কেন পাকিস্তানের আইএমএফ ঋণ ঠেকাতে ব্যর্থ হলো ভারত?

ভারতের তীব্র আপত্তি থাকা সত্ত্বেও গত সপ্তাহে পাকিস্তানকে ১ বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল অনুমোদন করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা তুঙ্গে থাকার সময় এমন সিদ্ধান্ত ভারত 'ভুল বার্তা' বলে মন্তব্য করেছে। খবর বিবিসির।
ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও, আইএমএফ বোর্ড ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি অনুমোদন করেছে। সংস্থাটি জানায়, পাকিস্তান সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে যথেষ্ট অগ্রগতি দেখিয়েছে এবং দেশটির অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় পাকিস্তানের সক্ষমতা তৈরির উদ্যোগে ভবিষ্যতে আরও ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে।
ভারত এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে দুটি বড় যুক্তি তোলে। প্রথমত, পাকিস্তানের দুর্বল সংস্কার বাস্তবায়নের ইতিহাস উল্লেখ করে দিল্লি প্রশ্ন তোলে এমন ঋণ কার্যকর কতটা হবে। দ্বিতীয়ত, ভারত দাবি করে—এই তহবিল 'রাষ্ট্র-সমর্থিত সীমান্ত পারাপার সন্ত্রাসে' ব্যবহৃত হতে পারে, যা পাকিস্তান বারবার অস্বীকার করে এসেছে। ভারত আরও বলে, এই সিদ্ধান্ত আইএমএফ এবং এর দাতাদের 'সুনাম ও বৈশ্বিক মূল্যবোধের হাস্যকর প্রদর্শনীতে' পরিণত করছে।
এই বিষয়ে আইএমএফের কাছে বিবিসি মন্তব্য চাইলে তারা কোনো সাড়া দেয়নি।
তবে পাকিস্তানি বিশ্লেষকদের কেউ কেউ ভারতের প্রথম যুক্তিকে কিছুটা বাস্তবসম্মত বলছেন। ১৯৫৮ সাল থেকে পাকিস্তান ২৪ বার আইএমএফের কাছে ঋণ নিয়েছে—এবং বারবারই কাঙ্ক্ষিত সংস্কার না করেই পুনরায় সাহায্য চেয়েছে।
পাকিস্তানের সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত হুসেইন হক্কানি বলেন, 'আইসিইউতে যাওয়ার মতোই বিষয়টি। কেউ যদি ২৪-২৫ বার আইসিইউতে যায়, তাহলে তার শরীরে কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে—এটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার।'
তবে দিল্লির অন্য যে উদ্বেগ—আইএমএফ 'সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাসে মদদের' জন্য পাকিস্তানকে পুরস্কৃত করছে এবং এতে 'বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে বিপজ্জনক বার্তা' যাচ্ছে—তা আরও জটিল এক প্রসঙ্গ। এই কারণেই সম্ভবত ভারত আইএমএফের এই ঋণপ্রক্রিয়া থামাতে কার্যকর চাপ দিতে পারেনি।
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানকে ঋণের পরবর্তী কিস্তি দিতে বাধা দেওয়ার ভারতীয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা মূলত প্রতীকী ছিল। কারণ, আইএমএফের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভারতের প্রভাব খুবই সীমিত।
আইএমএফ বোর্ডে ২৫টি সদস্য দেশের মধ্যে ভারত একটি ছোট গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব করে—যার মধ্যে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও ভুটান। অন্যদিকে পাকিস্তান একটি ভিন্ন গ্রুপে, যার নেতৃত্বে রয়েছে ইরান।
জাতিসংঘের মতো এক দেশ এক ভোট নীতি না থাকায়, আইএমএফে সদস্য দেশের অর্থনৈতিক পরিমাণ ও অবদান অনুসারে ভোটাধিকার নির্ধারিত হয়। ফলে ধনী দেশগুলোর ভোট প্রাধান্য পায়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের ভোট শেয়ার ১৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ, যেখানে ভারতের মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। তাছাড়া, আইএমএফের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া যায় না—শুধু পক্ষে ভোট দেওয়া বা বিরত থাকা যায়। সিদ্ধান্তগুলো সর্বসম্মতভাবেই গ্রহণ করা হয়।
একজন অর্থনীতিবিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'এই ব্যবস্থায় ক্ষমতাধর দেশের স্বার্থরক্ষার প্রবণতা স্পষ্ট।'
২০২৩ সালে ভারতের জি-২০ সভাপতিত্বকালে আইএমএফে এই ভোট কাঠামোর সংস্কার অন্যতম প্রস্তাব ছিল। প্রাক্তন ভারতীয় আমলা এনকে সিং এবং সাবেক মার্কিন অর্থমন্ত্রী লরেন্স সামার্স এক প্রতিবেদনে বলেন—ভোটাধিকার আর্থিক অবদানের সঙ্গে যুক্ত না রেখে 'গ্লোবাল নর্থ' ও 'গ্লোবাল সাউথ'-এর মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে। তবে এই সুপারিশ বাস্তবায়নে এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখানে 'গ্লোবাল নর্থ' মানে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ধনী দেশ, আর 'গ্লোবাল সাউথ' মানে উন্নয়নশীল ও তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশ।
আইএমএফের নিজস্ব নিয়মে সম্প্রতি করা পরিবর্তনও এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। ২০২৩ সালে সংস্থাটি যুদ্ধে থাকা ইউক্রেনকে ১৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে—এ ধরনের পদক্ষেপ এর আগে কখনো দেখা যায়নি।
এই প্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষক গবেষণা ফাউন্ডেশনের বিশ্লেষক মিহির শর্মা বলেন, 'আইএমএফ নিজেই তখন তার নিয়ম ভেঙেছে, এখন পাকিস্তানকে আগেই নির্ধারিত ঋণ না দেওয়ার যুক্তি তাদের নেই।'
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত যদি সত্যিই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে চায়, তবে উপযুক্ত মঞ্চ হলো জাতিসংঘের অধীন ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ)। সংস্থাটি সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ করে এবং প্রয়োজনে কোনো দেশকে 'গ্রে' বা 'ব্ল্যাক' তালিকাভুক্ত করে, যার ফলে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের তহবিলে প্রবেশে বাধা তৈরি হয়।
হুসেইন হক্কানি বলেন, 'আইএমএফে এমন স্ট্যান্ড নেওয়া কার্যকর হয়নি, হবেও না। বরং কোনো দেশ যদি এফএটিএফ তালিকাভুক্ত হয়, তখনই সে ঋণ পেতে বাধার সম্মুখীন হয়—পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তা আগে ঘটেছে।'
তবে বাস্তবতা হলো, ২০২২ সালে পাকিস্তান এফএটিএফ-এর গ্রে তালিকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
তাছাড়া, ভারতের পক্ষে আইএমএফের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও ভেটো ক্ষমতা সংস্কারের দাবি তুললেও, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন—এটি হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, এর ফলে ভারতের তুলনায় চীনের ক্ষমতা আরও বেড়ে যেতে পারে।
মিহির শর্মা বলেন, 'যদি এমন সংস্কার হয়, তাহলে তার সুফল সবচেয়ে বেশি পাবে বেইজিং।'
হক্কানি মনে করেন, ভারতকে দ্বিপাক্ষিক বিরোধ নিয়ে বহুপাক্ষিক মঞ্চে এগিয়ে যাওয়া থেকে সাবধান থাকতে হবে। ইতিহাসে এরাই বরং চীনের ভেটোর শিকার হয়েছে বেশি।
তিনি জানান, এর আগে চীন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে সীমান্ত বিরোধ দেখিয়ে এডিবির (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) ঋণ আটকে দিয়েছে।