তুরস্কে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সম্ভাব্য শান্তি আলোচনা নিয়ে যা জানা গেল

তিন বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মস্কো, কিয়েভ, ওয়াশিংটন, রিয়াদের পাশাপাশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বহুবার আলোচনা হয়েছে। তবে কোনো আলোচনার মধ্যে দিয়েই চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়নি। এবার আলোচনা তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার শহরটিতে যুদ্ধরত দুই পক্ষের বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। এই বৈঠক বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কতটুকু কার্যকরী হবে- সেই প্রশ্নে এখন নজর সবার।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইস্তাম্বুলে আগামীকাল বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়েছেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও এ প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে সামনাসামনি আলোচনার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন।
এদিকে পুতিন নিজে থেকে সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব দিলেও এতে রাশিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে কারা অংশ নেবেন, সেটি এখনও নিশ্চিত করেনি ক্রেমলিন। এমনকি প্রতিনিধি দলে পুতিন থাকছেন কি না, সেটিও স্পষ্ট করেনি।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, জেলেনস্কি শুধু পুতিনের সঙ্গেই বসবেন। গতকাল মঙ্গলবার জেলেনস্কি বলেছেন, 'পুতিন যদি না আসেন, গড়িমসি করেন, তাহলে বোঝা যাবে, তিনি যুদ্ধ বন্ধ করতে চান না।'
কীভাবে তুরস্কে আলোচনার কথা উঠল?
গত শনিবার (১০ মে) কিয়েভে একত্র হন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রেডরিক মের্ৎস ও পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক। তারা একমত হয়ে গত সোমবার (১২ মে) থেকে পরবর্তী ৩০ দিনের জন্য যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান।
ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এ প্রস্তাবে সমর্থন দেন। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্যাম্পেইনে ট্রাম্প দ্রুত সময়ের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পুতিন এই প্রস্তাব না মানলে রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যে আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আসবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ওইসব দেশের নেতারা।
তবে রোববার সকালে গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পুতিন এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এর পরিবর্তে তিনি ইউক্রেনের সঙ্গে ইস্তাম্বুলে কোনো ধরনের পূর্বশর্ত ছাড়াই সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব দেন। তবে এ আলোচনায় তিনি নিজে অংশ নেবেন কি না, সেটি স্পষ্ট করেননি।
পুতিনের এই প্রস্তাবের জবাবে জেলেনস্কি যুদ্ধবিরতির ওপর জোর দেন। তিনি জানান, তিনি তুরস্কে যাবেন এবং পুতিনকেও সেখানে থাকতে হবে। তার ভাষ্যে, 'আমি বৃহস্পতিবার (তুরস্কে) পুতিনের জন্য অপেক্ষা করব, ব্যক্তিগতভাবে। আশা করি, এবার রাশিয়া কোনো অজুহাত খুঁজবে না।'
কারা যাচ্ছেন, আর কেনই বা যাচ্ছেন?
ইস্তাম্বুলের আলোচনায় রাশিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে কারা থাকছেন, সেই প্রশ্নে মুখ খোলেননি ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ। তিনি শুধু বলেছেন, পুতিন রাশিয়ার অবস্থান যথেষ্ট পরিষ্কার করেছেন।
চলতি বছরের মার্চে সৌদি আরবে ট্রাম্প প্রশাসন রাশিয়া ও ইউক্রেনকে নিয়ে আলাদা আলোচনা শুরু করেছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প প্রশাসন ইঙ্গিত দিয়েছে—সুস্পষ্ট অগ্রগতি না হলে তারা আলোচনার প্রক্রিয়া থেকে সরে আসতে পারে।
এ বৈঠকের বিষয়ে আশাবাদী ট্রাম্প। গত সোমবার ওয়াশিংটনে তিনি বলেন, 'পুতিন ও জেলেনস্কির মধ্যে ভালো বৈঠকের সম্ভাবনা আছে।'
প্রথমে তিনি জানিয়েছিলেন, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের পর তিনি নিজেও ইস্তাম্বুলে যাওয়ার কথা ভাবছেন। পরে অবশ্য তিনি বলেন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং অন্যান্য প্রতিনিধি তুরস্কে যাবেন।
ইউক্রেনীয় উপদেষ্টা পোদোলিয়াক গতকাল জানান, জেলেনস্কি ইস্তাম্বুলে শুধু পুতিনের সঙ্গেই বৈঠক করবেন। তিনি বলেন, 'প্রয়োজন হলে আমাদের দলের কিছু লোক রুশদের সঙ্গে আলাদা পর্যায়ে কথা বলতে পারেন, তবে তা অর্থহীন। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া থামানোর সিদ্ধান্ত একমাত্র পুতিনই নিতে পারেন।'
জেলেনস্কি আরও জানান, তিনি আগে আঙ্কারায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে বৈঠক করবেন। যদি পুতিন ইস্তাম্বুলেলে আসেন, তাহলে এরদোয়ানসহ তিনি সেখানে যাবেন।
তিনি যোগ করেন, তবে পুতিন না এলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ার ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।
২০২২ সালের ইস্তাম্বুল আলোচনায় যা হয়েছিল
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকে অর্থাৎ ২০২২ সালে ইস্তাম্বুলে শান্তি আলোচনা শুরু হলেও তা বেশি দূর এগোয়নি। রাশিয়া বলছে, এবার সেই আলোচনাই নতুন করে শুরু করতে চায় তারা।
ক্রেমলিন জানিয়েছে, ওই আলোচনায় ইউক্রেন ও পশ্চিমা দেশগুলো যুদ্ধ বন্ধে আন্তরিক ছিল না। অন্যদিকে, কিয়েভ বলেছে, রাশিয়ার প্রস্তাব আসলে দুই পক্ষের সম্মত হওয়া মতো ছিল না, ছিল একতরফা চাপিয়ে দেওয়া চূড়ান্ত কিছু শর্ত।
জেলেনস্কি জানান, ওই প্রস্তাবে রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেনের দোনবাস অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে, সংবিধানে পরিবর্তন এনে নিরপেক্ষতা ঘোষণা করতে, সেনা সংখ্যা উল্লেখজনকভাবে কমিয়ে আনতে ও দূরপাল্লার অস্ত্রের ব্যবহার না করার প্রস্তাব দিয়েছিল।
জেলেনস্কির সে সময় বলেছিলেন, 'এটা কোনো মীমাংসামূলক প্রস্তাব ছিল না, ছিল খুনির পক্ষ থেকে এক ধরনের আলটিমেটাম।'
তবে পুতিন পরে দাবি করেন, একটি শান্তিচুক্তি নিয়ে তখন দুই পক্ষ রাজি হয়েছিল, যেখানে ইউক্রেনের পারমাণবিক শক্তি নিরপেক্ষ অবস্থান ও সেনা সংখ্যা কমানো নিয়ে ধারা ছিল। কিন্তু কিয়েভ পরে সেই চুক্তি ফিরিয়ে দেয়।
ক্রেমলিন বারবার বলছে, 'ইস্তাম্বুল চুক্তি' পরবর্তী আলোচনার ভিত্তি হতে পারে। এরই মধ্যে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রাশিয়া অবৈধভাবে ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝিয়া দখলে নেয়। এরপর থেকে মস্কো দাবি করছে, কিয়েভকে এখন 'মাঠের বাস্তবতা' মেনে নিতে হবে।
যুদ্ধ বন্ধে কোন পক্ষ কী চায়
যুদ্ধ বন্ধে পুতিন গত বছর দাবি তোলেন যে ইউক্রেনকে চারটি অঞ্চল ছেড়ে দিতে হবে, যেগুলোর পুরো নিয়ন্ত্রণ এখনো রাশিয়ার হাতে নেই। এছাড়া ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়া উপদ্বীপকেও রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
পুতিন আরও চান, ইউক্রেন যেন ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার দাবি ছেড়ে দেয় এবং তাদের সেনাবাহিনী বড় পরিসরে কমিয়ে আনে। পাশাপাশি, ইউক্রেন আক্রমণের পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেগুলো তুলে নিতে হবে।
অন্যদিকে কিয়েভ বলছে, তারা কোনো জমি ছাড়বে না। বরং তারা চায় ভবিষ্যতে রাশিয়ার হামলা ঠেকাতে শক্ত নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
ট্রাম্পও যুদ্ধ থামাতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, ক্রিমিয়া 'রাশিয়ার সঙ্গেই থাকবে।' তার মতে, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনাও কম।
মাঠে যুদ্ধের পরিস্থিতি কেমন
দুই পক্ষই গরমের সময় বড় অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ যুদ্ধরেখায় একটানা সংঘাতে দুই পক্ষের লক্ষাধিক সেনা নিহত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার জানিয়েছে, রাশিয়া দ্রুত নতুন সেনা পাঠিয়ে সম্মুখসারি শক্ত করছে এবং নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখছে।
২০২৪ সালে এবং সাম্প্রতিক সময়েও রাশিয়া বিভিন্ন ফ্রন্টে ধীরে ধীরে অগ্রগতি করছে। মার্চে পুতিন বলেন, রুশ সেনারা 'গতি পেয়েছে' এবং 'সার্বিক নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আছে।'
অন্যদিকে জেলেনস্কির দাবি, রাশিয়া আলোচনাকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করছে, যাতে তারা বড় হামলার প্রস্তুতি নিতে পারে।
গত মাসে রাশিয়া দাবি করেছিল, তারা কুরস্ক সীমান্তের কিছু অংশ পুনরুদ্ধার করেছে, যা ২০২৪ সালের আগস্টে ইউক্রেন দখলে নিয়েছিল। যদিও কিয়েভ এ দাবি অস্বীকার করেছে। বাস্তবে সেখানে তারা ধীরে ধীরে জমি হারাচ্ছে। ওই অঞ্চলে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের সহায়তায় রাশিয়া বড় অগ্রগতি করেছে।
আংশিক যুদ্ধবিরতি চেষ্টা বহুবার ব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়া ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কার্যত প্রত্যাখ্যান করেছে। শুধু ইস্টার সানডে ও বিজয় দিবস উপলক্ষে দুবার স্বল্প সময়ের একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল রাশিয়া। একবার ৩০ ঘণ্টা, আরেকবার ৭২ ঘণ্টা। দুই পক্ষই একে অপরকে যুদ্ধ থামাতে না পারার জন্য দায়ী করছে।
এছাড়া, গত মার্চে দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ৩০ দিনের জন্য জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর হামলা বন্ধে সম্মত হয়েছিল। তবে বারবার একে অপরের ওপর চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলায় সেটিও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা