মাস্কের নির্দেশে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে বন্ধ হয়েছিল স্টারলিংক সেবা

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ইউক্রেন যখন কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ খেরসনসহ রুশ অধিকৃত অঞ্চল পুনর্দখলের সিদ্ধান্তমূলক অভিযানে নামে, ঠিক তখনই এক নাটকীয় সিদ্ধান্ত নেন মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ক—স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবার কভারেজ বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। ফলে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী হঠাৎ করেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, এবং ব্যাহত হয় পুরো অভিযানের ছক।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সের বিশেষ এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই চিত্র।
স্টারলিংকের উপর নির্ভরশীল ছিল ইউক্রেনের সামরিক যোগাযোগ, ড্রোন নজরদারি ও দূরপাল্লার আর্টিলারি হামলা।
রয়টার্সের অনুসন্ধান অনুযায়ী, স্পেসএক্সের ক্যালিফোর্নিয়া অফিসে মাস্কের ঘনিষ্ঠ এক জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী মাইকেল নিকলসকে তিনি নির্দেশ দেন, যেন খেরসনসহ ইউক্রেনীয় অগ্রযাত্রার মুখে থাকা অঞ্চলগুলোতে স্টারলিংকের কভারেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অন্তত ১০০টিরও বেশি টার্মিনাল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
এই ঘটনার ফলে, ইউক্রেনের সেনারা রুশ বাহিনীর ঘাঁটি ঘিরে ফেলতে পারেনি, বেরিসলাভ শহরে অভিযান পুরোপুরি ব্যর্থ হয়, যা খেরসন অঞ্চলের পূর্ব দিকে অবস্থিত।
"ঘেরাও পরিকল্পনা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে," এক সামরিক কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান।
পরে ইউক্রেন অবশ্য শহরটি পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়, কিন্তু এই প্রথমবার প্রকাশ্যে এল, একজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতায় কীভাবে প্রভাব ফেলেছেন।
মাস্কের বিবৃতির সঙ্গে বিপরীত তথ্য
ইউক্রেনের অভিযানের সময় স্টারলিংকের সেবা বন্ধের বিষয়ে ইলন মাস্ক সামাজিক মাধ্যম 'এক্স' (সাবেক টুইটারে) আগে জানিয়েছিলেন, "আমরা এমন কিছু কখনও করিনি।" কিন্তু এই অনুসন্ধান তার সেই দাবি সম্পূর্ণ খণ্ডন করছে।
স্পেসএক্স কর্তৃপক্ষ রয়টার্সকে পাঠানো এক ইমেইলে এ প্রতিবেদনকে "ভুল তথ্যভিত্তিক" বলে দাবি করলেও বিস্তারিত কিছু জানায়নি।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির দপ্তর ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
নিউক্লিয়ার আতঙ্ক থেকেই মাস্কের সিদ্ধান্ত?
মাস্কের এই সিদ্ধান্ত কেন এসেছিল, তা নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও, তিনজন ঘনিষ্ঠ সূত্রের মতে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে ইউক্রেনীয় অগ্রগতি রাশিয়াকে পারমাণবিক প্রতিক্রিয়ায় উসকে দিতে পারে।
এই আশঙ্কা তখন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মধ্যেও ছিল।
গভীরতর প্রশ্ন: এক ব্যক্তির হাতে বৈশ্বিক নিরাপত্তা?
স্টারলিংক এখন বিশ্বব্যাপী ৭,৯০০টিরও বেশি স্যাটেলাইট পরিচালনা করে, এসব স্যাটেলাইট উপবৃত্তাকারে পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরছে। এর মাধ্যমে এককভাবে স্পেসএক্স বিশ্বে সবচেয়ে বড় স্যাটেলাইট অপারেটর।
একজন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য মার্থা লেন ফক্স বলেছেন, "স্টারলিংকের নিয়ন্ত্রণ কেবল মাস্কের হাতে—এটি গভীর উদ্বেগজনক।"
নাসার সাবেক উপপ্রশাসক লরি গারভার বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে মাস্কের ওপর এত নির্ভরতা আর চলতে পারে না। চুক্তিগত নিশ্চয়তা দরকার যে, তিনি একতরফাভাবে সেবা বন্ধ করে দিতে পারবেন না।"
আরও উদ্বেগ: ইউক্রেন যুদ্ধেই নয়, ভূরাজনীতিতে মাস্কের শাসন
কিছুদিন আগেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ পরামর্শক থাকা মাস্ক এখন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও এক শক্তিধর খেলোয়াড়। তিনি নতুন রাজনৈতিক দল 'আমেরিকা পার্টি' গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন, বাইডেন প্রেসিডেন্ট থাকার সময় তাঁর ব্যয় পরিকল্পনা নিয়ে খোলা চিঠিতে সমালোচনা করেছেন এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে হুমকিও দিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে—একটি ব্যক্তিগত প্রযুক্তি কোম্পানি এবং তার প্রতিষ্ঠাতার হাতে যুদ্ধক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ, জাতির নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা তুলে দেওয়া কি যৌক্তিক?
একটিমাত্র সিদ্ধান্তে বিশ্বব্যবস্থার ভারসাম্য
ইউক্রেনে স্টারলিংকের ভূমিকা ছিল অবিশ্বাস্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ড্রোন নিয়ন্ত্রণ, রিয়েলটাইম গোয়েন্দা তথ্য, ট্যাংক কিংবা আর্টিলারির লক্ষ্য নির্ধারণ—সবকিছুই নির্ভর করেছে এই স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের ওপর।
রাশিয়ার সাইবার হামলার মধ্যে যখন অন্য স্যাটেলাইট সেবা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন স্টারলিংকই ছিল একমাত্র বিকল্প।
২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত, ইউক্রেন ৫০ হাজারেরও বেশি স্টারলিংক টার্মিনাল পেয়েছে, যার অনেকগুলো সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং পোল্যান্ডের মতো পশ্চিমা মিত্ররা।
প্রযুক্তি যখন ভূরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু
এই পুরো ঘটনা একটি প্রশ্নের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়: বিশ্ব কি একটি ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করতে পারে, বিশেষ করে যখন তা যুদ্ধ, শান্তি কিংবা পারমাণবিক উত্তেজনার মতো বিষয় নির্ধারণ করে?
বিশ্ব যখন প্রযুক্তিনির্ভরতার দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তখন প্রয়োজন নতুন ভাবনা—যাতে প্রযুক্তির ব্যবহারে থাকে আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ।