২০২৫ কেন বিলিয়নিয়ারদের জন্য ইতিহাসের ‘সবচেয়ে সেরা সময়’ ছিল
গেল ৭ অক্টোবরের ঘটনা। নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের মূল প্রতিষ্ঠান যখন 'পলিমার্কেট' নামের একটি স্টার্টআপে ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিল, তখন প্রতিষ্ঠানটির মোট বাজারমূল্য দাঁড়াল ৯০০ কোটি ডলারে।
এই বিশাল বিনিয়োগ পাঁচ বছর বয়সী প্রতিষ্ঠানটির জন্য ছিল এক বড় জয়। আর মাত্র ২৭ বছর বয়সেই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা শেইন কোপল্যান্ড বনে যান বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী 'সেলফ মেইড' বিলিয়নিয়ার।
কিন্তু শেইনের এই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। মাত্র ২০ দিনের মাথায়, ২৭ অক্টোবর সব হিসাব-নিকাশ ওলটপালট করে দেয় এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা স্টার্টআপ 'মার্কর'। নামী বিনিয়োগকারীদের অর্থের প্রবাহে মার্করের বাজারমূল্য মুহূর্তেই ১ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। আর তাতেই ইতিহাস গড়েন মার্করের তিন সহপ্রতিষ্ঠাতা। ২২ বছর বয়সী এই তিন তরুণ একলাফে হয়ে যান ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়সী সেলফ-মেইড বিলিয়নিয়ার।
২০০৮ সালে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ ২৩ বছর বয়সে বিলিয়নিয়ার হয়ে যে রেকর্ড গড়েছিলেন, এই তিন তরুণ তা ভেঙে দিলেন এক বছর আগেই।
নারীদের আঙিনাতেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই
রেকর্ড ভাঙা-গড়ার এই লড়াই চলছে নারীদের আঙিনাতেও। এত দিন 'সর্বকনিষ্ঠ সেলফ-মেইড নারী বিলিয়নিয়ার'-এর মুকুট ছিল পপ তারকা টেলর সুইফটের দখলে। কিন্তু গত এপ্রিলে তাকে হটিয়ে শীর্ষস্থান দখল করেন ৩০ বছর বয়সী লুসি গুও।
তবে বছর শেষে বাজিমাত করেছেন ২৯ বছর বয়সী লুয়ানা লোপেস লারা। একসময় ব্রাজিলের ব্যালে নৃত্যশিল্পী ছিলেন তিনি। তার প্রেডিকশন মার্কেট স্টার্টআপ 'কালশি'-র বাজারমূল্য এখন ১ হাজার ১০০ কোটি ডলার। ব্যালেরিনা থেকে উদ্যোক্তা বনে যাওয়া লুয়ানাই এখন বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী সেলফ-মেইড নারী বিলিয়নিয়ার।
প্রতিদিন একজন করে নতুন বিলিয়নিয়ার
২০২৫ সালটি যেন ছিল সম্পদ গড়ার বছর। গত এক বছরে নতুন করে ৩৪০ জন বিলিয়নিয়ার হয়েছেন। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন একজন করে নতুন বিলিয়নিয়ার পেয়েছে বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারতের পাশাপাশি সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস কিংবা আলবেনিয়ার মতো ছোট দেশ থেকেও উঠে এসেছেন নতুন ধনীরা।
বর্তমানে বিশ্বে মোট বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ৩ হাজার ১৪৮—যা গত পাঁচ বছরের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। ফোর্বস যখন ১৯৮৭ সালে প্রথম এই তালিকা করে, তখন বিলিয়নিয়ার ছিলেন মাত্র ১৪০ জন। বর্তমানে তাদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১৮ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার।
সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হলো, বর্তমানে ১৯ জন ব্যক্তি অন্তত ১০ হাজার কোটি ডলার বা 'সেন্টিবিলিয়নিয়ার' ক্লাবের সদস্য। অথচ মাত্র ছয় বছর আগেও এই উচ্চতায় একা ছিলেন কেবল একজন—অ্যামাজনের জেফ বেজোস।
ক্ষমতার কেন্দ্রে ধনকুবেররা
২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন প্রায় ১৩৫ জন বিলিয়নিয়ার। নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানেও বিশাল অঙ্কের টাকা ঢেলেছেন তারা। তাই ক্ষমতার পালাবদলে এখন তাদেরই দাপট।
জেফ বেজোস, মার্ক জাকারবার্গ, টিম কুক কিংবা সুন্দর পিচাইয়ের মতো প্রযুক্তি–সম্রাটেরা অনুষ্ঠানে এমন সব আসনে বসেছিলেন, যেগুলো সাধারণত প্রেসিডেন্টের পরিবার, সাবেক প্রেসিডেন্ট বা সরকারের শীর্ষ কর্তাদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। প্রথা ভেঙে বিলিয়নিয়াররাই এখন সামনের সারির ভিআইপি।
এখানেই শেষ নয়, হোয়াইট হাউসের বলরুম সংস্কার প্রকল্পে তারা টাকা ঢেলেছেনন। কেউ কেউ তো সরাসরি নাম লিখিয়েছেন প্রেসিডেন্টের মন্ত্রিসভায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ধনী মন্ত্রিসভা।
মাত্র গত সপ্তাহেই নাসার প্রধান হিসেবে নিয়োগ চূড়ান্ত হয়েছে বিলিয়নিয়ার জ্যারেড আইজ্যাকম্যানের। ঠিক তার আগের দিনই আরেক বিলিয়নিয়ার মিরিয়াম অ্যাডেলসন ঠাট্টাচ্ছলে বলেই ফেললেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচন করতে চান, তবে তিনি আরও ২৫ কোটি ডলার দিতে রাজি!
যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে এই হাওয়া লেগেছে ইউরোপেও। এর আগের সপ্তাহে চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন কৃষি খাতের বিলিয়নিয়ার আন্দ্রে বাবিস। এসব ঘটনাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, পৃথিবী এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি জোরেশোরে 'বিলিয়নিয়ার যুগে' প্রবেশ করেছে।
তালিকার শীর্ষে যথারীতি ইলন মাস্ক। বছরের শুরুতে তাঁর সম্পদ ছিল ৪২১ বিলিয়ন ডলার। বছরজুড়ে নিজের রেকর্ড নিজেই ভেঙেছেন তিনি। ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব বলছে, এই এক বছরেই মাস্কের সম্পদ বেড়েছে ৩৩৩ বিলিয়ন ডলার।
তুলনাটা এভাবে করা যায়—বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী ও গুগলের সহপ্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজের সারা জীবনের মোট সম্পদ ২৫৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ল্যারি পেজ সারা জীবনে যা আয় করেছেন, মাস্ক তার চেয়ে বেশি আয় করেছেন কেবল এই এক বছরেই!
বর্তমানে মাস্কের মোট সম্পদ ৭৫৪ বিলিয়ন ডলার। এই অঙ্ক এতটাই বিশাল যে বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকার নিচের দিকে থাকা ৬২০ জন বিলিয়নিয়ারের মোট সম্পদ এক করলেও মাস্কের সমান হবে না।
সারা বছর মাস্কের দাপট থাকলেও ২০২৫ সালের সেরা দিনটি ছিল ওরাকলের সহপ্রতিষ্ঠাতা ল্যারি এলিসনের। ১০ সেপ্টেম্বর তাঁর কোম্পানির শেয়ার এক লাফে ৩৬ শতাংশ বেড়ে যায়। এতে মাত্র এক দিনেই ল্যারি এলিসনের সম্পদ বাড়ে প্রায় ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার! বিশ্ব ইতিহাসে এক দিনে এত সম্পদ বাড়ার নজির আর নেই।
পরবর্তীতে শেয়ারের দাম কিছুটা পড়লেও প্যারামাউন্ট ও টিকটক কেনাবেচায় ব্যস্ত থাকা এলিসনের বছর শেষের মোট সম্পদ দাঁড়িয়েছে ২৫০ বিলিয়ন ডলারে। বছরের শুরু থেকে যা ৪১ বিলিয়ন ডলার বেশি।
সম্পদ বৃদ্ধির এই দৌড়ে পিছিয়ে নেই গুগলের দুই প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন। ওপেন এআই ও ডিপসিক-এর সঙ্গে পাল্লা দিতে অ্যালফাবেট নিয়ে এসেছে তাদের নতুন এআই মডেল 'জেমিনি ৩'। আর এর সুবাদেই পেজ ও ব্রিন—দুজন মিলে এ বছর ১৮৫ বিলিয়ন ডলার সম্পদ বাড়িয়েছেন।
অন্যদিকে গ্রাফিকস চিপ নির্মাতা এনভিডিয়ার শেয়ারের দাম এ বছর ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা জেনসেন হুয়াংয়ের সম্পদ বেড়েছে ৪২ বিলিয়ন ডলার। এমনকি এনভিডিয়ার এক নির্বাহী এবং দীর্ঘদিনের বোর্ড মেম্বারও এই সুযোগে বিলিয়নিয়ার বনে গেছেন।
তালিকার আরেক নাম জাপানি টাইকুন মাসাওশি সন। সফটব্যাংককে বিশ্বের অন্যতম বড় এআই বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা এই ব্যবসায়ীও এ বছর নিজের ঝুলিতে ভরেছেন বাড়তি ২৫ বিলিয়ন ডলার।
এ বছর বিলিয়নিয়ারদের তালিকায় নতুন মুখের অভাব নেই। আর এই নবাগতদের উঠে আসার পেছনে জাদুর কাঠির মতো কাজ করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। এআইয়ের প্রবল জোয়ারে গা ভাসিয়ে অনেকেই নাম লিখিয়েছেন 'থ্রি-কমা ক্লাব' বা শতকোটিপতির তালিকায়।
প্রথমেই বলা যাক চীনের লিয়াং ওয়েংফেংয়ের কথা। ২০২৩ সালে তিনি চালু করেছিলেন 'ডিপসিক'। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তার তৈরি 'আর-১' মডেলটি প্রযুক্তিবিশ্বে রীতিমতো ঝড় তোলে। দাবি করা হয়, ওপেন এআইয়ের চ্যাটজিপিটির মতোই কাজ করে এটি, অথচ খরচ অনেক কম! ব্যস, এই সাফল্যের ওপর ভর করেই লিয়াং ঢুকে পড়েন বিলিয়নিয়ারদের অভিজাত ক্লাবে।
চ্যাটবট 'ক্লড' -এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যানথ্রপিকও কম যায় না। ওপেন এআই ছেড়ে আসা সাতজন কর্মী মিলে গড়েছিলেন এই প্রতিষ্ঠান। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে তাঁদের কোম্পানির ভ্যালুয়েশন বা বাজারমূল্য ১৮০০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে প্রথমে ৬১৫০ কোটি এবং সবশেষ ১৮ হাজার ৩০০ কোটি ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। ফলে এই সাতজনই এখন নতুন বিলিয়নিয়ার।
শুধু সফটওয়্যার বা মডেল বানিয়েই নয়, এআইয়ের এই রমরমা বাজারে যন্ত্রাংশ জোগান দিয়েও অনেকে ধনী হচ্ছেন। যেমন দক্ষিণ কোরিয়ার কিম সাং-বিওম। তাঁর প্রতিষ্ঠান 'আইএসইউ পেটাসিস' প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড তৈরি করে। এ বছর তার কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে ৩৬০ শতাংশেরও বেশি!
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের চিপ জায়ান্ট এনভিডিয়া ও এএমডির চারজন সাবেক কর্মকর্তা এখন চীনের নতুন বিলিয়নিয়ার। তারা চীনে এমন সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি গড়ে তুলেছেন, যা এনভিডিয়া বা এএমডির বিকল্প হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
এআই বা মেশিন লার্নিং যত দ্রুত এগোচ্ছিল, তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিল না কানেক্টিভিটি বা সংযোগ ব্যবস্থা। ২০১৭ সালে এই সমস্যাটিই নজরে আসে জিতেন্দ্র মোহন ও সঞ্জয় গজেন্দ্রর। সমাধান হিসেবে তারা ক্যালিফোর্নিয়ায় গড়ে তোলেন 'অ্যাস্টেরা ল্যাবস'।
তাদের কাজ ছিল ডাটা সেন্টারের জন্য উন্নত নেটওয়ার্কিং প্রযুক্তি সরবরাহ করা। ২০২৪ সালে কোম্পানিটি পাবলিক লিমিটেড হওয়ার পর থেকে এর শেয়ারের দাম বেড়েছে ১৪০ শতাংশ। জিতেন্দ্র ও সঞ্জয়—দুজনেই এখন বিলিয়নিয়ার।
অন্যদিকে জিপিইউ ভাড়া দিয়েও যে সাম্রাজ্য গড়া যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছে 'কোরউইভ'। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপজুড়ে তিন ডজন ডাটা সেন্টারে প্রায় আড়াই লাখ জিপিইউ এআই কোম্পানিগুলোর কাছে ভাড়া দিচ্ছে তারা। গত মার্চে আইপিওতে আসার পর থেকে তাদের শেয়ারের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। আর এর নেপথ্যে থাকা তিন প্রতিষ্ঠাতা এখন নতুন বিলিয়নিয়ার।
সবচেয়ে অদ্ভুত গল্পটি সম্ভবত 'ফারমি আমেরিকা'র। টেক্সাসে এআই প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশাল এক ডাটা সেন্টার বানাচ্ছে তারা। গত অক্টোবরে ১ হাজার ২৫০ কোটি ডলার বাজারমূল্য নিয়ে পুঁজিবাজারে আসে কোম্পানিটি।
মুহূর্তেই বিলিয়নিয়ার বনে যান দুই সহপ্রতিষ্ঠাতা টবি নিউগেবাউয়ার এবং গ্রিফিন পেরি। এমনকি গ্রিফিনের বাবা, টেক্সাসের সাবেক গভর্নর ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জ্বালানিসচিব রিক পেরিও বিপুল অর্থের মালিক বনে যান।
মজার ব্যাপার হলো, ফারমি এখন পর্যন্ত এক টাকাও আয় করেনি! তাদের ডাটা সেন্টারের প্রথম ধাপের কাজ শেষ হতেই আরও অন্তত এক বছর লাগবে। আইপিও-র পর শেয়ারের দাম ৭০ শতাংশ কমে যাওয়ায় গ্রিফিন পেরি অবশ্য বিলিয়নিয়ার ক্লাবে আর নেই। তবে টবি নিউগেবাউয়ার এখনো বিলিয়নিয়ার। আর এত কিছুর পরেও কোম্পানিটির বর্তমান বাজারমূল্য ৫০০ কোটি ডলারের ওপরে।
এআই দুনিয়ার এই রমরমা বাজারে কেবল চিপ বা ডাটা সেন্টার মালিকরাই যে ধনী হচ্ছেন, তা নয়। ডাটা সেন্টারের তার সরবরাহ করে কেউ ধনী হচ্ছেন, কেউবা ধনী হচ্ছেন 'ভাইব কোডিং' কিংবা ডাটা লেবেলিংয়ের কাজ করে। এআই কাস্টমার সার্ভিস এজেন্ট, এআই ভয়েস ক্লোনিং—এমনকি এআই চালিত ডেটিং গেম বানিয়েও অনেকে এখন বিলিয়নিয়ারদের কাতারে নাম লেখাচ্ছেন।
এতক্ষণ তো সব এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গল্প হলো। কিন্তু বিলিয়নিয়ার হওয়ার এই ইঁদুর দৌড় শুধু এআইয়ের গণ্ডিতেই আটকে নেই। এর বাইরেও টাকার ফোয়ারা ছুটছে।
জুনে ক্রিপ্টোকারেন্সি কোম্পানি 'সার্কেল' শেয়ারবাজারে এল। তাদের স্টেবলকয়েন 'ইউএসডিসি'র (কল্যাণে সহপ্রতিষ্ঠাতা জেরেমি অ্যালেয়ার নাম লেখালেন বিলিয়নিয়ারের খাতায়। ঠিক পরের মাসেই ডিজাইন সফটওয়্যার কোম্পানি 'ফিগমা' পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এতে ফিগমার দুই সহপ্রতিষ্ঠাতা ডিলান ফিল্ড ও ইভান ওয়ালেসও ঢুকে পড়েন ধনীদের তালিকায়। ডিলান তো একধাপ এগিয়ে মাল্টি-বিলিয়নিয়ার!
যুদ্ধবিগ্রহ আর নিরাপত্তার শঙ্কার কারণে প্রতিরক্ষা খাতের ব্যবসাও এখন তুঙ্গে। 'ক্যাডরি হোল্ডিংস' মূলত বডি আর্মার বা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এবং বোম্ব স্যুট তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ার ঢেউ লেগেছে তাদের শেয়ারেও। ফলে কোম্পানির সিইও ওয়ারেন ক্যান্ডার্স এখন বিলিয়নিয়ার।
মহাকাশেও চলছে প্রতিযোগিতা। ইলন মাস্কের স্পেস-এক্সকে টেক্কা দিতে মাঠে নেমেছে 'এএসটি স্পেস মোবাইল'। স্যাটেলাইট থেকে সরাসরি মোবাইল ফোনে ব্রডব্যান্ড সংযোগ দেওয়াই তাদের লক্ষ্য। এ বছর তাদের শেয়ারের দাম ৩০০ শতাংশ বাড়ায় প্রতিষ্ঠাতা আবেল আভেজান এখন বিপুল বিত্তের মালিক।
প্রযুক্তির বাইরের জগতের তারকারাও পিছিয়ে নেই। সোশ্যাল মিডিয়া সাইট রেডিতের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্টিভ হাফম্যান যেমন আছেন, তেমনি আছেন সিনেমার জাদুকর জেমস ক্যামেরন। 'টাইটানিক' বা 'অ্যাভেটার'-এর মতো সিনেমার টিকিট বিক্রির টাকায় তিনি গড়েছেন পাহাড়সম সম্পদ। আর খেলার মাঠ থেকে ব্যবসায়িক বুদ্ধি—সব মিলিয়ে টেনিস কিংবদন্তি রজার ফেদেরারও এ বছর নিজের নাম লিখিয়েছেন বিলিয়নিয়ারদের অভিজাত তালিকায়।
নতুনদের জয়গান, পুরোনোরাও বহাল তবিয়তে
সব মিলিয়ে গত ১২ মাসে বিশ্বের বিলিয়নিয়ারদের ঝুলিতে যোগ হয়েছে নতুন ৮৭৬ বিলিয়ন বা ৮৭ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। বিশ্বজুড়ে ধনকুবেরদের মোট যে সম্পদ, তার প্রায় ৫ শতাংশই এসেছে এই এক বছরে।
বিলিয়নিয়ার হওয়ার এই উৎসবে আমেরিকানদের দাপটই বেশি, নতুনদের প্রায় ৪০ শতাংশই সে দেশের। তবে এই 'ধনীদের পার্টি' এখন আর নির্দিষ্ট কোনো দেশের গণ্ডিতে আটকে নেই, ছড়িয়ে পড়েছে ৩২টি দেশে। এর মধ্যে চীন থেকে ৩৫ জন, ভারত থেকে ১৫ জন এবং রাশিয়া থেকে ১৫ জন নতুন মুখ নাম লিখিয়েছেন এই তালিকায়।
আছে জার্মানির ক্লিমেন্স ফিশারের মতো মানুষও। ওষুধ ও সাপ্লিমেন্ট বিক্রি করে তিনি ধনী হয়েছেন। এখন কাজ করছেন আফিমের বিকল্প হিসেবে গাঁজা দিয়ে ব্যথানাশক ওষুধ তৈরির প্রকল্পে।
তবে এই বছরই প্রথমবারের মতো একজন বিলিয়নিয়ার পেল আলবেনিয়া। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দেশের কমিউনিস্ট শাসন থেকে বাঁচতে পালিয়ে অস্ট্রিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন সমির। সেখানে ভাগ্য গড়ার পর আবার ফিরে আসেন নিজ দেশে। রাজধানী তিরানার উপকণ্ঠে গড়ে তোলেন দেশের প্রথম শপিং মল। সেই শরণার্থী সমিরই এখন রিয়েল এস্টেট ও খুচরা ব্যবসার মোগল।
নতুন এই ধনীদের দুই-তৃতীয়াংশই 'সেলফ-মেইড' বা নিজের ভাগ্য নিজে গড়েছেন। এর মধ্যে ৩০ বছরের কম বয়সী ১১ জন তরুণও আছেন, যা বিশ্বজুড়ে তরুণ বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা রেকর্ড ১৩-তে নিয়ে গেছে।
তবে পুরোনো রীতি মেনে উত্তরাধিকার সূত্রে ধনী হওয়ার পথটাও বন্ধ হয়নি। ইন্ডিয়ানাপোলিস কোল্টসের মালিক জিম ইরসে এবং ইতালীয় ফ্যাশন কিংবদন্তি জর্জিও আরমানির মৃত্যুর পর তাঁদের সন্তানেরা বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে এই তালিকায় ঢুকেছেন। এ ছাড়া মেডিকেল সরঞ্জাম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান 'মেডলাইন'-এর আইপিও বা শেয়ার ছাড়ার সুবাদে একই পরিবারের পাঁচ সদস্য বিলিয়নিয়ার হয়েছেন।
তবে, ধনী হওয়ার একটা 'মজা' হলো, একবার ধনী হলে সাধারণত ধনীই থাকা যায়। এত এত নতুন মুখের ভিড়েও বর্তমান বিলিয়নিয়ারদের ৮৫ শতাংশই বছর শুরু করেছিলেন বিলিয়নিয়ার হিসেবে।
তাদের প্রতি পাঁচজনের চারজনই এক বছর আগের তুলনায় এখন আরও বেশি সম্পদের মালিক। পকেটভর্তি টাকা আর একরাশ সুখবর নিয়েই তারা পা রাখতে যাচ্ছেন ২০২৬ সালে। ধনীদের এই রমরমা দিন যে সহসাই শেষ হচ্ছে না, তা বলাই বাহুল্য।
