রেনাটার ১,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ পরিকল্পনা যেভাবে ১,৪০০ কোটির সমস্যায় পরিণত হলো

করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর ঠিক আগে, বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ কোম্পানি রেনাটা একটি বড় ধরনের সম্প্রসারণ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায়, প্রতিষ্ঠানটি ১০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু এরপরই শুরু হয় মহামারি।
করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, আর সেই বাধার মুখে পড়ে রেনাটার সম্প্রসারণ পরিকল্পনাও। তবে ভোগান্তির শেষ সেখানেই নয়।
মহামারির পর যখন বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায়। এর প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে আমদানিনির্ভর দেশগুলোকে, বিশেষ করে বাংলাদেশকে।
২০২২ সালের শুরুর দিকে প্রতি ডলার ৮৫ টাকায় লেনদেন হলেও, ছয় মাসের মধ্যে তা উঠে যায় ১১০ টাকায়। পরের ছয় মাসে দাম আরও বেড়ে ১২০ টাকায় পৌঁছায়। টাকার এই ব্যাপক অবমূল্যায়নের ফলে রেনাটার সম্প্রসারণ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায় ৪০০ কোটি টাকা। এতে ১,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ পরিকল্পনা গিয়ে ঠেকে ১,৪০০ কোটি টাকায়।
ফলে প্রকল্পের অর্থনৈতিক হিসাব পাল্টে যায় পুরোপুরি।
ঋণের সুদের হার বেড়ে যায়, পাশাপাশি আমদানিকৃত কাঁচামালের দামও বাড়ে। এর ফলে নাটকীয়ভাবে নেমে এসেছে রেনাটার মুনাফার হার। কয়েক বছর আগেও যেখানে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফার হার ছিল ১৮ শতাংশ, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫ শতাংশে। মুনাফায় এই পতনের পেছনে বড় কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে ঋণ পরিশোধের আর্থিক চাপকে।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, ২০২১ সালের জুনে রেনাটার মোট ঋণ ছিল ৪৮০ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের মার্চে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১,৯০০ কোটিতে।
রেনাটার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কায়সার কবির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "সরকারি বিধি অনুযায়ী ১১৭টি ওষুধ ছাড়া অন্য সবগুলোর দাম বাড়াতে পারে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো। সেই নিয়ম অনুযায়ী আমরা কিছু ওষুধের দাম বাড়াতে চাই।"
তিনি বলেন, "রেনাটার মোট ৬২৬টি পণ্যের মধ্যে ১৯৪টি বাজার থেকে তুলে নিচ্ছি, কারণ সেগুলো এখন আর লাভজনক নয়। দাম বাড়াতে না দিলে, দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে দেশে কোনো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি টিকে থাকতে পারবে না।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা বায়োইকুইভিলেন্ট পণ্য তৈরি করি, এতে খরচ বেশি। আমাদেরই সর্বোচ্চ ৭৫টি বায়োইকুইভিলেন্ট প্রোডাক্ট আছে। এখন ড্রাগ ডেভেলপমেন্টে কোম্পানিগুলোর অনেক ব্যয় হচ্ছে। শুধু গত বছরই আমি এই খাতে ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছি। এ বছর বাজেট ধরা হয়েছে ১৬৫ কোটি টাকা।"
এদিকে গত মাসে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির কোষাধ্যক্ষ এবং হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ হালিমুজ্জামান বলেন, মূল্য সমন্বয় ছাড়া ওষুধ শিল্প বাঁচবে না।
তিনি বলেন, "চাল, ডাল, তেল, রিকশাভাড়া—সবকিছুর দাম বাড়ছে। ওষুধ তো কোনো ভিন্ন জগতে তৈরি হয় না। কাঁচামাল, পরিবহন, কর, গবেষণা ও উন্নয়নসহ প্রতিটি পর্যায়েই খরচ বেড়েছে। অথচ দাম আগের মতোই রয়েছে। এই খাতে যদি দ্রুত মূল্য সমন্বয় না হয়, তাহলে ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।"
বিনিয়োগ পরিকল্পনা
২০১৯ সালে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে ১,০০০ কোটি টাকার মূলধনী যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা গ্রহণ করে রেনাটা।
তৎকালীন সময়ে কোম্পানিটির ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট ছিল ৫০০ কোটি টাকা। বছরে ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা ধরে সেই ভিত্তিতেই বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়।
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে সুদের হার আরও বাড়তে পারে এমন আশঙ্কায়, স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধে রেনাটা ৮৫০ কোটি টাকা তুলতে চেয়েছিল জিরো-কুপন বন্ড ও প্রেফারেন্স শেয়ারের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ৬৬০ কোটি টাকার জিরো-কুপন বন্ড এবং ৩৫০ কোটি টাকার প্রেফারেন্স শেয়ার ইস্যুর অনুমোদনও দেয়। তবে ট্রেজারি বন্ডের মুনাফার উচ্চ হার থাকায় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ না পাওয়ায় তহবিল সংগ্রহের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
চলতি বছরের মার্চে বিএসইসি সাবস্ক্রিপশন সময়সীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে রেনাটা প্রেফারেন্স শেয়ার থেকে ২২৫ কোটি টাকা এবং জিরো-কুপন বন্ড থেকে ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয় বলে জানানকর্মকর্তারা।
রেনাটার মুনাফায় ধস
প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে রেনাটা ৫০০ কোটির বেশি মুনাফা করেছিল। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেই মুনাফা নেমে আসে ২৩৩ কোটি টাকায়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে মুনাফা কিছুটা বেড়ে ৩৬১ কোটিতে দাঁড়ালেও চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে মুনাফা ৩৫ শতাংশ কমে নেমে এসেছে ১৬৮ কোটিতে। একই সময়ে কোম্পানির আর্থিক খরচ বেড়েছে ৫৬ শতাংশ।