বিলাসবহুল বিমানটি বিক্রির কোনো উপায় পাচ্ছিল না কাতার, তখনই নজরে আসে ট্রাম্পের

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের নিজস্ব বিমানবহর তথা এয়ারফোর্স ওয়ানে যুক্ত করার জন্য ২০১৮ সালেই মার্কিন সরকার ৩৯০ কোটি ডলার মূল্যে বিমাননির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং- এর থেকে দুটি নতুন বিমানের অর্ডার দেয়। তবে সেগুলো সময়মতো সরবরাহ করতে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়ে এভিয়েশন জায়ান্টটি। এই অবস্থায়, দীর্ঘসূত্রতা ও বিলম্বের কারণে ২০২৪ সালের ডেলিভারি সময়সীমা পেরিয়ে যায়। জানা যাচ্ছে, এমনকি সেটা বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদের বাইরেও গড়াতে পারে।
এ অবস্থায়, ট্রাম্প দ্রুত সমাধান চাইছিলেন তার এয়ার ফোর্স ওয়ান সংকটের।
কারণ, ট্রাম্পকে এখনো ৩৫ বছর পুরোনো সেই একই বিমানে ভ্রমণ করতে হচ্ছে, যেগুলো একসময়কার প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ.ডব্লিউ. বুশ ব্যবহার করতেন। প্রেসিডেন্টের জন্য এয়ারফোর্স ওয়ানের বিমান তৈরি যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের একটি জায়গা ছিল, কিন্তু এসব কারণে এ প্রকল্প আর যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের জায়গায় নেই, বরং পরিণত হয় এক সংকটে।
তাছাড়া প্রেসিডেন্টের জন্য নির্মিত বিশেষ এই ধরনের বিমানগুলো আর উৎপাদন সারিতেও নেই, ফলে বিদ্যমান বহরের প্রচুর সার্ভিসিং ও মেরামতের প্রয়োজন পড়ে। এজন্য রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় শিবির থেকেই বহু বছর ধরে প্রেসিডেন্টের জন্য নতুন বিমান সংগ্রহের দাবিও উঠছিল।
তবে ট্রাম্প চাচ্ছিলেন নিজের মেয়াদকালেই নতুন একটি বিমান পেতে—কিন্তু কীভাবে?
সম্প্রতি ট্রাম্প মন্তব্য করেন, "আমরা তো আমেরিকা। আমি মনে করি, আমাদের কাছে বিশ্বের সবচেয়ে চমকপ্রদ বিমান থাকা উচিত।"
গোপন আলোচনায় তৈরি হয় এক অভিনব প্রস্তাব
ট্রাম্প প্রশাসন শেষে সিদ্ধান্ত নেয়, কাতারের কাছ থেকে বিলাসবহুল একটি বোয়িং ৭৪৭–৮ উপহার হিসেবে গ্রহণ করবে, যেটি এয়ার ফোর্স ওয়ান হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। ওয়াশিংটন ও দোহার মধ্যে কয়েক সপ্তাহের গোপন সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনাটি গড়ে ওঠে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং হোয়াইট হাউসের সামরিক অফিস দ্রুত সক্রিয় হয়, আর মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভেন উইটকফ এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধান অনুযায়ী, ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সামরিক কর্মকর্তারা আলোচনা শুরু করেন, কীভাবে বোয়িংয়ের ধীরগতির কাজের মধ্যে বিকল্প বিমান কেনা যায়। তবে ১১ মে, সামাজিক মাধ্যমে ট্রাম্প ঘোষণা দেন, কাতার একটি বিমান "উপহার বা বিনামূল্যে" দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে।

এনিয়ে এখনো চূড়ান্ত চুক্তি সই না হলেও, প্রেসিডেন্টের ব্যবহারের উপযোগী করে বিমানটি পুনঃনির্মাণ ও পরিচালনার দীর্ঘমেয়াদি ব্যয় প্রশ্ন তুলছে এর আর্থিক যৌক্তিকতা নিয়ে।
ওয়াশিংটনের উভয় দলের আইনপ্রণেতা ও নীতিনৈতিকতা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা এ উদ্যোগের সমালোচনা করেছেন— এবং বলছেন, এটি হয় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য সরাসরি উপহার, নয়তো (যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের ওপর) কাতারের প্রভাব বিস্তারের কৌশল।

বাজারে মাত্র আটটি উপযুক্ত বিমান ছিল
প্রেসিডেন্টের ভ্রমণ তদারককারী হোয়াইট হাউস মিলিটারি অফিস, বোয়িং ও প্রতিরক্ষা দপ্তরকে নিয়ে যে তালিকা তৈরি করে, তাতে বিশ্বের মধ্যে মাত্র আটটি বিমানের নাম উঠে আসে—যেগুলো আধুনিক বোয়িং ৭৪৭, এবং এসব বিমানকে বিলাসবহুল অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা ও সরঞ্জাম যুক্ত করে দ্রুততম সময়ে প্রেসিডেন্টের বিমান হিসেবে রূপান্তর করা যাবে।
এই তালিকায় ছিল কাতারের একটি দ্বিস্তরবিশিষ্ট জাম্বো জেট, যা দেশটির রাজপরিবার একসময় ব্যবহার করত এবং ২০১৮ সালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে কাতার একই মডেলের আরেকটি বিমান উপহার দিয়েছিল।

উল্লেখ্য, স্টিভেন উইটকফের সুসম্পর্কর ইতিহাস রয়েছে কাতারের শাসকদের সঙ্গে। ট্রাম্পের পুরোনো মিত্র উইটকফও ট্রাম্পের মতো আবাসনখাতের একজন ব্যবসায়ী ছিলেন, ২০২৩ সালে উইটকফ একটি আবাসন ব্যবসার চুক্তি করে যখন লোকসানের মুখে পড়েন— তখন কাতারের স্বার্বভৌম সম্পদ তহবিলের বিনিয়োগই তাকে উদ্ধার করেছিল।
তিনিই কাতারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিমানটির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ হন ট্রাম্প
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি, কাতার সম্মত হয় বিমানটি ফ্লোরিডায় পাঠাতে, ট্রাম্প সেসময় ফ্লোরিডায় তাঁর বিলাসবহুল মার-আ-লাগো রিসোর্টে অবস্থান করছিলেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি, শনিবার সকালে বিমানটি দোহা থেকে সরাসরি ফ্লাইটে ওয়েস্ট পাম বিচ বিমানবন্দরে পৌঁছায়। ট্রাম্প সকাল ১০টার দিকে বিমানবন্দরে যান, এবং বিমানের ভেতরে চোখ বুলিয়ে মুগ্ধ হয়ে পড়েন।
বিমানটির সুযোগ-সুবিধা উল্লেখ করা একটি ব্রোশারে বলা হয়েছিল, এর শয়নকক্ষে ছিল "সর্বোচ্চ মানের নরম কাপড়", অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জায় রয়েছে "বিলাসবহুল চামড়া ও উৎকৃষ্ট কাঠের কাজ", এবং "প্রায় শিল্পকর্মসদৃশ" বাথরুম।
টপ ডেকে ছিল লাউঞ্জ ও যোগাযোগ কেন্দ্র, আর প্রধান বেডরুমটিকে প্রয়োজন হলে হাসপাতালের মতো মেডিকেল ইউনিটে রূপান্তর করাও যায়। বিমানের একটি অংশে ছিল ১২টি রিক্লাইনিং আসনসহ "বিজনেস ক্লাস"।

"এটা এক বিশাল দানব," মন্তব্য করেন এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার মার্ক ফোলক্রড, যিনি এক সময় বিমানটি বিক্রিতে সহায়তা করছিলেন।
তবে ৭৪৭-৮ জাম্বো জেটটির চারটি ইঞ্জিনের উচ্চ রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য খরচের কারণে বিমানসংস্থাগুলো এতে আগ্রহী হয়নি।
যদি শুধু চার্টার ফ্লাইটের খরচ হিসাব করা হয়, তাতেও বিমানটি আমেরিকায় উড়িয়ে আনা এবং ট্রাম্পকে দেখানোর প্রক্রিয়াতেই খরচ হয়েছে প্রায় ১০ লাখ ডলার।
হোয়াইট হাউসের ভাষ্য অনুযায়ী, ট্রাম্পের বিমানটি পরিদর্শনের উদ্দেশ্য ছিল বোয়িংকে তাদের প্রকল্প ত্বরান্বিত করতে চাপ দেয়া।
আলোচনায় গতি আসে
ওয়াশিংটনে ফিরে আসার পর, ট্রাম্প বিমানের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যে এতটাই মুগ্ধ হন যে তা যেন তার নিজের হয়ে গেছে, এমন আচরণ করেন। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারাও ভাবতে থাকেন—এর রঙ বদল এবং কিছু আপগ্রেডেই এটি আগামী এক বছরের মধ্যে ব্যবহারযোগ্য হতে পারে।
এই সময় থেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা আরও গতি পায়। হোয়াইট হাউসের কাছে তখন বোয়িংয়ের প্রকল্পটি দ্বিতীয় অবস্থানে চলে যায়। আর ধনকুবের ইলন মাস্ককে দায়িত্ব দেওয়া হয় বোয়িংকে চাপ দিতে।
কিন্তু মার্কিন বিমান বাহিনীর পূর্বাভাস—২০২৭ সালের আগে (বোয়িংয়ের) নতুন এয়ার ফোর্স ওয়ান প্রস্তুত হবে না।
কাতারের উপহার না বিক্রয়?
বিমানটি "উপহার" হিসেবে উল্লেখ করা হলেও, কাতার এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, কাতার শুধুমাত্র সরকারের সঙ্গে সরকার পর্যায়ের চুক্তিতে "কোনো চার্জ ছাড়াই" হস্তান্তরের জন্য সম্মত হতে পারে বলে জানিয়েছিল।
এদিকে, ট্রাম্প বারবার দাবি করেছেন, এটি তার ব্যক্তিগত নয়, প্রতিরক্ষা দপ্তরের জন্য দেওয়া হচ্ছে, এবং পরবর্তীতে তার প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরিতে স্থান পাবে। তবে মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই এটি হয়ে উঠতে পারে বিপুল মূল্যের এক বিদেশি উপহার।
ঝুঁকি ও জটিলতা
বোয়িংয়ের ৭৪৭-৮ মডেল বিমানে যেসব সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকে—যেমন পারমাণবিক বিস্ফোরণের তড়িৎচুম্বকীয় বা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালস থেকে সুরক্ষা, মিসাইল প্রতিরোধ ব্যবস্থা, গোপন তথ্য বিনিময়ের ব্যবস্থা—এইসব কাতারের বিমানটিতেও যুক্ত করতে হবে।
এই রেট্রোফিটের খরচ ১০০ কোটি ডলারের কম হবে না বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা। এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার মার্ক ফোলক্রড বলেন, এই রূপান্তরে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে— ফলে ২০২৭ সালের আগে এটি ব্যবহারযোগ্য হবে না।
বর্তমানে বিমানটি স্যান আন্তোনিওতে অবস্থান করছে। কংগ্রেস এখনো পর্যন্ত এসংক্রান্ত কোনো নতুন বাজেট অনুমোদন দেয়নি।
হোয়াইট হাউস বলছে, এল৩হ্যারিস নামের সামরিক ঠিকাদার সংস্থাকে বিমানটির রেট্রোফিটের কাজ দেওয়া যেতে পারে, তবে এজন্য অর্থ কীভাবে আসবে বা মোট খরচ কত হবে, তা এখনো অনির্ধারিত।
মিত্রতা নাকি প্রভাব বিস্তার?
কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এটি ছিল "সরকার থেকে সরকারের মধ্যে স্বাভাবিক স্থানান্তর", এবং (যুক্তরাষ্ট্রের ওপর) প্রভাব বিস্তারের কোনো প্রচেষ্টা নয়।
প্রতিরক্ষা দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আল উদেইদ বিমানঘাঁটির জন্য কাতার ৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং এখন আরও এক হাজার কোটি ডলার খরচ করতে যাচ্ছে।
ব্যয়ের বোঝা
যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য সাবেক সহকারী প্রতিরক্ষা সচিব অ্যান্ড্রু হান্টার বলেন, বিমানটি হস্তান্তর হোক ক্রয় বা উপহারের মাধ্যমে—এটি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের জন্য বিশাল ব্যয়ের বোঝা হয়ে উঠবে।
শুধু ক্রু পরিচালনার বার্ষিক খরচই প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার হবে। এবং পুরো বিমান পরিচালনার বার্ষিক খরচ দাঁড়াবে ১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
"এই বিমান পরিচালনার ব্যয় এতটাই বেশি যে, কোনো দেশ বা বড় কোনো এয়ারলাইন্স ছাড়া কেউই এটি চালাতে সক্ষম নয়," বলেন হান্টার। "এটি অবিশ্বাস্য রকম ব্যয়বহুল।"