এইচএস কোডের অসঙ্গতিতে পণ্য আটকে থাকার ভোগান্তিমুক্ত হলেন রপ্তানিকারকরা

বন্দরের কাস্টমসে এইচএস (হারমোনাইজড সিস্টেম) কোডের আট সংখ্যার সঙ্গে সামান্য অসঙ্গতি থাকলেই বিরাট মুসিবতে পড়তে হয় রপ্তানিকারকদের। এতে দিনের পর দিন তাদের আমদানিকৃত কাঁচামাল আটকে থেকেছে, কখনোবা শূন্য শুল্কের আমদানি পণ্যে আরোপিত হয়েছে ২০০ শতাংশ জরিমানা। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের এক নিট পোশাক রপ্তানিকারকের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে—শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টে গিয়েও সমাধান মিললেও ততোদিনে বিদেশি বায়ার রপ্তানির অর্ডারই বাতিল করে দেয়।
অবশেষে ব্যবসায়ীদের এ ধরনের ভোগান্তি ও ক্ষতি থেকে মুক্তি দিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কাস্টমস কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে, বন্ডেড সুবিধার আওতায় রপ্তানিমুখী শিল্পের শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে এইচএস কোডের সামান্য অসঙ্গতি উপেক্ষা করতে হবে।
এনবিআরের এই নির্দেশনাকে স্বাগত জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এখন কাস্টমসের হয়রানি অনেকাংশেই কমে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হলো। ফলে কাস্টমসে অকারণে পণ্য আটকে থাকবে না, সময়মতো রপ্তানিও সম্পন্ন করা যাবে।
গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে এনবিআর জানায়, বন্ড লাইসেন্সধারী কোম্পানির কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে যদি এইচএস কোডের মূল অংশ (প্রথম চার সংখ্যা) সঠিক থাকে, তবে শেষের সংখ্যায় অমিল থাকলেও কাস্টমস চালান আটকাতে পারবে না। কোনো ত্রুটি থাকলে তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংশোধন করতে হবে এবং কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করবে।
ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে কাস্টমসে হয়রানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এনবিআর কর্মকর্তারাও একই কথা বলছেন। তারা বললেন, কাস্টমস সংক্রান্ত মামলার ৯০ শতাংশই হয় এইচএস কোড সংক্রান্ত বিষয়ে। ফলে ভবিষ্যতে মামলার সংখ্যাও কমে যাবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান টিবিএসকে বলেন, "ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বড় অভিযোগ ছিল এইচএস কোড নিয়ে আমদানিকারক ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের মতবিরোধের কারণে পন্য ক্লিয়ারিংয়ে দেরি হওয়া এবং খরচ বেড়ে যাওয়া নিয়ে। নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে কোনভাবেই রপ্তানিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল আটকে রাখা না হয়।"
তিনি বলেন, "এইচএস কোড নিয়ে কোনো মতপার্থক্য দেখা দিলে আমদানিকারক অঙ্গীকারনামা/ দিয়ে তা ক্লিয়ার করে নেবেন। এরপর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা কারেকশন করবেন। এইচ এস কোডের প্রথম চার ডিজিটে ভুল থাকলেও ওই চালান আটকে রাখা যাবে না।"
অবশ্য একইসঙ্গে তিনি ব্যবসায়ীদেরও নিয়ম মানার আহ্বান জানিয়ে বলেন, "দেশের আমদানি-রপ্তানিসহ ব্যবসায়ে গতি আনা এবং জটিলতা কমানোর স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেউ যদি এর মিসইউজ করেন, তাহলে আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে 'এক্সট্রিম পানিশমেন্ট' হবে।"
রাজস্ব বোর্ডের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান–স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, "দেশের এমন কোনো পোশাক রপ্তানিকারক নেই, যারা এইচএস কোডের হয়রানির মুখে পড়েননি এবং এনিয়ে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা নেই। এনবিআরের এই নির্দেশনা আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। এই সিদ্ধান্তে আমরা অত্যন্ত খুশি" –বলেন তিনি।

এনবিআরের নির্দেশনার মূল পয়েন্ট
বন্ড লাইসেন্সে অন্তর্ভুক্ত পণ্যের বর্ণনা ও এইচএস কোড অনুযায়ী আমদানিকৃত পণ্যের ঘোষণা দেওয়ার পর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ভিন্ন এইচএস কোড নির্ধারণ করলে প্রতিষ্ঠানটি কাস্টমস বন্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিবিএমএস)-এর মাধ্যমে সেই এইচএস কোড প্রাপ্যতায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। তবে বন্ড লাইসেন্সে অন্তর্ভুক্ত এইচএস কোড-এর প্রথম চার সংখ্যার সঙ্গে নিরূপিত এইচএস কোড-এর প্রথম চার সংখ্যার মিল থাকতে হবে।
এসব ক্ষেত্রে আমদানিকারককে ৩০ দিনের মধ্যে বন্ড লাইসেন্সে এইচএস কোড বা পণ্যের বর্ণনা সংশোধনের জন্য একটি অঙ্গীকারনামা দিতে হবে। অঙ্গীকারনামা জমা দেওয়ার পর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই চালান আটকে রাখতে পারবে না।
এ ছাড়া বন্ডধারী প্রতিষ্ঠান চাইলে কাস্টমস বন্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিবিএমএস) এর মাধ্যমে নিজেদের অধিকারভুক্ত তালিকায় এইচএস কোড হালনাগাদ করে সর্বোচ্চ দুই দিনের মধ্যেই পণ্য ছাড় করাতে পারবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান আরও জানান, কাস্টমস বন্ড ব্যবস্থা এখন পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় হওয়ায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এ ধরনের সংশোধন বা সংযোজন করা সম্ভব হবে।
সরাসরি উপকৃত হবে ৮৫ শতাংশ রপ্তানিকারক
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৪৪.৪৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।
রপ্তানিকারক ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশ বন্ড লাইসেন্সধারীদের মাধ্যমে হয়ে যাকে, যার মধ্যে অন্যতম হলো তৈরি পোশাক খাত। দেশে বর্তমানে তিনটি কাস্টমস বন্ড কমশিনারেট -এর আওতায় সক্রিয় বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার।
বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলো নির্দিষ্ট গুদামে রেখে পণ্য তৈরি করে রপ্তানির শর্তে সব ধরণের কাঁচামাল ও এক্সেসরিজ শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানির সুযোগ পায়; যার উপর ৩০ থেকে ৯০ শতাংশ বা তারও বেশি হারে আমদানি শুল্ক প্রযোজ্য। রপ্তানি না করে বাইরে বা খোলাবাজারে বিক্রি করতে হলে এই পরিমাণ শুল্ককর পরিশোধ করতে হবে।
অভিযোগ রয়েছে, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে অনেক রপ্তানিকারক বা রপ্তানিকারকের নাম ব্যবহার করে কিছু কোম্পানি শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করে তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দেয়। এতে একদিকে সরকার যেমন রাজস্ব হারায়, অন্যদিকে একই পণ্যের স্থানীয় উৎপাদনকারীরা অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে।
মূলত এজন্যই বন্ডেড পণ্যের আমদানিতে অনিয়ম রোধে কড়াকড়ি আরেপ করে থাকে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। তবে রপ্তানিকারকরা বলছেন, যারা অনিয়ম করার— তারা ঠিকই কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলে অনিয়ম করেন, তাদের কোনও সমস্যা হয় না। কিন্তু প্রকৃত রপ্তানিকারকরা হয়রানির মুখে পড়েন।
তারা আরও জানান, কাস্টমস কর্মকর্তাদের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ না দিলে, কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা তাদের কর্তৃত্ব দেখানোর জন্য ছোটখাট ভুলের জন্যও প্রকৃত রপ্তানিকারকদের হয়রানির মুখে ফেলেন।
রপ্তানিকারকরা হয়রানির শিকার হন যেভাবে
বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ রপ্তানি আদেশ পাওয়ার পর যে পরিমাণ কাঁচামাল ও এক্সেসরিজ প্রয়োজন হবে, তা তাদের নিজ নিজ খাতের ব্যবসায়ী সমিতির মাধ্যমে ইউটিলিটি ডিক্লারেশন (ইউডি) বা আমদানির প্রাপ্যতা ঘোষণা দিয়ে, ওই পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করে থাকেন।
যেকোন পণ্যের পরিচিতির জন্য এইচএস কোড ব্যবহার হয়, যাতে আট ডিজিট থাকে। এর মধ্যে প্রথম চার সংখ্যা পণ্যের শ্রেণিবিন্যাসের জন্য, অর্থাৎ এটি কাপড়, তুলা নাকি বোতাম তা বোঝার জন্য। পরবর্তী চার সংখ্যা হলো পণ্যের শ্রেণিকে আরো সুনির্দিষ্ট করার জন্য, অর্থাৎ কাপড় বা ফেব্রিকের ক্ষেত্রে কোন ধরণের সুতার মিশ্রণ কত শতাংশ থাকবে—সেটি বোঝার জন্য।
সাধারণত শেষদিকের সংখ্যাগুলো নিয়েই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কাস্টমস কর্মকর্তাদের মতবিরোধ হয়।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ-ভিত্তিক একটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ৯৮ হাজার ডলারের একটি আমদানি চালান আটকে দেন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের কর্মকর্তারা, এইচএস কোড সঠিক নয় দাবি করে। গড়মিল ছিল আট ডিজিটের শেষ ডিজিটে, অর্থাৎ আমদানিকারক এইচএস কোড উল্লেখ করেছেন ৫৪০৮। কিন্তু কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বললো, এটা হবে ৫৪০৭।
বিকেএমইএ-র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএস-কে বলেন, "দুটিই ম্যান মেড ফাইবার, ফেব্রিকে তেমন পার্থক্য নেই। একটি পলিয়েস্টার স্টেপল ফিলামেন্ট, আর অন্যটি রেয়ন স্টেপল ফিলামেন্ট। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ চাইলে ওই চালান ছেড়ে দিতে পারতেন, কারণ বন্ড লাইসেন্স এর আওতায় ওই পন্য এসেছে – যেহেতু এ থেকে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি হবে। কিন্তু চালানটি আটকে রাখা হলো দুই মাস।"
কাস্টমস কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগের পরও চালান ছাড়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত ২০০ শতাংশ জরিমানা ধার্য করা হয় — অর্থাৎ ১ কোটি ১০ লাখ টাকার চালানকে ২ কোটি ২০ লাখ টাকার জরিমানার মুখে ফেলা হয়, এবং পুরো অর্থ পরিশোধের শর্তে ছাড় দেওয়ার নির্দেশ দেয় কাস্টমস।
এমনকি এনবিআর চেয়ারম্যানকে অবহিত করার পর পুনর্বিবেচনার আবেদন জানানো হলেও আমদানিকারককে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনারের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। পণ্যগুলো আটকে থাকে। শেষপর্যন্ত হাইকোর্টে রিট করে সেখান থেকে আদেশ নিয়ে ওই কাঁচামাল খালাস করতে হয় কারখানা মালিককে।
হাতেম বললেন, "ওই অর্ডার অলরেডি ক্যান্সেল হয়ে গেছে।"
২০২২ সালে নিজের এমন একটি অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে স্প্যারো গ্রুপের শোভন ইসলাম বলেন, "আমরা যুক্তরাজ্যভিত্তিক বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ব্র্যান্ড এর উইমেন লিনেন প্যান্টস এর পণ্য তৈরি করি। ম্যান মেড ফাইবারের মিশ্রণের একটি ফেব্রিকের চালান আটকে দেওয়া হয় সামান্য হেরফেরের জন্য।
"এজন্য আমাকে দেড় মাস ঘুরতে হয়েছে। এমনকি ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে কনসাইনমেন্ট ক্লিয়ার করতে চাইলেও তারা অনুমোদন দেয়নি" –জানিয়ে তিনি বলেন, "এর ফলে বড় অঙ্কের পোর্ট ডেমারেজ এবং ক্রেতার কাছে ক্রেডিবিলিটি নষ্ট হয়েছে।"