প্রাকৃতিক ঢাল: মৌচাক কীভাবে বাংলাদেশে হাতির সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্বের সমাধান দিতে পারে

বাংলাদেশের টেকনাফের কৃষক কান্তিলাল চাকমা (৩৫) প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে তার পরিবারের জন্য ফসল ফলান। কিন্তু তার এই পরিশ্রমের ওপর সবসময় একটা হুমকি থাকত—তা হলো হাতি। ক্ষুধা ও বনভূমি ক্রম বিলুপ্তির কারণে হাতির পাল প্রায়ই তার জমিতে হানা দিয়ে ফসল নষ্ট করত।
প্রতিবার হাতির হামলা তার স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দিত এবং ভবিষ্যতের স্বপ্নকে ধূলিস্যাৎ করত। জমি রক্ষার জন্য কান্তিলালের বহু চেষ্টার পরেও হাতির পাল ফিরে ফিরে আসত এবং তার পরিশ্রমকে ব্যর্থতায় পরিণত করত।
তবে এই পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যায়, কান্তিলাল যখন আইইউসিএন, বাংলাদেশ ও ইউএনএইচসিআর-এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত একটি প্রকল্প সম্পর্কে জানতে পারেন। ইউএনএইচসিআর-এর সহায়তায় এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।
এই প্রকল্পে কৃষকদের মৌচাষ শেখানো হয় এবং হাতি তাড়াতে মৌমাছিদের প্রাকৃতিক প্রতিরোধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়—কারণ হাতি স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতে মৌচাক এড়িয়ে চলে।
কান্তিলাল একবার চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি একটি মৌচাক দিয়ে শুরু করেন এবং আইইউসিএন-এর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ধীরে ধীরে মৌচাষের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার মৌচাকের সংখ্যা তিনটিতে বাড়ান।
প্রতি মৌসুমে মধু ও ফসল সংগ্রহের পাশাপাশি হাতির কারণে ফসলের ক্ষতি কম হওয়ায়, তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও আশাবাদী হয়ে ওঠেন। তার সংগ্রহ করা মধু ও ফসল শুধু তার পরিবারের খাদ্য হিসেবেই ব্যবহৃত হতো না; এগুলো তার আয়ের একটি উৎসও হয়ে দাঁড়ায়। এখন কান্তিলাল প্রতিবার যখন তার মৌচাকের পাশ দিয়ে হাঁটেন, তিনি এক ধরনের গর্ব অনুভব করেন।
কান্তিলাল বলেন, 'মৌচাষের ফলে সত্যিই আমার বাড়ির আশেপাশে হাতির আনাগোনা অনেক কমে গেছে। যেই আমগাছটিতে মৌচাক বসানো আছে, সেটিতে এখন ফল ফলছে, এই গাছের কোনো ধরনের ক্ষতি হয়নি। এতে করে আমার ফসল উৎপাদনও বেড়েছে—বিশেষ করে আম, সুপারি এবং অন্যান্য শাকসবজি। তার ওপর, আমি প্রায় ৮ কেজি মধু বিক্রি করতে পেরেছি।'
৪০ বছর বয়সী কৃষক মনসা চাকমা টেকনাফে বনাঞ্চলের একেবারে কাছাকাছি এলাকায় বসবাস করেন এবং তিনিও একই রকমের সমস্যার মুখোমুখি হতেন। হাতির দল প্রায়ই তার খামারে এসে ফসলের ক্ষতি করত এবং আশপাশে আতঙ্ক সৃষ্টি করত।
কান্তিলালের মতো মনসা নামের ওই নারী কৃষকও হাতির হাত থেকে তার জমি রক্ষার উপায় খুঁজছিলেন। তিনি মৌচাষ প্রকল্প সম্পর্কে জানতে পারার পর এতে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একই ধরনের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা পেয়ে মনসা তার বাড়ির চারপাশে নিজেই মৌচাক স্থাপন করেন। যদিও তিনি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছেন, তবুও এই নতুন পদ্ধতি তার খামার থেকে হাতিকে দূরে রাখবে এবং তার কৃষিজীবনে স্থিতিশীলতা আনবে বলে তিনি আশাবাদী।
মনসা বলেন, 'আমরা যেহেতু বনের কাছাকাছি থাকি, তাই আমাদের গ্রামে প্রায়ই হাতি ঘোরাফেরা করে। তবে মৌচাক বসানোর পর হাতিগুলো এখন সেই এলাকাগুলো এড়িয়ে চলছে।'

মানুষের সঙ্গে হাতির দ্বন্দ্ব এই অঞ্চলে একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা হিসেবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। ২০১৭ সালে ৭ লাখ ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর আসার পর থেকে তা আরও তীব্র হয়। তাদের নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে বনভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চল বসতিতে রূপান্তরিত হয়। এর ফলে হাতির প্রাকৃতিক চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং খাদ্য উৎস কমে আসে, যার ফলে তারা মানব বসতিতে ঢুকে পড়তে বাধ্য হয় এবং ঘন ঘন সংঘর্ষ হতে থাকে।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইউএনএইচসিআর-এর সহায়তায় আইইউসিএন. বাংলাদেশ বায়ো-ফেন্সিং ও মৌচাকভিত্তিক প্রাকৃতিক বেষ্টনী স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। এর উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় কৃষকদের ফসল রক্ষা এবং শরণার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
২০২১ সালে একটি সম্ভাব্যতা যাচাই গবেষণায় মৌচাক বেষ্টনীর জন্য উপযুক্ত অঞ্চলগুলো চিহ্নিত করা হয় এবং এর পর থেকে এই উদ্যোগ ধীরে ধীরে বাস্তব রূপ পেতে শুরু করে।
একটি নির্দিষ্ট পাইলট প্রকল্প উন্নয়নের পর এই কর্মসূচির মাধ্যমে হোড়িখোলা, টেকনাফে শরণার্থীদের আশ্রয়দানকারী সম্প্রদায়ের ২০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এই প্রশিক্ষণে নারী ও পুরুষ উভয় পরিচালিত খামার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে লিঙ্গ-সমতা নিশ্চিত হয়।
বর্তমানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রতিটি পরিবার অন্তত একটি মৌচাক স্থাপন করেছে, যা তাদের বাড়ির প্রস্তাবিত এলাকার এক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে একটি সুরক্ষামূলক 'মৌচাক বেষ্টনী' তৈরি করেছে। এর ইতিবাচক ফল ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান: এই মৌচাকগুলো থেকে ইতোমধ্যে ৩০ কেজির বেশি মধু সংগ্রহ করা হয়েছে এবং হাতির আক্রমণের ভয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে।
কান্তিলাল, মনসা এবং এই প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী অন্যদের জন্য মৌচাষ শুধুই জীবিকা অর্জনের উপায় নয়—এটি তাদের ঘরে শান্তি ফেরানো এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ভূমিতে সহাবস্থানকারী হাতিদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টিকে থাকার একটি পথ।
২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর বন সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সার্কেলের কনজারভেটর ইমরান আহমেদের নেতৃত্বে বন অধিদপ্তরের (বিএফডি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা টেকনাফের হরিখোলা মৌচাক বেষ্টনী পাইলট প্রকল্প পরিদর্শন করেন।
এসময় তাদের সঙ্গে ছিলেন কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার মো. নূরুল ইসলাম, টেকনাফ ও উখিয়া সহকারী বন সংরক্ষক মো. মনিরুল ইসলাম, এবং ঢাকার বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ ও চট্টগ্রামের কর্মকর্তারা।
এই পরিদর্শনের উদ্দেশ্য ছিল উখিয়া ও টেকনাফ অঞ্চলে মানুষের সঙ্গে হাতির সংঘর্ষ কমানোর নতুন পদ্ধতি মূল্যায়ন করা এবং বাংলাদেশে অন্যান্য সংঘর্ষপ্রবণ এলাকায় এই পদ্ধতির প্রয়োগের সম্ভাবনা পরীক্ষা করা।
বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মৌচাক বেষ্টনীর কৌশলগত দিক পর্যালোচনা করেন, মৌচাষীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং স্থানীয় কৃষকদের অভিজ্ঞতা ও এই উদ্যোগের কার্যকারিতা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন।
বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আইইউসিএন, বাংলাদেশ ও ইউএনএইচসিআর-এর যৌথ উদ্যোগের প্রশংসা করেন।
তারা বলেন, এই প্রকল্পের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা ব্যবহার করে বাংলাদেশে অন্যান্য মানুষ-হাতি সংঘর্ষপ্রবণ এলাকায় সমাধানমূলক কৌশল তৈরি করা সম্ভব।
এই উদ্যোগটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। প্রকৃতির শক্তি কাজে লাগিয়ে আইইউসিএন, বাংলাদেশ ও ইউএনএইচসিআর যৌথভাবে স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কাজ করে তাদের জীবিকা রক্ষা করছে এবং একই সঙ্গে অঞ্চলে মানুষের সঙ্গে বন্যপ্রাণীর সংঘর্ষ কমানোর জন্য একটি টেকসই পদ্ধতি গ্রহণে উৎসাহিত করছে।