধ্যে উপস্থিত রয়েছেন ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট লুয়ং কুয়াং, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান, জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট এমারসন মানানগাগওয়া, সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার ভুচিচ, স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকো, কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগেল দিয়াজ-কানেল এবং মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মিন অং হ্লাইং।
তবে এ জমকালো আয়োজনে অনুপস্থিত রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশালে পোস্ট দিয়ে অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান স্মরণ করার আহ্বান জানান।
ট্রাম্প লেখেন, 'চীনের স্বাধীনতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিশাল সমর্থন দিয়েছে, অসংখ্য আমেরিকান প্রাণ দিয়েছে। আশা করি তাদের সাহস ও ত্যাগকে যথাযথভাবে স্মরণ করা হবে।'
এছাড়া পুতিন ও কিমকে একহাত নিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি লিখেছেন, 'ভ্লাদিমির পুতিন ও কিম জং উন যখন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, তখন তাদের প্রতি আমার উষ্ণ শুভেচ্ছা রইল।'
তিনি আরও যোগ করেন, 'প্রেসিডেন্ট শি এবং চীনের অসাধারণ জনগণের জন্য দীর্ঘস্থায়ী উৎসবমুখর দিন কামনা করছি।'
ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও বলেছেন, চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন একটি 'মার্কিন বিরোধী জোট' তৈরি হওয়া নিয়েও তিনি 'একেবারেই শঙ্কিত নন'।
আজকের বেইজিং কুচকাওয়াজে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রথমবারের মতো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান-এর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। ওয়াশিংটনের কৌশলবিদরা সতর্ক করেছেন, এই নেতারা একত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তৈরি করতে পারে।
তবে সেই ধারণা নাকচ করে দিয়ে স্কট জেনিংস শো-তে মঙ্গলবার ট্রাম্প বলেন, 'আমরা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী পেয়েছি। তারা কখনো আমাদের ওপর সামরিক অভিযান চালাবে না, বিশ্বাস করুন। এটি তাদের করার শেষ কাজ হবে।'