ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে রোববার যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করবেন জেলেনস্কি
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, রাশিয়ার সঙ্গে চলমান পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ বন্ধের উপায় খুঁজতে আগামী রোববার ফ্লোরিডায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন তিনি। জেলেনস্কির প্রত্যাশা, বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত শান্তি পরিকল্পনা এবং নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাবে। খবর বিবিসি'র।
তবে রাশিয়ার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, মস্কোর প্রস্তাবিত পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় প্রণীত পরিকল্পনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। রাশিয়া জানিয়েছে, আলোচনা প্রক্রিয়ায় 'ধীর কিন্তু স্থিতিশীল অগ্রগতি' হচ্ছে। তবে ডনবাস অঞ্চল থেকে পারস্পরিক সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে জেলেনস্কির প্রস্তাব নিয়ে তারা এখনও কোনো মন্তব্য করেনি।
জেলেনস্কি সাংবাদিকদের জানান, তাদের ২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা বর্তমানে প্রায় ৯০ শতাংশ প্রস্তুত। তিনি ডনবাসের যেসব এলাকা রাশিয়া দখল করতে পারেনি, সেখানে একটি সেনা 'মুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল' গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লেখেন, 'আমরা একটি দিনও নষ্ট করছি না। খুব শীঘ্রই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আমাদের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হবে। নতুন বছরের আগেই অনেক বড় কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব।'
অন্যদিকে এক সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের কোনো পরিকল্পনাই কার্যকর হবে না, যতক্ষণ না তিনি নিজে সেটি অনুমোদন দেন। ট্রাম্প আরও জানান, তিনি খুব শিগগিরই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলবেন। পাশাপাশি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও আগামী কয়েক দিনের মধ্যে তার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।
রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করে বলেন, '২০২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর দিনটি আমাদের সবার স্মৃতিতে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে, কারণ আমরা প্রকৃত সমাধানের খুব কাছাকাছি পৌঁছেছি।'
শান্তি আলোচনার এই তৎপরতার মধ্যেও ইউক্রেনের বিভিন্ন স্থানে রুশ হামলা অব্যাহত রয়েছে। শনিবার রাতে রাজধানী কিয়েভে বিমান হামলা চালায় রুশ বাহিনী। এ ছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর খারকিভে রাশিয়ার বিমান হামলায় দুইজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ওই শহরের মেয়র।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে রাশিয়ার এই আগ্রাসন শুরু হয় এবং বর্তমানে ডনবাস অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
চলতি বছরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে একাধিক দফা বৈঠক হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত প্রথম বৈঠকটি ছিল বেশ উত্তেজনাপূর্ণ এবং তা বাদানুবাদে গড়ায়। তবে অক্টোবরে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়।
বড়দিনে ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং তার জামাতা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা টেলিফোনে কথা বলার পর জেলেনস্কি আসন্ন এই শীর্ষ বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, ওই আলোচনায় যুদ্ধ বন্ধে বেশ কিছু নতুন ধারণা উঠে এসেছে।
হোয়াইট হাউস পূর্ব ইউক্রেনে একটি সেনামুক্ত অঞ্চল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে, যেখানে কোনো পক্ষই সেনা মোতায়েন করবে না। এর ফলে বিতর্কিত অঞ্চলগুলোর মালিকানা প্রশ্ন আপাতত এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
জেলেনস্কি ইঙ্গিত দিয়েছেন, ইউক্রেন যদি সম্মুখ সমররেখা থেকে ৪০ কিলোমিটার পিছিয়ে গিয়ে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলে, তবে রাশিয়াকেও তাদের দখলে থাকা ডনবাস অঞ্চল থেকে সমপরিমাণ দূরত্বে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।
এর আগে স্টিভ উইটকফ প্রণীত ২৮ দফার একটি খসড়া পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, যা মূলত রাশিয়ার অনুকূলে বলে মনে করা হয়। তবে ইউক্রেন সেই পরিকল্পনায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। আগামী রবিবারের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিরাপত্তা নিশ্চয়তা এবং একটি পৃথক অর্থনৈতিক চুক্তি নিয়েই মূল আলোচনা হবে।
জেলেনস্কি জানিয়েছেন, আঞ্চলিক সীমানা নির্ধারণ এবং জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে সমাধানে পৌঁছানো সবচেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপের বৃহত্তম এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বর্তমানে রাশিয়ার দখলে রয়েছে। হোয়াইট হাউস প্রস্তাব দিয়েছে, কেন্দ্রটি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ইউক্রেন ও রাশিয়া—উভয় দেশ ভাগ করে নেবে।
তবে রাশিয়া এই পরিকল্পনার বহু দিক, বিশেষ করে সীমানা সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো মেনে নেওয়ার সম্ভাবনা কম। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা অভিযোগ করেছেন, পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি দেশ এই কূটনৈতিক অগ্রগতি ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, ইউক্রেনীয় সেনাদের পুরো ডনবাস অঞ্চল ছাড়তে হবে; অন্যথায় রাশিয়া সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে পুরো অঞ্চল দখল করে নেবে।
নতুন এই প্রস্তাবে ইউক্রেনের জন্য ন্যাটোর ৫ নম্বর অনুচ্ছেদের আদলে নিরাপত্তা নিশ্চয়তার কথাও উল্লেখ রয়েছে। এর ফলে ভবিষ্যতে রাশিয়া আবার হামলা চালালে মিত্র দেশগুলো ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিতে বাধ্য থাকবে। পাশাপাশি ইউক্রেন তাদের সেনাবাহিনীতে ৮ লাখ সদস্য বহাল রাখতে পারবে, যদিও ক্রেমলিন শুরু থেকেই এই সংখ্যা কমানোর দাবি জানিয়ে আসছে।
