অস্ত্র নয়, হাতিই ছিল এ উপমহাদেশের রাজনীতি ও পরিবেশের প্রতীক
উপমহাদেশের আদি ইতিহাসে হাতি এক অদ্ভুত, কিন্তু গভীর অর্থবহনকারী প্রাণী। রাজাদের যুদ্ধে ব্যবহৃত হাতি শুধু যুদ্ধযন্ত্র ছিল না, ছিল রাজকীয় ক্ষমতার প্রতীক। 'এলিফ্যান্টস অ্যান্ড কিংস'-এ প্রস্তাবনা অংশেই লেখক টমাস আর ট্রটম্যান বলছেন, ভারতবর্ষে হাতির গুরুত্ব শুধু সামরিক নয়, বরং পরিবেশ ও সমাজের গভীর এক স্তরে প্রোথিত।
যেখানে পাশ্চাত্যে অস্ত্রশস্ত্র ও প্রযুক্তির বিবর্তন যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করত, সেখানে ভারতীয় উপমহাদেশে যুদ্ধ ও রাজনীতিতে প্রাকৃতিক সম্পদের—বিশেষ করে হাতির অবস্থান ছিল কেন্দ্রীয়। যুদ্ধের জন্য হাতি সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের পেছনে ছিল একটি পুরো পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা। আর এই ব্যবস্থাপনাই ছিল প্রাচীন ভারতীয় শাসকদের 'পরিবেশনির্ভর রাজনীতি'র এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
ট্রটম্যান ব্যাখ্যা করেন, ভারতীয় শাসকেরা হাতিকে যুদ্ধের জন্য নিজস্বভাবে উৎপাদন করতে পারত না, যেমন করে ঘোড়া বা মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। বন্য হাতিকে ধরা এবং রাজদরবারে আনা হতো। অর্থাৎ জঙ্গলের ওপর নির্ভর করে তৈরি হতো রাজকীয় শক্তি। এই নির্ভরতা থেকেই রাজা ও বনের মধ্যে একধরনের রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বন ছিল ক্ষমতার উৎস, রাজা ছিল তার সংগঠক।
এ ছাড়া ভারতে একমাত্র নয়—চীন, সিয়াম (থাইল্যান্ড) ও অন্যান্য এশীয় রাজ্যেও হাতির ব্যবহার ছিল, তবে ভারতের মতো এত গভীরে গিয়ে হাতিকে শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রে স্থাপন কেউ করেনি। ট্রটম্যান দেখিয়েছেন কীভাবে মৌর্য সাম্রাজ্যের মতো শাসনব্যবস্থা হাতিকে কেন্দ্র করে সামরিক এবং প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলে।
হাতির এই রাজনৈতিক ভূমিকাকে বোঝার জন্য আমাদের পরিবেশ ও ইতিহাসকে একসঙ্গে দেখতে হবে। শুধু রাজনৈতিক ইতিহাস দিয়ে নয়, বরং পরিবেশগত দৃষ্টিভঙ্গিতে বুঝলেই বোঝা যাবে, হাতি আসলে একধরনের 'পরিবেশগত প্রযুক্তি' হয়ে উঠেছিল।
এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সাহায্য করে শুধু অতীত বোঝার জন্য নয়, বরং আধুনিক কালের পরিবেশনীতি ও বন ব্যবস্থাপনার দিকেও নতুন চোখে তাকাতে— বলেছেন ট্রটম্যান।
রামায়ণের এক দৃশ্যে, বনবাসী রাম তার ছোট ভাই ভরতকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি হাতির বন রক্ষা করছ? আর তাদের প্রয়োজন পূরণ করছ? এই প্রশ্ন শুধু সহানুভূতির নয়, বরং এক ঐতিহাসিক বাস্তবতার—ভারতীয় রাজনীতির পরিবেশনির্ভর কাঠামোর সরাসরি প্রতিফলন। বন, হাতি এবং রাজশক্তি—এই ত্রয়ী একসূত্রে বাঁধা।
প্রাচীন হিন্দুস্তানের শাসকগণ যেকোনো যুদ্ধজয়ের কল্পনায় হাতিকে কেন্দ্র করে সামরিক ও প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন। হাতি কেবল বাহন নয়, শক্তির প্রতীক, ভয় প্রদর্শনের অস্ত্র, আর রাজার আভিজাত্যের প্রামাণ্য দলিল।
রণ-হস্তির রূপ বলতে পাহাড়ের মতো শরীর, মত্ততার উন্মাদনা কথাই ভেসে ওঠে।
মহাভারতের ভাষায়, আদর্শ রণ-হস্তি এক ষাট বছরের পুরুষ, বিশাল দাঁত, প্রবল শক্তি এবং মত্ততায় বিভোর। এ যেন চলমান পাহাড়। তার শরীর থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে মস্তিষ্ক-উদ্দীপক তরল পদার্থ। চোখে আগুন, শুঁড়ে বজ্রপাত।
এই 'মত্ত' অবস্থা, সংস্কৃতে 'মত্ত'-ই বলে, ফারসিতে বলে 'মাস্ত'। প্রাচীন ভারতের সাহিত্যে, যুদ্ধকৌশলে, এমনকি প্রেমের কবিতায়ও ফিরে ফিরে আসে। কাব্যে এই মত্ত হাতির কপাল ঘিরে মৌমাছির গুঞ্জন প্রেমিকের কামনার প্রতীক হয়ে ওঠে।
বন থেকে বন্দী জীবনে এসে বুনো হাতির জীবন পুরোই বদলে যায়। রাজনীতির একটি পূর্ণবয়সী, শক্তিশালী বন্য হাতিকে ধরে এনে প্রশিক্ষণ দেওয়া এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। এতে রয়েছে রাজশক্তির বহিঃপ্রকাশ। কারণ, এত বিশাল মাপের প্রকল্প কেবল রাষ্ট্রই করতে পারত।
কিন্তু হাতি সহজে বন্দী হয় না। ফাঁদে ফেলা হতো। না খাইয়ে দুর্বল করা হয়। কম কম করে খাওয়ানো। কোমল কথায় আশ্বস্ত করা হয়Ñতারপরই হাতি সাড়া দেয়। বহু হাতি মারা যেত এই মানিয়ে নেওয়ার যন্ত্রণায়। হাতি ভুলতে পারত না তার বনজ জীবন—তার হৃদয়ে গেঁথে থাকত সেই স্মৃতি, সে পদ্মপুকুরে, ঝরনার জলে আর সঙ্গিনীদের সঙ্গে খেলা করার দিনগুলো স্মরণ করে হাহাকার করে।

বন্দিত্ব তাকে মানিয়ে নেয়, কিন্তু সে কখনো গৃহপালিত হয় না। সুযোগ পেলে আবারও সে ফিরে যেতে চায় সেই প্রাচীন অরণ্যে। এই বাস্তবতাকে আইনও স্বীকৃতি দিয়েছে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক আদালত রায় দেন, হাতি যখন পালায়, তখন সে আর কারও মালিকানায় থাকে না—সে ফের 'বন্য' হয়ে ওঠে।
হাতি মানেই বিপজ্জনক সম্পদ—এরকম মত আছে। খরচ, খাদ্য ও সংঘর্ষ। একটি হাতি প্রতিদিন খায় ১৫০ কেজির বেশি খাদ্য। বন্দিদশায় হাতির শক্তি বজায় রাখতে লাগে রান্না করা উচ্চ-ক্যালরির খাবার; যেমন ভাত, চিনি, কলা, আখ। অন্যদিকে হাতির রক্ষণাবেক্ষণ এক স্থায়ী সামরিক খরচ।
তবে এই খাদ্যপ্রীতি তাকে কৃষকের শত্রু বানায়। চাষের জমিতে হানা, ফসল লন্ডভন্ড, আর মানুষের হাতে মারা পড়ে হাতি। প্রতিবছর ভারতে গড়ে ৪০০ মানুষ মারা যায় হাতির আক্রমণে, অপর দিকে ১০০ হাতি নিহত হয় মানুষের হাতে। বাংলাদেশেও কিছু কিছু জায়গায় মানুষ হাতি মুখোমুখি।
হাতি-মানুষের এই দ্বন্দ্ব চিরন্তন, যেখানে রাজা চায় হাতি, কৃষক চায় ফসল, আর বন হয়ে ওঠে বিরোধের কেন্দ্র।
বন্দী অবস্থায় প্রজনন ব্যর্থতা ও বননির্ভরতার বিকল্প নেই। হাতি ধীরে প্রজনন করে। বন্দী হাতির জন্মহার এতই কম যে একটি রণ-হস্তি বাহিনী টিকিয়ে রাখতে হলে নিয়মিত বন্য হাতি ধরতেই হতো। বিশ বছরের পরিণত বুনো হাতিই ছিল পছন্দ। তাই রাজাদের 'বন রক্ষা ছিল স্বার্থের প্রয়োজন', আদর্শের কারণে নয়।
হাতির মত্ততা, কবিতা ও যুদ্ধের সংবেদনশীল উন্মাদনার কথকথাতেও রয়েছে হাতির মত্ততা, যার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় বলা রয়েছে টেস্টোস্টেরনের বিস্ফোরণ, চোখের পাশের গ্রন্থি থেকে তরল নিঃসরণ, প্রবল যৌন ও আক্রমণাত্মক আচরণ। এসবই সাদামাটা হাতিকে রণ-হস্তি হিসেবে উপযুক্ত করে তোলে।
তবে বাস্তবে হাতি বছরে একবার মত্ত হয়। যুদ্ধের সময় এই মত্ততা কৃত্রিমভাবে উদ্দীপিত করা হতো। মদ খাইয়ে, যুদ্ধকালীন নানা শব্দে উত্তেজিত করে, কিংবা বিশেষ ওষুধ প্রয়োগে। 'আইন-ই-আকবরি', হেলেনিস্টিক সিরিয়া (হেলেনিস্টিক সিরিয়া বলতে গ্রিক বিজেতা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়ে পড়ার সময়ের সিরিয়াকে বোঝানো হয়। সে যুগে সিরিয়ার একটি অঞ্চল শাসন করত সেলিউকিদ রাজবংশ। এই সময়কাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩১২ থেকে ৬৪ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল) চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং সবাই বলেছে হাতিকে মত্ত করে তোলার এই কৌশলের কথা।
হাতির পিঠে রাজা, তার নিচে শাসনযন্ত্র কথাও বলতে হয়। প্রাচীন ভারতের রণ-হস্তির পিঠে কোনো হাওদা ছিল না। যোদ্ধারা খালি পিঠে বসে যুদ্ধে নামতেন, যেমন যোদ্ধা ঘোড়ার পিঠে চড়ে যুদ্ধ করে। শিলালিপি, মূর্তি, এমনকি আলেকজান্ডার-পুরুর যুদ্ধের বিবরণেও এই ছবিই পাওয়া যায়।
এদের চালাত মাহুত, হাতে থাকত লোহার দ্বিমুখী ধারাল আঁকশির মতো আংকুশ। হাতিকে থামানো, তাড়া করা, দিকনির্দেশ দেওয়ার মতো সবই হতো এই হাতিয়ার দিয়ে। এই আংকুশও হয়ে ওঠে 'শাসকের নিয়ন্ত্রণের প্রতীক'।
রণ-হস্তি কেবল এক বিশাল পশু নয়; বরং সে ছিল এক রাজনৈতিক জীব। রণ-হস্তির পিঠে বসে তৈরি হতো যুদ্ধ, রণকৌশল, শাসন এবং কাব্য। তার বন্যতা ছিল ভয়, তার নিয়ন্ত্রণ ছিল শক্তি. আর তার মত্ততা ছিল সাম্রাজ্যের দম্ভ।
বনের হৃদয় থেকে উঠে এসে সে দাঁড়াত রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বারের সামনে। হিন্দু রাজার কাছে দেখা দিতে কখনো দেবতা গণেশ হয়ে। কখনো রাজার হয়ে উঠত বাহন। কখনো যুদ্ধের তাণ্ডব।
এই হাতিকে নিয়ে লেখা মানে শুধু ইতিহাস নয়, মানুষ বনাম প্রকৃতির সম্পর্ক। রাজনীতি বনাম প্রাণবন্ত বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানো। আর তাই রণ-হস্তির গল্প আসলে আমাদের গল্প। নিয়ন্ত্রণ আর স্বাধীনতার চিরন্তন দ্বন্দ্বের গল্প।
রাজ্যগঠনের আদিকাল থেকেই হাতি ছিল রাজাদের জন্য এক অনন্য সম্পদ—শক্তি, মর্যাদা ও রাজকীয় আভিজাত্যের প্রতীক। রাজা যেখানে হাতি পেতেন, সেখানে তার প্রতি প্রায় চৌম্বকীয় আকর্ষণ ছিল। হাতির বিশালতা, নিয়ন্ত্রণের দুরূহতা ও ভয় সৃষ্টির ক্ষমতা রাজার জন্য ছিল রাজনৈতিক পুঁজি। হাতি শিকার, শোভাযাত্রা বা হাতিকে উপহার হিসেবে প্রদর্শন করে রাজারা নিজেদের শ্রেষ্ঠতা প্রমাণ করতেন।
এইভাবে হাতির মালিকানা কেবল ভোগবিলাস ছিল না, তা ছিল 'শাসকের গুরুত্ব প্রমাণের উপায়'। উপমহাদেশের প্রাচীন জীবনের প্রেক্ষাপটে, যেখানে রাজতন্ত্রের পাশাপাশি গণপ্রজাতন্ত্রী কাঠামো বা বনবাসী গোষ্ঠীও ছিল, সেখানে কেবল 'রাজ্যব্যবস্থাই' হাতি ধরা, প্রশিক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণের মতো এমন বিশাল কর্মযজ্ঞ সামাল দিতে পারত।
রণ-হস্তি কি উপমহাদেশের উদ্ভাবন? এমন প্রশ্ন শোনা যায়। প্রথম দিকে হাতির প্রয়োগ ক্ষেত্রে রণাঙ্গন ছিল না। হাতিকে যুদ্ধ-প্রাণীটির ভূমিকায় নামানোর ধারণা সম্ভবত সৃষ্টি হয় খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে। রাজতন্ত্র, গরু, ঘোড়া, ছাগলের মতো পশু পালন অর্থাৎ হস্তি-পূর্ব প্রাণী পোষার ধারবাহিকতার যৌথ ফলাফল। লেখক ট্রটম্যানের মতে, রণ-হস্তির ধারণা ভারতে উদ্ভাবিত। ভারতের রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে লড়তে এসে মুসলমান তরুণ সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমকে হস্তি বাহিনীর মোকাবিলা করতে হয়েছে। সে আরও অনেক পরের ঘটনা। ট্রটম্যান তার লেখায় 'উদ্ভাবন' বলতে বোঝায়, বন্য পূর্ণবয়স্ক পুরুষ হাতিকে ধরে এনে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের উপযোগী করে তোলা। এই কৌশল সম্ভবত বৈদিক যুগের শেষ দিকে বিকশিত হয় এবং দ্রুত উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।
যদিও এর সুনির্দিষ্ট তারিখ বের কঠিন, তবে 'মহাভারতের' অন্তর্নিহিত বয়ান ও অন্যান্য সূত্র থেকে ধরে নেওয়া যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ সালের মধ্যেই এই রণ-হস্তির আদর্শ প্রায় স্বীকৃত হয়ে যায়।

রাজা আর হাতির সম্পর্ক কোথা থেকে শুরু, তা জানার জন্য ইতিহাসে অনুসন্ধান চলতে পারে। রণ-হস্তির আবির্ভাবের পেছনের ইতিহাস খুঁজতে হলে তাকাতে হয় প্রাচীন সভ্যতার দিকে: মিসর, আসিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, চীন এবং উপমহাদেশের সিন্ধু সভ্যতা। এদের মধ্যে ভারতে রণ-হস্তি উদ্ভাবনের পূর্বসূরি ছিল ২৫০০-১৮০০ খ্রিষ্টপূর্ব সিন্ধু সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার লিপি যদিও দুর্ভাগ্যবশত আজও পাঠোদ্ধার হয়নি।
তবে মিসর, আসিরিয়া ও চীনে পাওয়া বিভিন্ন নিদর্শন দেখায়—রাজারা হাতিকে উপস্থাপন করেছেন ভয়ংকর পশু হিসেবে। শিকারের লক্ষ্যে বা রাজপ্রসাদের চিড়িয়াখানায় প্রদর্শনের জন্য। যুদ্ধের জন্য হাতিকে পরিকল্পিত প্রশিক্ষণের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ভারত ছাড়া অন্য কোথাও নেই।
প্রাচীন মিসরে হাতি যেন সম্রাটের কবলে বনরাজা। কবরেও রাজনীতি, রাজপ্রাসাদে নয়, হাতি পাওয়া গেল সমাধিতে। প্রাক্-মিসরীয় যুগে হাতি দেখা যেত প্রসাধনীর রং ফলক বা প্যালেট, হাড়, খোদাই করা হাতির দাঁতের শিল্পে। কিন্তু সবচেয়ে চমকপ্রদ, উজানের মিসরের হায়ারাকোনপোলিস অঞ্চলের দুটি অভিজাত কবরে পাওয়া যায় 'দুটি কিশোর বয়সী হাতির পুরো কঙ্কাল'। এর একটির বয়স ১০-১১, অপরটি ৬-১০ বছর।
আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদ রেনে ফ্রিডম্যান বলেন, এগুলো জীবন্ত অবস্থায় ধরা হয়েছিল, নির্দিষ্ট খাদ্য খাওয়ানো হয়েছিল, তারপর রাজকীয় বলিপ্রথার অংশ হিসেবে সমাহিত করা হয়। এখানেই স্পষ্ট হয়, 'হাতি তখন থেকেই রাজশক্তির এক অলিখিত প্রতীক', এমনকি রাজ-বলির পশুও।
পরবর্তী যুগে খরা ও কৃষি সম্প্রসারণের ফলে হাতি মিসর থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তখন হাতির স্থান দখল করে অন্যান্য প্রাণী। এরও পরে টলেমি শাসকেরা হেলেনিস্টিক যুগে উপমহাদেশীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে হাতি প্রশিক্ষণ শুরু করেন।
সিরিয়ায় হাতির শিকারের কথা, যুদ্ধ না, কৃতিত্বের গল্প, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মিসরের ফারাও প্রথম ও তৃতীয় থুতমোস উত্তর সিরিয়ার নিযা অঞ্চলে 'এশীয় প্রজাতির হাতি শিকার' করেন। তৃতীয় থুতমোসের একটি শিলালিপিতে লেখা, 'আমি ১২০টি হাতিকে বেষ্টন করে শিকার করেছি। এমনটি কোনো রাজাই এর আগে করেননি।'
তার মন্ত্রীর সমাধিতে পাওয়া এক চিত্রে দেখা যায়, সিরীয়রা শ্রদ্ধাজ্ঞাপন হিসেবে মিসরে পাঠিয়েছে একটি বাচ্চা হাতি, দাঁত, বুনো বিড়াল ও ঘোড়া। হাতিটি ছোট, তার ছোট দাঁত ও শরীর বলে দেয়, সে কিশোর বয়সে ধরা পড়েছে।
আসিরিয়ায় হাতি ছিল শিকার, শোভা আর শক্তির প্রতীক। আসিরীয় রাজারা নিজেদের বীরত্বের নিদর্শন হিসেবে হাতি, সিংহ ও বন্য ষাঁড় শিকার করতেন। তিগলাথ—প্রথম পিলেসারের একটি শিলালিপিতে লেখা, আমি হাররানের নদীতীরে ১০টি বন্য পুরুষ হাতি মেরেছি এবং ৪টি জীবন্ত ধরি। আমি এগুলোর চামড়া, দাঁত ও জীবিত হাতি আমার নগরী আশুরে এনেছি।
তার উত্তরসূরিরাও এই ধারা বজায় রাখেন। কেউ ৫৬টি হাতি, কেউ ২৩ বা ২৯টি হাতি শিকার করেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে 'জীবন্ত হাতি ধরার' কথা বলা হয়েছে। মায়েরা শিকারের সময় মারা যাওয়ার পর সেসব হাতি শাবকদের জ্যান্ত ধরে আনা হয়। আসিরীয় রাজারা একে কেবল শিকারে সীমিত রাখেননি—তারা হাতি ও অন্যান্য বন্য প্রাণী 'কর' হিসেবে নিয়েছেন। সিংহ, হনুমান, উট, এমনকি 'পাঁচটি জীবন্ত হাতি'ও এসেছে বিজিত রাজ্যের কাছ থেকে। এই সমস্ত আয়োজনের মধ্য দিয়ে একটিই বার্তা দেওয়া হয়েছে, 'রাজা বড়; কারণ, সে বন্যতাকে বশে আনতে পারে।'
হাতি, রাজনীতি এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। প্রাচীন মিসর ও আসিরিয়ার ইতিহাস আমাদের জানায়, যুদ্ধ নয়, বরং 'শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যম' হিসেবেই হাতি ছিল প্রাচীন রাজাদের পছন্দ। যুদ্ধে কৌশলগত ব্যবহার নয়, বরং শিকার, প্রদর্শনী, বলি ও প্রভাব বিস্তারের জন্যই হাতির ব্যবহার ছিল ব্যাপক।
তবে এশিয়া, বিশেষ করে উপমহাদেশে হাতির ভূমিকা এক ধাপ এগিয়ে যায়। এখানে হাতি শুধু প্রদর্শনের বস্তু নয়, বরং একে বানানো হয় যুদ্ধযন্ত্র রণ-হস্তি। আর এই রণ-হস্তির উদ্ভাবনই গড়ে তোলে হাতিকে রাজশক্তির ঘনিষ্ঠতম সঙ্গী।
হাতির মানচিত্রের দিকে তাকালে জানতে পারব, কোন দেশে কত হাতি রয়েছে। ভারতের হাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বর্তমানে প্রায় ৩,৫০০টি পোষ মানানো হাতি রয়েছে। প্রতিবেশী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কাতে সবচেয়ে বেশি হাতি রয়েছে। ভুটান, বাংলাদেশ ও নেপালেও কিছু হাতি রয়েছে। পাকিস্তানে হাতির অস্তিত্ব আজ প্রায় নেই বললেই চলে।
হাতিরা অবশ্য মানুষের তৈরি আন্তর্জাতিক সীমারেখা থোরাই কেয়ার করে! তাই যেখানে ভৌগোলিক পথ খোলা আছে, সেখান দিয়ে বন্য হাতিদের অনবরত যাওয়া-আসা লক্ষ করা যায়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দশ লাখ হাতির রাজত্ব! দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডেও বহুসংখ্যক হাতি রয়েছে; মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, লাওস (যার প্রাচীন নাম ছিল 'লান সাং'—দশ লাখ হাতির দেশ), কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম, সবখানেই সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে হস্তিকুল। ইন্দোনেশিয়ায় বন্য হাতির দেখা মেলে সুমাত্রা দ্বীপে। কিন্তু জাভায় ইতিহাসের যুগ থেকে হাতি ছিল কি না, তা নিয়ে তর্ক চলছে। এ ছাড়া বোর্নিও দ্বীপের ইন্দোনেশিয়ার কালিমানতান ও মালয়েশিয়ার সাবাহ অঞ্চলেও হাতির দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু এসব হাতির উৎপত্তি নিয়ে দ্বিমত রয়েছে, ওরা কি সমুদ্রপথে আনা পোষা হাতির বংশধর, নাকি ওই অঞ্চলের আদিবাসী হাতি?
এ সম্পর্কিত একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, ১৭৫০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুলু রাজাকে হাতি সরবরাহ করেছিল; যা আজকের দিনের বন্য হাতিগুলোর উৎস হতে পারে। তবে এই পোষা হাতিদের বংশধর আর প্রকৃত আদিবাসী বন্য হাতিদের মধ্যে পার্থক্য বের করা কঠিন।
ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বর্তমানে যে বন্য হাতি দেখা যায়, তারা মূলত শ্রমিক হিসেবে আনা পোষা হাতির বংশধর। এসব হাতি স্বাধীনভাবে বনে ফিরে গিয়ে নতুন বন্য জীবন শুরু করেছে। এই দ্বীপে শেষবার তাদের কাজে তাদের শ্রম ব্যবহার করা হয় ১৯৬২ সালে। তারপর শিল্প খাত থেকে পরিত্যক্ত হলে হাতিরা বনে চলে যায়।
চীনের প্রেক্ষাপটে হাতি নিয়ে ছায়াময় ইতিহাস। বর্তমানে চীনে রয়েছে মাত্র ২০০-২৫০টি বন্য হাতি। তা-ও শুধু মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী পার্বত্য অঞ্চলের কাছাকাছি ইউনান প্রদেশে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, চীনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে একসময় হাতি বিচরণ করত।
গবেষক ওয়েন হুয়ানরান গত ৭,০০০ বছরের ইতিহাসে চীনে হাতির বংশবিস্তার এবং হ্রাস পাওয়া বিষয়কে নথিভুক্ত করেছেন। তার গবেষণায় দেখা যায়, প্রাচীন কালে হাতিরা চীনের উত্তরাঞ্চলে পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পরে মার্ক এলভিন ২০০৪ সালে নিজের লেখা 'দ্য রিট্রিট অব দ্য এলিফেন্টস'-এ ওয়েনের তথ্য ব্যবহার করে হাতির ইতিহাসকে 'চীনের পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রতীক' হিসেবে উপস্থাপন করেন।
চীনে হাতির বিলুপ্তি পেছনে জলবায়ু, বননিধন ও শিকার দায়ী। ওয়েন ও এলভিনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, হাতির উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে সরে যাওয়া বা সংকোচনের প্রধান কারণ ছিল, জলবায়ু পরিবর্তন। উষ্ণ আবহাওয়া থেকে ধীরে ধীরে ঠান্ডা আবহাওয়ার দিকে পরিবর্তন। মানবসৃষ্ট বন উজাড় এবং কৃষি সম্প্রসারণ, দাঁতের জন্য হাতি শিকার, উৎসব, যুদ্ধ ও পরিবহনকাজে হাতির ব্যবহারের জন্য ধরা ও হত্যা।
হাতিরা চরমভাবে পানি, খাদ্য ও তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল। এদের প্রজননচক্র ধীর। দুই বছর গর্ভধারণ, একটি বাচ্চা। দীর্ঘ ব্যবধান। ফলে তারা পরিবেশ পরিবর্তনের সঙ্গে সহজে খাপ খায় না।
পরিবেশবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে হাতি যেন পরিবেশের ক্যানারি পাখি। খনিতে অক্সিজেন কমছে কি না দেখার জন্য ক্যানারি পাখি পোষা হতো।
মার্ক এভিন বলেন, হাতি 'খনির ক্যানারি পাখি'র মতো। হাতির দশা দেখেই বোঝা যায় পরিবেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চীনা ইতিহাসে ধর্ম, সাহিত্য ও দর্শনে প্রকৃতিপ্রীতি থাকলেও বাস্তবে সংরক্ষণ ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। ঝাও রাজবংশ থেকে শুরু করে প্রায় ৩,০০০ বছরব্যাপী ছিল এক মানবসভ্যতার 'বন্য প্রাণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ'। যদিও কিন এবং হান যুগে গর্ভবতী প্রাণী শিকার, ডিম সংগ্রহ, প্রজনন ঋতুতে বন্য প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বাস্তবে তার সুফল চোখে পড়ে না।
হাতিকে শিকার করা হতো, অরণ্য পরিষ্কার করে জমি করায় হাতির আবাস ধ্বংস হতো। চাষের ফসল রক্ষা করতে গিয়ে তাদের হত্যা বা বন্দী করা হতো। দাঁত, গোশত এবং আনুষ্ঠানিক কাজে ব্যবহারের জন্যও হাতিদের ধরা হতো। এভাবে চীনজুড়ে হাতিরা হারিয়ে যেতে থাকে।
ভারত বনাম চীন তুলনা করলে রণ-হস্তির ইতিহাস দেখতে পাই। চীনে হাতিকে যুদ্ধে ব্যবহার কখনোই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। এটি মূলত 'হান-চীনাদের বাইরে', সীমান্তবর্তী জাতিদের মধ্যেই সীমিত ছিল। ভারতীয় রাজ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার 'ভারতীয় রাজ্যসমূহ' হাতিকে বন থেকে ধরত, প্রশিক্ষণ দিত এবং যুদ্ধ-অস্ত্রে রূপান্তর করত। এই ব্যবস্থাই হস্তিকুল উপমহাদেশে দীর্ঘদিন ছিল।
এলভিন দেখিয়েছেন, ক্ষমতা ও মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যেই ছিল চীনের ভূমি ব্যবহার ও বন উজাড়। অথচ ভারত বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষেত্র ছিল আলাদা—এখানে হাতির সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ।
এই তুলনা করতে গিয়ে এক মৌলিক পার্থক্য ফুটে উঠে। চীনে হাতি হয়ে ওঠে পরিবেশ ধ্বংসের সূচক। ভারতে ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হাতি হয়ে ওঠে রাজশক্তির বন্য মিত্র।
হাতির পায়ের ছাপেই ইতিহাসের মানচিত্র যেন আঁকা হয়ে আছে। হাতির ইতিহাস শুধু এক প্রাণীর নয়, এটি আমাদের রাজনীতি, পরিবেশ, শিকার, বনসংস্কৃতি ও সভ্যতা গঠনের ইতিহাস। উপমহাদেশে, যেখানে হাতিকে যুদ্ধযন্ত্র বানানো হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, যেখানে তাকে রাজপ্রথার অংশ করা হয়েছে। চীনে হাতিকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করা হয়। তিনটি ভিন্ন ধারায় আমরা দেখতে পাই, কীভাবে এক প্রাণীর সাথে মানুষের সম্পর্ক সভ্যতার রূপরেখা নির্ধারণ করে।
এই তুলনামূলক বিচারে রণ-হস্তির ইতিহাস আমাদের শেখায়, প্রাণী ও মানুষ, বন ও রাজনীতি, যুদ্ধ ও পরিবেশ—এসব একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং পরস্পরনির্ভর এক জীবন্ত সম্পর্ক।