পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপের আগেই ট্রাম্পের সঙ্গে ইইউ ও যুক্তরাজ্যের নেতাদের আলোচনা

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ফ্রান্স এবং জার্মানির নেতাদের সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন। আজ সোমবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফোনালাপের আগেই এই আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে।
মুখপাত্র জানিয়েছেন, নেতারা নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতির প্রয়োজনীয়তা এবং পুতিনকে শান্তি আলোচনাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে বলেছিলেন। তিনি আরও বলেন, যদি রাশিয়া যুদ্ধবিরতি ও সমন্বিত শান্তি আলোচনায় সুষ্ঠু ভাবে অংশ না নেয়, তাহলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার বিষয়টিও নেতারা উত্থাপন করেছেন।
গতকাল রোববার সকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎর্স বলেন, তিনি ভ্যাটিকানে পোপ লিও চতুর্দশের অভিষেক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সময় মার্কো রুবিওর সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন। মেৎর্স আরও জানান, তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ভ্যাটিকানে দীর্ঘ সময় কথা বলেছেন।
জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎর্স বলেন, 'আমি মার্কো রুবিওর সঙ্গে কথা বলেছি, যার মধ্যে আগামীকালের ফোনালাপ সম্পর্কেও আলোচনা হয়েছে। এ ফোনালাপের আগে প্রস্তুতি স্বরূপ আমরা চার নেতা মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলব।'
ট্রাম্প বলেছেন, তিনি পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলার পরিকল্পনা করছেন যাতে যুদ্ধের 'রক্তপাত' বন্ধ করার বিষয়ে আলোচনা করা যায়।
মস্কোতে, ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ রুশ সংবাদ সংস্থাগুলোকে নিশ্চিত করেছেন যে পুতিন ও ট্রাম্পের মধ্যে কথোপকথনের প্রস্তুতি চলছে।
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে গত শুক্রবার হওয়া আলোচনা ছিল ২০২২ সালের পর দুই পক্ষের প্রথম মুখোমুখি বৈঠক।
সংক্ষিপ্ত আলোচনায় দুই পক্ষের প্রতিনিধিদের এক হাজার বন্দি বিনিময়ের জন্য একটি চুক্তি হয়েছে। একে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সবচেয়ে বড় বন্দি বিনিময় হিসেবে ধরা হচ্ছে।
একজন উচ্চ পর্যায়ের ইউক্রেনীয় কর্মকর্তা দুই পক্ষের বৈঠক সম্পর্কে বলেন, রুশ প্রতিনিধিরা ইউক্রেনকে রাশিয়ার দখলকৃত ইউক্রেনীয় অঞ্চল থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার দাবি তুলেছে। সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করলে তারা যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হবে।
এদিকে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি পোপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে দেখা করেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার সময় প্রকাশ্যে মতবিরোধের পর এটি ছিল ভ্যান্স ও জেলেনস্কির প্রথম বৈঠক।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আশঙ্কা করছে ইউক্রেন
ইউক্রেন আশঙ্কা করছে, রোববার রাতে রাশিয়া ইউক্রেন ও তার পশ্চিমা মিত্রদের ভয় দেখাতে একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা করছে।
ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জিইউআর জানিয়েছে, রাশিয়া 'প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধ প্রস্তুতি' হিসেবে এই ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
জিইউআর টেলিগ্রাম অ্যাপে একটি বিবৃতিতে বলেছে, রাশিয়া সভার্দলোভস্ক অঞ্চল থেকে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের নির্দেশ দিয়েছে, এবং ক্ষেপণাস্ত্রটির উড়ানের পরিসর ১০ হাজার কিলোমিটারের (৬ হাজার২০০ মাইল) বেশি।
রোববার ইউক্রেন জানিয়েছে, রাশিয়া রাতে রেকর্ড সংখ্যক ড্রোন হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে রাজধানীও রয়েছে। ঘটনায় একজন নারী নিহত হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে।
কিয়েভ থেকে আল জাজিরার প্রতিবেদক জেইন বাসরাভি বলেন, ইউক্রেনে রাতভর বিমান সতর্কতা জারি করা হয়েছিল এবং তা প্রায় ৯ ঘণ্টা বহাল ছিল।
বাসরাভি বলেন, 'আমরা আবারও এই ব্যাপক ড্রোন হামলা দেখতে পাচ্ছি এবং রাজধানী ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের গভীর ভূগর্ভস্থ মেট্রোর স্টেশনগুলোতে আশ্রয় নেওয়া মানুষের ভিড় দেখতে পাচ্ছি।'
বেসামরিক নাগরিকদের ইচ্ছাকৃত হত্যা
রাশিয়ান সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা রাতভর ও রোববার সকালে ২৫টি ইউক্রেনীয় ড্রোন আটকিয়েছে। রাশিয়া আরও দাবি করেছে যে, তারা পূর্ব ইউক্রেনের ডোনেটস্ক অঞ্চলের আরও একটি গ্রাম বহাতির দখল নিয়েছে।
ইউক্রেনের কর্মকর্তারা রাশিয়ার রাতভর ড্রোন হামলার কঠোর নিন্দা জানান।
রুশ ড্রোন শনিবার উত্তরপূর্ব ইউক্রেনের সুমি অঞ্চলে ৯জন বাসযাত্রী হত্যা করার পর, জেলেনস্কি মস্কোর বিরুদ্ধে আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, 'এটি ছিল নিরীহ নাগরিকদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ড।'
জেলেনস্কি বলেছেন, 'হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। কঠোর নিষেধাজ্ঞা এবং জোরালো চাপ ছাড়া, রাশিয়া বাস্তব কূটনীতি অনুসরণ করবে না।'
তবে রাশিয়া নিরীহ নাগরিকদের হত্যার কথা অস্বীকার করেছে। তারা দাবি করেছে, সুমিতে তারা একটি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে যে পূর্ব ইউক্রেনে আরেকটি বসতি দখল করা হয়েছে।
জেলেনস্কির প্রধান সহকারী আন্দ্রিয় ইয়েরমাক এই হামলাগুলোর নিন্দা জানিয়ে বলেন, 'রাশিয়ার জন্য ইস্তাম্বুলে আলোচনাগুলো শুধুই ছলনা। পুতিন যুদ্ধই চায়।'
রাশিয়ার লক্ষ্য 'স্থায়ী শান্তির জন্য পরিস্থিতি তৈরি করা'
রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পুতিন বলেন, মস্কোর লক্ষ্য হলো 'এই সংকটের কারণগুলো দূর করা, স্থায়ী শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং রাশিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।' তবে তিনি এর বাইরে আরও কিছু বলেননি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আঘাতের মূল কারণ হিসেবে যে বিষয়গুলোকে নির্দেশ করে তার বেশিরভাগ কিয়েভ ও পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে।
এর মধ্যে রয়েছে ইউক্রেনকে নাৎসি-মুক্ত ও সামরিকীকরণ মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি। এর মাধ্যমে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের রুশ ভাষাভাষীদের সুরক্ষা দেওয়া ও ন্যাটোর সম্প্রসারণ রোধ করা এবং ইউক্রেনের পশ্চিমমুখী ভূরাজনৈতিক ধারা থামানোই মূল লক্ষ্য।
ইউক্রেন ও পশ্চিমারা এসব সব যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তারা বলেছে, রাশিয়ার আক্রমণ কেবল একটি সাম্রাজ্যবাদী ভূমি দখলের প্রচেষ্টা।
রাশিয়া যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে এ পর্যন্ত দশ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং কোটি কোটি মানুষ তাদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, মার্কো রুবিও এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই লাভরভ শনিবার একে অপরের সঙ্গে কথা বলেছেন। ওই ফোনালাপে, রুবিও ইস্তাম্বুল সমঝোতা হওয়া বন্দি বিনিময়কে স্বাগত জানিয়েছেন বলে ওই বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
ইউক্রেনের প্রধান আলোচনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রুস্তেম উমেরভ বলেছেন, 'পরবর্তী পদক্ষেপ' হবে দুই যুদ্ধরত প্রেসিডেন্টের মধ্যে।
রাশিয়া এই অনুরোধটি নোট করেছে, তবে বন্দি বিনিময় আগে সম্পন্ন হতে হবে এবং এরপর দুই পক্ষই অস্ত্রবিরতির জন্য তাদের পরিকল্পনা উপস্থাপন করবে, তারপর পরবর্তী আলোচনার ব্যবস্থা করা হবে।