৬ বিমা কোম্পানির আত্মসাৎ ৩,৭৩৬ কোটি টাকা, গ্রাহক সুরক্ষায় নতুন আইনের পরিকল্পনা

গ্রাহকদের প্রিমিয়ামের অর্থ রক্ষা করারই কথা বিমা কোম্পানির, কিন্তু ছয়টি কোম্পানি করেছে সম্পূর্ণ বিপরীত; প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকরা সেই অর্থ বিনিয়োগের নামে আত্মসাৎ করেছেন বলে রয়েছে অভিযোগ।
এই কোম্পানিগুলো হলো– ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বাইরা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স, সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স; গত বছরের ডিসেম্বরে পর্যন্ত এসব কোম্পানির কাছে গ্রাহকদের পাওনা ছিল মোট ৩,৭৩৬ কোটি টাকা।
এই পরিস্থিতিতে আত্মসাৎ করা প্রিমিয়ামের অর্থ পুনরুদ্ধারের জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) একটি নতুন আইন প্রণয়নের পরিকল্পনা করছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
ব্যাংক রেজ্যুলেশন অর্ডিন্যান্স এর আদলে 'ইন্সুরেন্স রেজ্যুলেশন অর্ডিন্যান্স' প্রণীত হবে, এর মাধ্যমে এসব বিমা কোম্পানির স্পন্সর ডিরেক্টরদের সম্পদ বিক্রি করে অর্থ উদ্ধার এবং দেউলিয়ার পথে থাকা কোম্পানিগুলোর মালিকানা পরিবর্তনসহ অবসায়ন বা অন্য কোম্পানির সঙ্গে মার্জ করা যাবে।
এছাড়া, এসব কোম্পানির গ্রাহকদের জমা করা প্রিমিয়ামের অর্থের পুরোটা কিংবা আংশিক ফেরত দেওয়ার জন্য সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি হিসেবে অর্থ বরাদ্দ নেওয়া এবং কোম্পানিগুলোর অনুকূলে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। আইডিআরএ'র চেয়ারম্যান ড. এম আসলাম আলম টিবিএসকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আসলাম আলম টিবিএসকে বলেন, 'ব্যাংক রেজ্যুলেশন অর্ডিন্যান্স এর মাধ্যমে যেভাবে ব্যাংকগুলোর মালিকানা পরিবর্তন করার বিধান করা হয়েছে, একইভাবে ইন্সুরেন্স রেজ্যুলেশন অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে এসব কোম্পানির মালিকানাতেও পরিবর্তন আনা হবে। এছাড়া, অর্থ আত্মসাৎকারী ডিরেক্টরদের ব্যক্তিগত সম্পদ বিক্রি করে আত্মসাত করা অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করা হবে।'
তিনি বলেন, দেউলিয়ার পথে থাকা ১০টি ব্যাংক বাঁচাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি তহবিল যোগান দিয়েছে। কিন্তু সংকটগ্রস্ত বিমা কোম্পানির জন্য আইডিআরএ'র তহবিল সহায়তা দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। আইডিআরএ থেকে 'ব্যাংক আমানত সুরক্ষা আইন' এর মতো একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ভালো ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলোর আপত্তির কারণে তা করা সম্ভব হচ্ছে না।
'আমরা চেষ্টা করছি, যাতে সরকার ভর্তুকি হিসেবে বাজেটে গ্রাহকদের পাওনা অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য বরাদ্দ রাখে। তা নাহলে এসব কোম্পানির নামে যাতে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়, যেখান থেকে গ্রাহকদের পাওনার অন্তত একটা অংশ ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়' - বলেন তিনি।
ইতোমধ্যে সানলাইফ ইন্সুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার কিনে এর মালিকানা নিয়েছে গ্রীণ ডেল্টা ইন্সুরেন্স। কোম্পানি দু'টির মধ্যে আনুষ্ঠানিক একটি চুক্তিও হয়েছে।
ব্যাংকের মতোই জালিয়াতি বিমা কোম্পানিতে
আইডিআরএ চেয়ারম্যান বলেন, 'ঋণের নামে বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকরা যেমন টাকা তুলে নিয়েছেন, তেমনি ছয়টি লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির মালিকরা বিনিয়োগের নাম করে গ্রাহকদের জমা করা প্রিমিয়ামের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। কাগজে-কলমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের কথা বললেও বাস্তবে তারা কোথাও তা বিনিয়োগ করেনি।'
পদ্মা লাইফ ইন্সুরেন্সের দেনা প্রায় ২৫০ কোটি, বায়রা লাইফ ইন্সুরেন্সের দেনা ৭৮ কোটি, সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্সুরেন্সের দেনা ৫৬৩ কোটি টাকা এবং সানলাইফ ইন্সুরেন্সের দেনা ৫৫ কোটি টাকা। গোল্ডেন লাইফ ইন্সুরেন্সের দেনার সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যায়নি। তবে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটির দেনার পরিমাণ ছিল ৩৭ কোটি টাকা।
ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বোচ্চ দেনা হচ্ছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্স- এর। যার পরিমাণ প্রায় ২,৭৫৩ কোটি টাকা।
আসলাম আলম জানান, 'ফারইস্ট সারাদেশে শাখা খুলে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত বা প্রিমিয়াম সঞ্চয় সংগ্রহ করে তা আত্মসাত করার পর শাখাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। এই কোম্পানিটি চলার মতো অবস্থায় নেই। অন্য পাঁচটি কোম্পানিও দেউলিয়া হওয়ার পথে।'
ফারইস্ট ইসলামী লাইফের ওপর করা এক বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসে কোম্পানিটি থেকে ২ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। এর বাইরে অনিয়ম হয়েছে ৪৩২ কোটি টাকার। কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, সাবেক পরিচালক এম এ খালেক, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. হেমায়েত উল্লাহ এবং শীর্ষ পর্যায়ের অন্য কর্মকর্তারা এ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটান বলে দুনীতি দমন কমিশনের তদন্তে উঠে এসেছে।
বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে জমি কেনা, বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা ফারইস্টের মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিট (এমটিডিআর বা স্থায়ী আমানত) বন্ধক রেখে পরিচালকদের ঋণ নেওয়া ও ক্ষতিকর বিনিয়োগ—মূলত এই তিন উপায়ে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসে।
২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স ঢাকাসহ দেশের ১৪টি স্থানে জমি কেনে। এসব জমি কেনা হয় বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দামে। এর মধ্যে সাতটি জমি কেনা, ভবন নির্মাণ ও বালু ফেলার নামে ৬৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
যেমন মিরপুরের গোড়ান চটবাড়ির ৭৮৬ শতাংশ জমি ১৯৯ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে বলে হিসাবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু, এ জমি কেনা হয়েছে আসলে ১৯ কোটি টাকায়। ১৯৯ কোটি টাকার মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে চেক দেওয়া হয়েছে ৬৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকার। এরমধ্যে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং, কেডিসি কনস্ট্রাকশন ও মাহবুবা অ্যাসোসিয়েটকে চেকের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে ৪০ কোটি টাকা ও রেজিস্ট্রেশন খরচ বাবদ চেকে দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। বাকি টাকা দেওয়া হয়েছে নগদে।
অন্যান্য জালিয়াতির মধ্যে কোম্পানির ৭২ কাকরাইলের জমি কেনায় ১৬০ কোটি এবং গুলশান নর্থ অ্যাভিনিউয়ের জমি কেনায় ৮৯ কোটি, গুলশানের আরও দুই জমিতে ৮০ কোটি এবং বরিশালের আলেকান্দায় এক জমি কেনায় ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
জমি ক্রয়ের তিনটি দলিল সংগ্রহ করে দেখা গেছে, কাকরাইলের জমি কেনা হয়েছে নজরুল ইসলামের শ্বশুর মো. মফিজুল ইসলাম ও স্ত্রীর ভাই সেলিম মাহমুদের কাছ থেকে। জমি বিক্রির পর নজরুল ইসলামের স্ত্রী তাছলিমা ইসলামকে ১১৫ কোটি টাকা উপহার দেন মফিজুল ইসলাম ও সেলিম মাহমুদ। তাছলিমা ইসলাম আবার সেখান থেকে ৫০ কোটি টাকা উপহার দেন তাঁর স্বামী নজরুল ইসলামকে। নজরুল ইসলাম বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিপাকে
২০২৫ সালের মার্চ মাসে আইডিআরএ ছয়টি বিমা কোম্পানির পরিচালকদের সঙ্গে একটি গভর্ন্যান্স পর্যালোচনা সভা করে। সভায় আইডিআরএ চেয়ারম্যান গ্রাহকের বকেয়া দাবি দ্রুত পরিশোধের জন্য কোম্পানিগুলোকে আহ্বান জানান। আগেই ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত এসব কোম্পানিকে বকেয়া পরিশোধে একাধিকবার চাপ দিলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।
এপ্রিলে আইডিআরএ গ্রাহকের বকেয়া দাবিগুলো পরিশোধে একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় এই ছয়টি বিমা কোম্পানিকে। যেহেতু তারা পলিসি গ্রহণকারীদের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে, তাই কর্তৃপক্ষ তাদের আগামী তিন মাসে কত টাকা পরিশোধ করতে পারবে এবং আর্থিক চ্যালেঞ্জগুলো কী কী—সে বিষয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা জমা দিতে বলে।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের বিমা খাতে নানা অনিয়ম ও গ্রাহক হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। গত সরকারগুলোর সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর বিমা কোম্পানি লাইসেন্স পায়।
এখাতে শুরুতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করলেও, ২০১০ সালে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করে সরকার। তবে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বিমা কোম্পানিগুলোর দাপটের কারণে আইডিআরএ'র কোন চেয়ারম্যান স্বস্তিতে মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। অন্যদিকে, বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ গ্রাহক বিমা কোম্পানিগুলো থেকে তাদের পাওনা অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না।
আইডিআরএ চেয়ারম্যান বলেন, 'গ্রাহকরা মাসের পর মাস ধরে ঘুরেও টাকা ফেরত পাচ্ছে না। এসব কোম্পানি প্রায় দেউলিয়া হওয়ার মতো।'
বাংলাদেশ ইন্সুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) এর প্রেসিডেন্ট সাঈদ আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'দুর্বল কোম্পানিগুলোকে একীভূত বা অবসায়নের ক্ষেত্রে সরকার কোন ধরণের পলিসি গ্রহণ করছে, তা আমাদের জানা নেই। তাই এখনই এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে, বেশিরভাগ কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। মার্জ বা অবসায়নের অধ্যাদেশ করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থরক্ষার দিকে নজর রাখতে হবে।'