ইইউ কীভাবে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি নিষিদ্ধ করবে?

ইউরোপীয় কমিশন আগামী মাসে এমন একটি প্রস্তাব আনতে চলেছে, যার লক্ষ্য ২০২৭ সালের মধ্যে ইইউভুক্ত দেশসমূহে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা এবং চলতি বছরের মধ্যেই মস্কোর সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি গ্যাস চুক্তিও নিষিদ্ধ করা।
রাশিয়ান প্রাকৃতিক গ্যাস ও তরলীকৃত গ্যাস (এলএনজি) নিষিদ্ধ করার সবচেয়ে সরল আইনি পথ হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা। তবে এজন্য ইইউ-র ২৭টি সদস্য দেশের সর্বসম্মতির প্রয়োজন হওয়ায় এটি বাস্তবায়ন করাটা কঠিন।
হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া, যারা রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, তারা গ্যাস নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাবটি আটকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই দুই দেশ টার্কস্ট্রিম পাইপলাইন দিয়ে রাশিয়ান গ্যাস আমদানি করে এবং তাদের মতে, বিকল্প ব্যবস্থায় গেলে জ্বালানি খরচ বেড়ে যাবে।
বিকল্প ব্যবস্থা কী?
এই প্রতিবন্ধকতা এড়াতে, ইউরোপীয় কমিশন জুন মাসে এমন কিছু বিকল্প আইনি পদক্ষেপ প্রস্তাব করবে— যার জন্য পূর্ণ সর্বসম্মতি লাগবে না। এগুলো অনুমোদনে "রিইনফোর্সড মেজরিটি" বা শক্তিশালী সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হবে, অর্থাৎ অন্তত ৪টি দেশ একসঙ্গে বিরোধিতা না করলে তা কার্যকর হবে।
ইইউ কূটনীতিকদের মতে, সম্প্রতি এক গোপন বৈঠকে হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া বাদে ইইউভুক্ত সব দেশ রাশিয়ান গ্যাস নিষিদ্ধের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছে। যদিও কেউ কেউ এর আইনি ভিত্তি ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
যদি নিষেধাজ্ঞা না হয়, তাহলে কী?
ইইউ এখনও নির্দিষ্ট করে বলেনি কী ধরনের আইনি পদ্ধতি তারা ব্যবহার করবে। তবে কূটনীতিকরা সম্ভাব্য কিছু পদ্ধতি উল্লেখ করেছেন:
শুল্ক: রাশিয়ান গ্যাস ও এলএনজিতে শুল্ক আরোপ করা হতে পারে, যা নিষেধাজ্ঞা না হলেও নতুন চুক্তিকে আর্থিক বিচারে অকার্যকর করে তুলবে। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ান সার আমদানিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমন একটি শুল্ক আরোপ করছে— যা তিন বছরের মধ্যে প্রতি টনে ৪৩০ ইউরোতে পৌঁছাবে—এটি এমন এক স্তর যা বাস্তবিক অর্থে আমদানি বন্ধেরই সমতুল্য।
ফোর্স ম্যাজর: শুল্ক আরোপের ফলে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো যুক্তি দেখাতে পারে যে, নতুন বিধিনিষেধের কারণে তাদের রাশিয়ার সঙ্গে পুরনো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি অব্যাহত রাখা অসম্ভব, ফলে তারা "ফোর্স ম্যাজর"-এর আওতায় সেসব চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। তবে আইনজীবীরা সতর্ক করেছেন যে এতে আর্থিক জরিমানার ঝুঁকি রয়েছে।
নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করবে কীভাবে?
নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার জন্য রাশিয়ান গ্যাস বাণিজ্য সম্পর্কে আরও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে। এজন্য ইউরোপীয় কমিশনের "ইউনিয়ন ডাটাবেস" নামক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা যেতে পারে, যা বর্তমানে বায়োফুয়েল আমদানির তথ্য ট্র্যাক করে। এই প্ল্যাটফর্মকে রাশিয়ান গ্যাস পর্যবেক্ষণের জন্য পুনঃনির্দেশ করা হতে পারে, যাতে কারা এই গ্যাস বাণিজ্যে জড়িত তা চিহ্নিত করা যায়।
জুন মাসে কমিশনের প্রস্তাবে কোম্পানিগুলোর রাশিয়ান গ্যাস চুক্তির বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ— বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাবও থাকবে।
@কারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে?
ইউরোপে রাশিয়ান গ্যাস আমদানির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হয় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায়, যেগুলো ২০২৭ সালের মধ্যে বাতিল করার পরিকল্পনা আছে। বাকি অংশ আসে স্বল্পমেয়াদি বা স্পট মার্কেট থেকে ক্রয়ের মাধ্যমে।
২০২৩ সালে রাশিয়া ইউরোপের গ্যাস আমদানির ১৯ শতাংশ সরবরাহ করেছে, যা ২০২২ সালের আগের ৪৫ শতাংশ থেকে অনেক কম। ২০২৪ সালের শেষে ইউক্রেনীয় পাইপলাইন দিয়ে রাশিয়ান গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর – ২০২৫ সালে এই হার ১৩ শতাংশে নেমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সবচেয়ে প্রভাবিত দেশগুলোর মধ্যে আছে;
অস্ট্রিয়া, দেশটি আগে ইউক্রেন হয়ে রাশিয়ান গ্যাস পেত, এখন জার্মানি ও ইতালি হয়ে অন্যান্য উৎস থেকে গ্যাস নিচ্ছে।
হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ার জন্য বিকল্পে যাওয়া ব্যয়বহুল হবে। কারণ রাশিয়ান গ্যাস আমদানি গত বছর অন্যান্য বিকল্পের চেয়ে ১৩-১৫ শতাংশ সস্তা ছিল।
বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও স্পেন মূলত রাশিয়ান এলএনজি আমদানি করে, তবে এই আমদানি তুলনামূলকভাবে সহজেই যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য উৎস থেকে প্রতিস্থাপনযোগ্য।
তবে কিছু রাশিয়ান এলএনজি চালান এখনো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় আছে, যেগুলো ২০৪১ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকার কথা। এই ধরনের চুক্তিতে যুক্ত আছে টোটালএনার্জিস,এসইএফই, এবং ন্যাচারর্জি-এর মতো কোম্পানিগুলো।
মোদ্দা কথা, ইইউ সরাসরি নিষেধাজ্ঞার পথে যেতে না পারলেও বিকল্প আইনগত পন্থা, শুল্ক আরোপ ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ধাপে ধাপে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমাতে চায়। ২০২৭ সালের মধ্যে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথেই ইউরোপ এগিয়ে যাচ্ছে।