হাতি সংরক্ষণে নতুন উদ্যোগ: উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘সংরক্ষিত এলাকা’ বানাবে সরকার

বাংলাদেশ ভারতীয় হাতির (বৈজ্ঞানিক নাম: এলিফাস ম্যাক্সিমাস ইন্ডিকাস) প্রাকৃতিক আবাসস্থলগুলোর একটি। বর্তমানে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আনুমানিক ২৬৮টি বন্য হাতি বাস করে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) বাংলাদেশে এই প্রজাতিকে মহাবিপন্ন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। হাতিরা প্রধানত বাস করে দেশের দক্ষিণের পাহাড়ি বনাঞ্চলে। তবে কিছু হাতির দেখা মেলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এসব হাতি 'অস্থায়ী' হিসেবে বিবেচিত হয়। হাতির সংখ্যা গণনায় এদেরকে ধরা হয়নি। কয়েক বছর আগে এরা ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে অভিবাসিত হয়। তবে ২০১৯ সালের পর থেকে ভারত সীমান্তে 'হাতি চলাচলের পথ' বন্ধ থাকায় তারা আর ফিরতে পারেনি। ফলে ওই অঞ্চলে আটকে পড়া হাতিগুলো মৌসুমভেদে খাদ্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ কারণেই মানব-হাতি সংঘাত দিন দিন বেড়েছে।
গত ১২ মার্চ পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট মঙ্গাবে-তে এই সংকট নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত দল সেখানে যায়। পরিদর্শনের পর এলাকাটিকে 'সংরক্ষিত এলাকা' হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মঙ্গাবে-কে বলেন, 'আমি ব্যক্তিগতভাবে ২৬ মে এলাকা পরিদর্শন করেছি পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝার জন্য। প্রাথমিকভাবে আমরা এলাকাটি সংরক্ষিত ঘোষণা করার কাজ করছি এবং সংঘাত ও ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে কমানো যায় তা নিয়ে ভাবছি। পাশাপাশি, ভারতের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাব, যেন একটি স্থায়ী সমাধান খোঁজা যায়।'
তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ মঙ্গাবে-কে বলেন, 'সংঘাতপ্রবণ এলাকাকে 'সংরক্ষিত এলাকা' ঘোষণার উদ্যোগটি ভালো, কিন্তু এই অবস্থান বজায় রাখা কঠিন হবে। কারণ অঞ্চলটি প্রায় পুরোটাই জনবসতি ও কৃষিজমিতে পূর্ণ।'
তিনি বলেন, 'উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় আন্তর্জাতিক সীমান্ত বরাবর প্রায় ৪১ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত দীর্ঘ এলাকায় এসব হাতি বাস করে। সীমান্ত বরাবর গড়ে ৫ কিলোমিটার ভেতরে ধরলে এর আয়তন প্রায় ২০০ বর্গকিলোমিটার হয়। এর বেশিরভাগই জনবসতি ও কৃষিজমিতে পরিণত হয়েছে।'
এ অঞ্চলের বনাঞ্চল এখন জনবসতি বৃদ্ধি ও বন উজাড়সহ নানা কারণে কমে গেলেও ইতিহাসে এলাকাটি ছিল শাল গাছপ্রধান ঘন বনভূমি।
সংঘাত ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পর্যাপ্ত সংখ্যক হাতি ব্যস্থাপনা কর্মী (ইআরটি) নিয়োজিত করাসহ একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার বাস্তবায়ন প্রয়োজন বলে মনে করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ।
ইআরটি সাধারণত স্থানীয়দের নিয়েই গঠিত হয় এবং তারা হাতি সম্পর্কিত সচেতনতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন, হাতির দলের চলাচল সম্পর্কে তথ্য দেওয়া, হাতি সংরক্ষণে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা এবং বন্য প্রাণীর সঙ্গে মানবিক আচরণ সম্পর্কে বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি।
আইইউসিএন বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার এ.বি.এম. সারোয়ার আলম এই অঞ্চলে চাষাবাদের ধরণ বদলানোর পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, 'হাতির দল সাধারণত ধান ও শাকসবজির খেতেই বেশি হামলা চালায় খাদ্যের জন্য। তাই কৃষকরা এর পরিবর্তে বিকল্প ফসল, যেমন কাঁচা মরিচ চাষ করতে পারেন। হাতিরা সাধারণত মরিচ খেতে চায় না।'
তবে ফিরোজ জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিদ্যমান চারটি 'হাতি করিডোর' খুলে দেওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে হাতির দল তাদের স্বাভাবিক অভিবাসন চালিয়ে যেতে পারে। অন্যথায়, দীর্ঘমেয়াদে এই অঞ্চল মানুষের পাশাপাশি হাতির জন্যও অনিরাপদ হয়ে উঠবে।
এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা ও সংরক্ষণ পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি দুই বিশেষজ্ঞই মনে করেন, এই সংকট সমাধানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান খুঁজে বের করাই জরুরি।
২০২০ সালে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তবর্তী হাতি সংঘাত ও তার ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি প্রোটোকল স্বাক্ষর করেছিল। তবে এখনো প্রোটোকলটি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত শর্ত ও কাঠামো নির্ধারণ প্রক্রিয়াধীন।
এ ছাড়া, ২০২৫ সালে ১৩টি 'এশীয় হাতি-অবস্থানকারী দেশ' মিলে গৃহীত সিয়েম রিয়াপ ঘোষণা করে। এটি এশীয় হাতি সংরক্ষণের একটি যৌথ পরিকল্পনা এবং এটি এই সংকট সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে মন্তব্য করেন ফিরোজ। এই ঘোষণার আওতায়, যেসব দেশ মিলে বর্তমানে মোট ৫০ হাজারের কম বন্য হাতি রয়েছে, তাদের দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে এশীয় হাতির অবস্থা ও সংরক্ষণ
আইইউসিএন বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১ হাজার ৫১৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ৪৪টি বনাঞ্চলে হাতির উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়েছে এবং ১২টি হাতি করিডোর চিহ্নিত রয়েছে। হাতির চলাচলের পথ বলতে সেসব দৈনন্দিন ব্যবহৃত রুটগুলোকে বোঝানো হয় যেগুলো তারা খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনের জন্য ব্যবহার করে। অন্যদিকে, করিডোর হলো একটি আবাসস্থল থেকে আরেকটিতে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত সংযোগ এলাকা। আর, দক্ষিণাঞ্চলে তারা প্রধানত চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় বসবাস করে।
যেসব হাতি বাংলাদেশের বনাঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি বসবাস করে তাদের 'স্থানীয়' ধরা হয়, আর যেসব হাতি ভারত বা মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশী দেশ থেকে নিয়মিত আসা-যাওয়া করে তাদের 'অস্থায়ী' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
বাংলাদেশ বন বিভাগের তথ্যানুসারে, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মানব-হাতি সংঘাতে নিহত হয়েছে অন্তত ৫০টি হাতি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে ২০২১ সালে। এসময় ৩৪টি হাতি মারা যায়।
দেশের হাতি সংরক্ষণ কার্যক্রমকে দিকনির্দেশনা দিতে সরকার ২০১৮ সালে একটি ১০ বছরের 'হাতি সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা' প্রণয়ন করে। এই উদ্যোগের পাশাপাশি টেকসই বন ও জীবিকা নামের একটি প্রকল্পের আওতায় বন বিভাগ ও আইইউসিএন বাংলাদেশের মতো এনজিওগুলো সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলের স্থানীয় জনগণকে হাতি প্রতিক্রিয়া দলে অন্তর্ভুক্ত করে মানব-হাতি সংঘাত প্রশমনে কাজ করছে।
মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি বিবেচনায় ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার বন্য প্রাণীর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ চালু করে। পরে, ২০২১ সালে এই প্যাকেজটিকে আরো সম্প্রসারিত করে বাড়তি সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে ৫৬টি সংরক্ষিত এলাকা রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্য অন্তর্ভুক্ত, যা বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।