বিশ্ববাজারে চালের দাম ৮ বছরে সর্বনিম্ন, তবু দেশে চালের দাম বাড়ছে কেন

বিশ্ববাজারে চালের দাম গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। অথচ বাম্পার ফলন, উচ্চ আমদানি ও সরকারি গুদামে পর্যাপ্ত চাল মজুত থাকার পরও—বাংলাদেশে তা ক্রমেই বাড়ছে। ফলে দেশের প্রধান খাদ্যশস্যের খুচরা পর্যায়ে রেকর্ড চড়া দাম, সম্ভবত সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে বিদ্যমান। আর এর সঠিক কারণ কারও জানা নেই।
গত বছরের আগস্ট থেকে দফায় দফায় চালের দাম বেড়েছে, এমনকি আমন ও বোরো মৌসুমের প্রাচুর্যের সময়েও। ফলন, আমদানি ও সরকারি মজুত ভালো থাকা সত্ত্বেও এখন ভোক্তাদের প্রতি কেজি চাল কিনতে হচ্ছে গত বছরের তুলনায় ৫–১৭ টাকা বেশি দামে। এই চাপ মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে নিম্নআয়ের মানুষের ভোগান্তির কারণ হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এমন অবস্থার পেছনে মূলত দায়ী বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা। যেমন কৃষকরা ধান কেটে বিক্রি করেন কম দামে, কিন্তু মিলার ও মজুতদারেরা বাজারে সরবরাহ আটকে দিয়ে দ্রুত দাম বাড়িয়ে দেন। অভিযোগ রয়েছে, বড় করপোরেট মিলগুলোর বিরুদ্ধে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা বিপুল পরিমাণ ধান কিনে পরে চালের দামে বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে এসব কোম্পানি অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, চাল মজুত করে রাখার সময় বেশি না, আর মুনাফা-ও সীমিত।
'অনির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে ভুল সিদ্ধান্ত'
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন জানান, সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির ঝুড়িতে চালের অংশ প্রায় এক-দশমাংশ, কিন্তু দরিদ্র পরিবারের জন্য এই অংশ অনেক বেশি।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "আসলে মূল সমস্যাই হলো অনির্ভরযোগ্য তথ্য। আমাদের বলা হয় আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, অথচ প্রচুর খাদ্যশস্য প্রতিবছরই আমদানি করছি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পুরনো পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করে, ফলে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তা সঠিকভাবে তুলে ধরে না। উৎপাদন থেকে বাজার পর্যন্ত সরবরাহ শৃঙ্খলের বিভিন্ন স্তরে চাঁদাবাজিও দাম বাড়িয়ে দেয়।"
কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম মনে করেন, ফসল উৎপাদনের তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলা হয়। তিনি বলেন,"যদি ফলন ও আমদানির রেকর্ড হয়, তাহলে তো ঘাটতি থাকার কথা না। আবার যদি সরবরাহ ভালো থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই বেসরকারি লেভেলে মজুতদারি করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সরকারের তো আইন রয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু তা করা হয় না।"
সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে প্রতিবছরই বাংলাদেশ চাল আমদানি করে থাকে। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি পুরোপুরি বন্ধ থাকার ফলে গত নভেম্বরে সরকারি মজুত নেমে আসে ৬.৫ লাখ টনে। যা ১৫ দিনের জাতীয় চাহিদা বা সাড়ে ১২ লাখ টন নিরাপদ মজুতের তুলনায় অনেকটাই কম।

পরবর্তীতে আমদানি পুনরায় শুরু হয়ে চলতি বছরের জুলাইয়ে মজুত রেকর্ড ১৯.১৭ লাখ টনে পৌঁছায়, তবু বাজারে দাম কমেনি।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, "মজুত ওই পর্যায়ের নিচে নামলেই মিল মালিকরা বুঝে যায় এখন সরকারের দর-কষাকষির ক্ষমতা দুর্বল।"
কিন্তু গত বছরের নভেম্বর থেকে ফের আমদানি শুরু হওয়া এবং রেকর্ড ফলনের পরও চালের দাম কমেনি, অথচ এ সময়ে সরকারের মজুতও বাড়তে বাড়তে এবছরের জুলাইয়ে প্রায় ২০ লাখ টনে পৌঁছেছে।
দাম কেন উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, চালের দাম এখন এক বছর আগের তুলনায় ১৫–২০ শতাংশ বেশি, আর ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের সাথে তুলনা করলে বর্তমানে ১৫ থেকে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বেশি চালের দাম।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, এ বছরের বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ২৬ লাখ টন, আর আমন মৌসুমে হয়েছে ১ কোটি ৬৫ লাখ টন। এমনকি আগের বছরের আমন ও বোরোর মোট উৎপাদনের চেয়ে এবার প্রায় ১৩ লাখ টন বেশি চাল উৎপাদন হয়েছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে চাল আমদানি করা হয় ১৪ লাখ ৩৬ হাজার টন—যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
তারপরও বাজারে সরবরাহ আঁটসাঁট। কিছু বিশ্লেষকের মতে, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে আমদানি বন্ধ থাকায় সরকারি মজুত কমে যাওয়ার কারণেই মিল মালিকদের দাম বাড়াতে উৎসাহ দেয়।
ট্যারিফ কমিশনের তথ্যমতে, দেশের বার্ষিক চালের চাহিদা ৩ কোটি ৫০ লাখ টন থেকে ৩ কোটি ৮০ লাখ টনের মধ্যে। এর মধ্যে দেশের ধান উৎপাদনের প্রায় ৫৫ শতাংশ হয় বোরো মৌসুমে।
নিম্নবিত্তের সংসার খরচে চাপ
রাজধানীর গুলশানে একটি বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন জাহিদুল ইসলাম। ছেলেকে নিয়ে তিনি শাহজাদপুরের একটি মেসে থাকেন। আর তার স্ত্রী ও অন্য দুই সন্তান গ্রামের বাড়িতে। নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সংসারের খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "চালের দাম এতো বাড়তে আমি কখনো দেখিনি। অন্যান্য সময় দাম বাড়তো, আবার কমে যাইতো। কিন্তু উৎপাদন ভালো হওয়ার পরেও আমাদের এতো বেশি দামে কেন কিনে খেতে হচ্ছে। বাড়তি এ টাকা কার পকেটে যাচ্ছে?"
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপে উঠে এসেছে যে, খাদ্যের পেছনে মোট জাতীয় ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশ ব্যয় হয় চাল কিনতে। যদিও এটা গড়হার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে এটা প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি।
চালের বাজারে করপোরেটদের আধিপত্য ও প্রভাব অস্বীকার
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, বিপুল মজুতের সক্ষমতা আছে করপোরেট মিলগুলোর, বাজার এখন তাদেরই দখলে। "প্রতি কেজিতে দাম ১ টাকা বাড়লেই ব্যবসায়ীরা দিনে ১০ কোটি টাকা অতিরিক্ত লাভ করে"- বলেন ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসেন।
চালের বাজার মূলত এখন করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, "তারা কৃষকের থেকে চাল কিনে এরপরের সপ্তাহ থেকেই দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। একারণে গত কয়েক মৌসুমে—ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়েছে। সরকার এগুলো ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে।"
নওগাঁ জেলা রাইস মিল মালিক গ্রুপের জেনারেল সেক্রেটারি ফারহাদ হোসেন চোকদার বলেন, "ছোট মিলগুলো বাজারের দামে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে না। সরকার সব জানে—ধানের দাম, কারা মজুত করছে, কতটা করছে। এ বছর ধানের দাম বেশি ছিল, তাই চালের দামও বেশি আছে।"
তিনি আরও জানান, সাধারণত যে মজুত থাকে, ছোট মিলগুলো তার তুলনায় অন্তত ৩০ শতাংশ কম চাল মজুত রাখতে পেরেছে, কারণ বড় কোম্পানিগুলোর মজুত ক্ষমতা অনেক বেশি। "একটি বড় কোম্পানির একটি মিলের মজুত ক্ষমতা ৫০টি অটো-রাইস মিলের সমান। এদিকে ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় ছোট ছোট অনেক মিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।"
এসিআই এবং প্রাণের মতো বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীও বহুদিন ধরে চালের ব্যবসায় রয়েছে, আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন করে সিটি গ্রুপ, রূপচাঁদা ও মেঘনা গ্রুপ চালের বাজারে প্রবেশ করেছে।
তবে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। প্রাণ–আরএফএলের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, "এ বছর ধানের দাম বেশি ছিল, বিশেষ করে মৌসুমে যখন সবাই কিনছিল, তখনই দাম বেড়েছে। নষ্ট হওয়া ছাড়া চাল দুই থেকে তিন মাসের বেশি রাখা যায় না। আমরা নিয়মিতভাবে সরকারের সঙ্গে আমাদের মজুতের তথ্য শেয়ার করি।"
সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে
খাদ্যসচিব মো. মাসুদুল হাসান বলেন, চালের দাম বাড়ার পেছনে মৌসুমি ভারী বৃষ্টিপাতেরও প্রভাব রয়েছে। সরকার ১০ আগস্ট থেকে টিসিবির মাধ্যমে খোলা বাজারে চাল বিক্রি শুরু করেছে, পাশাপাশি ১৭ আগস্ট থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালু হবে। এ বছর মাত্র ১৫ টাকা দরে ৫৫ লাখ পরিবার ছয় মাস ধরে মাসে ৩০ কেজি চাল পাবেন।
খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, উৎপাদন খরচ বেড়েছে, তবে সরকার এখনও প্রতি কেজি চাল উৎপাদনে প্রায় ২৫ টাকা করে ভর্তুকি দিচ্ছে। "খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি সহায়ক হবে, কিন্তু খোলা বাজারের দাম কমানো কঠিন"- বলেও স্বীকার করেন তিনি।
- টিবিএসের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি মো. মাসুদ এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন