মাঙ্গায় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস, আতঙ্কে জাপান ভ্রমণ বাতিল করছেন পর্যটকরা

একটি কমিক বই, এক জ্যোতিষীর দাবি এবং একজন ফেং শুই মাস্টারের সতর্কবার্তা—তিনটি অদ্ভুত সূত্র থেকে ছড়িয়ে পড়া 'ভবিষ্যদ্বাণী'র কারণে পর্যটক হারাচ্ছে জাপান।
সম্প্রতি প্রকাশিত জাপানের এক মাঙ্গায় (কমিক বুক) বলা হয়, দেশটির ওপর ঘনিয়ে আসছে এক বড় ধরনের দুর্যোগ। এই কল্পকাহিনির মধ্যেই বাস্তবে এক জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, জাপানে শিগগিরই ঘটে যেতে পারে ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প। অন্যদিকে, জাপানেরই একজন পরিচিত ফেং শুই মাস্টার সরাসরি পর্যটকদের দেশটিতে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
শুনতে কোনো দুর্যোগ-ভিত্তিক সিনেমার চিত্রনাট্য মনে হলেও, এসব তথাকথিত 'ভবিষ্যদ্বাণী' জাপানের পর্যটন খাতকে বাস্তবে ধাক্কা দিয়েছে।
বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ার অনেক পর্যটক ভূমিকম্পসংক্রান্ত এই ধরনের গুজব বা কুসংস্কারে প্রভাবিত হয়ে জাপান ভ্রমণ বাতিল বা স্থগিত করছেন।
তবে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা এই ভবিষ্যৎবাণীকে নিছক আতঙ্ক হিসেবেই দেখছেন। তাদের মতে, ভূমিকম্প কবে ঘটবে তা নির্ভুলভাবে পূর্বাভাস দেওয়া এখনও সম্ভব নয়।
জাপান বহুদিন ধরেই ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হিসেবে পরিচিত। তবে দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশটির প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত।
ভূমিকম্পের আশঙ্কাকে জাপানের মানুষ দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা হিসেবেই মেনে নিয়েছেন।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে জাপানে 'বড় ধরনের' এক ভূমিকম্পের আশঙ্কা ঘিরে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, বিশেষ করে পর্যটকদের মধ্যে। এই আতঙ্কের উৎস মূলত জাপানের একটি মাঙ্গা, যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
জাপানি মাঙ্গাশিল্পী রিও তাতসুকি ১৯৯৯ সালে প্রকাশ করেন 'দ্য ফিউচার আই স' নামের একটি কমিক। এতে তিনি ২০১১ সালের মার্চ মাসে জাপানে এক 'বড় বিপর্যয়ের' ইঙ্গিত দিয়েছিলেন—যা পরবর্তীতে তোহোকু অঞ্চলে ঘটে যাওয়া বিধ্বংসী ভূমিকম্প ও সুনামির সঙ্গে মিলে যায়।
২০২১ সালে বইটির 'সম্পূর্ণ সংস্করণ' প্রকাশ করে তাতসুকি দাবি করেন, আগামী বড় ভূমিকম্পটি ঘটবে চলতি বছরের জুলাই মাসে।
একই সময়ে জাপান ও হংকংয়ের কয়েকজন জ্যোতিষীও অনুরূপ সতর্কবার্তা দিয়েছেন, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিত্তিহীনভাবে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ফলে পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে জাপান সফরের পরিকল্পনা বাতিলের ঢল নেমেছে।
হংকংভিত্তিক ভ্রমণ সংস্থা (ডব্লিউডব্লিউপিকেজে)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিএন ইউয়েন জানান, ইস্টারের ছুটির সময় জাপানে ভ্রমণের বুকিং অর্ধেকে নেমে এসেছে। আগামী দুই মাসে এ সংখ্যা আরও কমে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভূমিকম্প-সংশ্লিষ্ট এই গুজব মূলত চীন ও হংকংয়ের পর্যটকদের ওপর বেশি প্রভাব ফেলছে—যারা জাপানে ভ্রমণকারী পর্যটকদের মধ্যে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও চতুর্থ বৃহত্তম উৎস।
তবে শুধু এই দুই অঞ্চলে আতঙ্ক সীমাবদ্ধ থাকেনি। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো দেশেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জাপান সফর নিয়ে সতর্কতা দিয়ে পোস্ট ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই জাপানে না যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
ইউয়েন জানান, এসব 'ভবিষ্যদ্বাণী' ঘিরে সৃষ্ট উৎকণ্ঠা অনেক পর্যটকের মনে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। অনেক পর্যটকই এখন আপাতত জাপান ভ্রমণ পিছিয়ে দিচ্ছেন।
এর মাঝে গত বছরের ৮ আগস্ট জাপানের কাগোশিমা প্রদেশের ওসাকা শহরে ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে একটি বাড়ি ধসে পড়ার ঘটনাও নতুন করে আতঙ্ক বাড়িয়েছে।
ঘন ঘন ভূমিকম্পের জন্য জাপান বেশ পরিচিত। দেশটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় 'রিং অফ ফায়ার'-এ অবস্থিত, যা পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্প ও অগ্নুৎপাতপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত।
দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের নানকাই ট্রাফ এলাকায় আগামী ৩০ বছরের মধ্যে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে বলে সতর্ক করেছে জাপান সরকার। পূর্বাভাস অনুযায়ী, এর সম্ভাবনা ৮০ শতাংশ।
তবে বাস্তব সতর্কতার পাশাপাশি, রিও তাতসুকির মাঙ্গা ঘিরেও বাড়ছে আতঙ্ক। রিও তাতসুকির কাজ পূর্ব এশিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়, এমনকি তার ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে তিনি স্বপ্নে ভবিষ্যতের ঘটনা দেখতে পারেন।
তাতসুকি তার মাঙ্গায় নিজেকে এক কার্টুন আকারে ফুটিয়ে তোলেন, যে তার স্বপ্ন থেকে প্রাপ্ত ভবিষ্যৎ দর্শন অন্যান্য চরিত্রদের সাথে আলোচনা করেন। এসব স্বপ্নের সাথে বাস্তব জীবনের ঘটনার সঙ্গে অবাক করার মতো কিছু মিলও থাকে।
বইটিতে ২০১১ সালের ভূমিকম্পের ইঙ্গিত কাকতালীয় না পূর্বাভাস—এই বিতর্কই তাতসুকিকে জনপ্রিয় করে তোলে জাপান সহ থাইল্যান্ড ও চীনের মতো এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে।
প্রকাশকের তথ্য অনুযায়ী, কমিক বইটির ৯ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে এবং এটি চীনা ভাষায়ও প্রকাশিত হয়েছে।

তাতসুকির ভক্তদের বিশ্বাস, তিনি প্রিন্সেস ডায়ানা ও ফ্রেডি মার্কারির মৃত্যু এবং করোনা মহামারির কথাও আগেই বলেছেন। তবে সমালোচকরা এসব দাবি অতি অস্পষ্ট ও বানোয়াট হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে থাকেন।
তাৎসুকির মাঙ্গার প্রচ্ছদেই লেখা ছিল '২০১১ সালের মার্চে বিশাল বিপর্যয়', যা দেখে অনেকেই মনে করেন তাতসুকি প্রায় দশ বছর আগে তোহোকু অঞ্চলের ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন।
সে ভূমিকম্পের পর ভয়াবহ সুনামি আসে। সুনামিতে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারান এবং ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঘটে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। চেরনোবিলের পর এটিই ছিল সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিপর্যয়।
সম্প্রতি প্রকাশিত সর্বশেষ সংস্করণে তাতসুকি দাবি করেন, চলতি বছরের ৫ জুলাই জাপান ও ফিলিপাইনের মাঝে সমুদ্রতলের নিচে একটি ফাটল ধরবে, যার ফলে তোহোকু ভূমিকম্পের তুলনায় তিন গুণ বড় ঢেউ তৈরি হবে।
সম্প্রতি জাপানের দৈনিক মেইনিচি শিম্বুন তাতসুকিকে তার বইয়ের পাঠকদের প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে পর্যটকদের ভ্রমণ বাতিলের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করে।
জবাবে তিনি বলেন, তার কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহকে তিনি 'অত্যন্ত ইতিবাচক' হিসেবে দেখছেন। কারণ এটি মানুষকে দুর্যোগের জন্য প্রস্তুত হতে উদ্বুদ্ধ করেছে ।
তবে তিনি সবাইকে 'তার স্বপ্নে অতিরিক্ত বিশ্বাস না করার' এবং 'বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার' পরামর্শ দিয়েছেন।
তবে ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষেত্রে তাতসুকি একা নন।
চীনা মিডিয়া সম্প্রতি এক জাপানি জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণীর খবর দিয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ২৬ এপ্রিল টোকিও বে এলাকায় একটি বড় ভূমিকম্প হবে। যদিও সে দিন কোনো ভূমিকম্প হয়নি, এই ভবিষ্যদ্বাণীর চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
হংকংয়ের জনপ্রিয় ফেং শুই মাস্টার সেভেন (কিউ সিয়ান ইউ) পর্যটকদের এপ্রিল থেকে জাপান ভ্রমণ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন।
তবে জাপানের মন্ত্রিপরিষদ কার্যালয় এই মাসের শুরুতে এক্সে (সাবেক টুইটার) জানায়, আধুনিক প্রযুক্তি এখনও ভূমিকম্প নিয়ে সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না।
এদিকে ২০১১ সালের ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর একটি মিয়াগি প্রিফেকচারের গভর্নর ইয়োশিহিরো মুরাইও এসব গুজবের প্রভাবে পর্যটন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, 'সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরঞ্জিত গুজব ছড়ানো এবং তার ফলে পর্যটনে প্রভাব পড়া খুবই গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েনের কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার পর্যটন খাত চীনের বয়কটের কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনা পর্যটকদের সংখ্যা গত মার্চ মাসে ৪০ শতাংশ কমে এসেছে।
যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভূমিকম্প নিয়ে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে, তবে জাপানে পর্যটকদের মধ্যে আসলেই ভয়ের মাত্রা কতটুকু তা এখনও স্পষ্ট নয়। কারণ জাপান এখনও জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য হিসেবে অবস্থান বজায় রেখেছে।
হংকংয়ের একজন ইয়োগা প্রশিক্ষক সামান্তা ট্যাং করোনার পর থেকে প্রতি বছর অন্তত একবার জাপানে ভ্রমণ করেছেন। এরই মধ্যে তার জাপানে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেছেন।
মূলত, তিনি আগস্টে ওসাকার দক্ষিণে প্রায় ৫০ মাইল দূরের ওকায়ামা সৈকত এলাকায় ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এখন তিনি ভূমিকম্পের ভয়ে সেটা স্থগিত রেখেছেন। তিনি বলেন, 'সবাই বড় ধরনের সম্ভাব্য ভূমিকম্পের কথা বলছে।'
হংকংয়ের আরেক ভ্রমণপ্রেমী, ৩৬ বছর বয়সী অস্কার চু সাধারণত বছরে বেশ কয়েকবার জাপানে যান। তবে এবার তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টেছেন।
তিনি বলেন, 'এখন না যাওয়াই ভালো। যদি সত্যিই ভূমিকম্প হয়, তাহলে অনেক ঝামেলা হবে।' ভূমিকম্পে আহত হওয়ার আশঙ্কা তার তেমন একটা নেই। বরং ভ্রমণ বিঘ্ন, ফ্লাইট বাতিল কিংবা যাতায়াতে বিশৃঙ্খলা নিয়ে বেশি তিনি বেশি চিন্তিত।
তবে অনেক পর্যটকই এসব ভবিষ্যৎবাণীতে পাত্তা দিচ্ছেন না।
জাপান ন্যাশনাল ট্যুরিজম অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে দেশটিতে রেকর্ড ১ কোটি ৫ লাখ পর্যটক গেছেন।
এ সময়ে শুধু চীন থেকেই জাপান সফর করেছেন ২৩ লাখ ৬০ হাজার পর্যটক, যা গত বছরের তুলনায় ৭৮ শতাংশ বেশি।
একই সময়ে জাপানে ভ্রমণ করেছেন ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৬০০ জন হংকংয়ের বাসিন্দা, যা গত বছরের তুলনায় ৩.৯ শতাংশ বেশি।
আর এই পরিসংখ্যান শুধু পূর্ব এশিয়ার পর্যটকদের নিয়েই।
এ বছরের মার্চ মাসেই শুধু যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩ লাখ ৪৩ হাজার, কানাডা থেকে ৬৮ হাজার এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে ৮৫ হাজার পর্যটক জাপান ভ্রমণ করেছেন।
তবে অনেকে 'ভবিষ্যদ্বাণী' শোনার পরও তাদের ভ্রমণ পরিকল্পনায় কোনো পরিবর্তন আনেননি। তাদেরই একজন হংকংয়ের ভিক শিং। তিনি জানান, 'ভবিষ্যদ্বাণীর কথা শুনেছি ঠিকই, কিন্তু তাতে আমি ভয় পাচ্ছি না।' আগামী জুন মাসে তিনি টোকিও ও ওসাকা ভ্রমণে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, 'ভূমিকম্প কখন হবে—তা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না।'
তার মতে, 'জাপান আগেও অনেক বড় বড় ভূমিকম্প সামলেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাও তাদের ভালো, তাই খুব বেশি ক্ষতির আশঙ্কা নেই।'
অনুবাদ: আয়েশা হুমায়রা ওয়ারেসা