ওয়েবটুন: ৯ বিলিয়ন ডলারের বাজার; কোরিয়ান ডিজিটাল কমিকের দাপট এখন হলিউডেও

দরকার একটা মুঠোফোন আর হাতে কয়েক মিনিট—ব্যস এইটুকুই। জনপ্রিয় ওয়েবটুন 'সোলো লেভেলিং'-এর প্রথম পর্ব পড়লেই বোঝা যায়, গল্পের কাহিনি কোনদিকে মোড় নিচ্ছে।
কাহিনির মূল চরিত্র সঙ জিনউ-কে প্রথমে মনে হবে একজন দুর্বল ও ব্যর্থ দানব শিকারি। কিন্তু এরপর ধাপে ধাপে সে ভয়ংকর সব দানবদের পরাজিত করতে শিখবে, সহকর্মীদের সম্মান পাবে এবং নিজের অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার খরচও জোগাড় করবে।
গল্পে খুব একটা নতুনত্ব নেই ঠিকই—তবুও পাঠকরা মুগ্ধ। ২০১৮ সালে প্রকাশের পর থেকে 'সোলো লেভেলিং' ওয়েবটুনটি ইতোমধ্যেই পড়া হয়েছে ১৪ বিলিয়ন বারেরও বেশি !
গত বছর 'সোলো লেভেলিং' ওয়েবটুনকে অ্যানিমেটেড সিরিজে রূপান্তর করা হয়, যা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম 'ক্রাঞ্চিরোল'-এ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। চলতি বছর এর দ্বিতীয় সিজনও প্রকাশিত হয়েছে।
২০২৪ সালে একই গল্পভিত্তিক একটি মোবাইল গেম মুক্তি পায়। মাত্র কয়েক মাসে এটি আয় করেছে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার—যা অস্কারজয়ী সিনেমা 'কনক্লেইভ'-এর গ্লোবাল বক্স অফিস আয়ের চেয়েও বেশি!
'দ্য মাস্কড সিঙ্গার' রিয়েলিটি শোয়ের মতো, ওয়েবটুনেরও উৎপত্তি দক্ষিণ কোরিয়ায়। স্বল্পসময়েই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এটি।
প্রচলিত কমিকের সঙ্গে ওয়েবটুনের প্রধান পার্থক্য হলো, এটি মূলত স্মার্টফোনের জন্য ডিজাইন করা—যেখানে পাঠক কাগজের পাতার বদলে একেকটি ফ্রেম মোবাইলের স্ক্রিনে স্ক্রল করে পড়েন।
ওয়েবটুন ফরম্যাটের সূচনা ২০০০-এর দশকের গোড়ায় হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া।
পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৪ সালে ওয়েবটুনের বাজার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৯ বিলিয়ন ডলার, যা পরামর্শক সংস্থা আইএমএআরসি'র পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩৩ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।
ওয়েবটুনের বাজার আকার জাপানি মাঙ্গার ভবিষ্যৎ বাজারের চেয়েও বড়। এমনকি জাপানের তরুণ পাঠকরা দেশীয় মাঙ্গা ছেড়ে ওয়েবটুনের প্রতি ঝুঁকছেন। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে জাপানের সর্বোচ্চ আয়ের অ্যাপ ছিল 'লাইন মাঙ্গা', যা মূলত একটি ওয়েবটুন অ্যাপ।
ওয়েবটুনের জনপ্রিয়তার পেছনে বড় দুইটি কারণ হলো—কমিক্সের প্রতি প্রবল আগ্রহ এবং স্মার্টফোন নির্ভরতা। প্রতিদিন প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার নতুন কমিক্সের পর্ব প্রকাশিত হয়, ফলে মোবাইল ব্যবহারকারী তরুণরা সহজেই তাদের পছন্দমতো গল্প খুঁজে পায়।
এছাড়াও জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ 'সংক্ষিপ্ত পর্ব' ও দ্রুত পড়ার সুবিধা। অনেক সময় দেখা যায়, একেকটি পর্ব পড়তে লাগে মাত্র পাঁচ মিনিট।
এটি কোরিয়ান 'স্ন্যাক কালচারের' অংশ—যেখানে ১৫ মিনিট বা তার কম সময়ে উপভোগ করা যায় এমন কনটেন্ট তৈরি করা হয়।
সাইমন ফ্রেজার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডাল ইয়ং জিন বলছেন, ওয়েবটুনের প্যানেলগুলো একটির পর আরেকটি, ধীরে ধীরে দেখায়—যাতে পাঠকের চোখ অন্যদিকে সরে না গিয়ে পুরোপুরি গল্পে ডুবে যেতে পারে।
ওয়েবটুনের আরেকটি বড় আকর্ষণ হলো গল্পের দ্রুত গতি এবং টানটান উত্তেজনা। একের পর এক সংকটের মধ্য দিয়ে গল্প এগিয়ে চলে। যেমন, সঙ জিনউ এক দানবের হামলা থেকে বেঁচে ফিরেই নতুন এক অভিযানে জড়িয়ে পড়ে। টিভি নাটকের মতো প্রতিটি পর্বের শেষে থাকে 'ক্লিফহ্যাঙ্গার' বা চমক, যা পাঠককে পরবর্তী পর্ব পড়তে আগ্রহী করে তোলে।
তবে শুধু অ্যাকশন বা ফ্যান্টাসি নয়, রোমান্স ঘরানার কমিক্সও ওয়েবটুনে বেশ জনপ্রিয়। যেমন, 'আই হেভ ফলেন ফর দ্য এম্পায়ারস গ্রেটেস্ট ভিলেইনেস' নামের গল্পটিতে দেখানো হয়েছে—এক রূপবান ব্যাচেলরের কথা, যে বাধ্য হয়ে বিয়ে করে।
প্রচলিত ঘরানার কাহিনি হলেও, এই ওয়েবটুনের রেটিং ৯ দশমিক ৫ এবং দর্শকসংখ্যা প্রায় ৩ দশমিক ৫ মিলিয়নের কাছাকাছি।
অনেকে মনে করেন, ওয়েবটুনে মৌলিকতার অভাব রয়েছে। তবে ভিজ্যুয়াল বা চিত্রনির্মাণে ওয়েবটুন অনেক বেশি সমৃদ্ধ। বিশ্বের নানা প্রান্তের শিল্পীরা তাদের আঁকা কমিক সরাসরি ওয়েবটুন প্ল্যাটফর্মে আপলোড করতে পারেন, ফলে কোনো নির্দিষ্ট চিত্রধারার বাধ্যবাধকতা থাকে না।
কেউ হয়ত আমেরিকান কমিকের গম্ভীর স্টাইল অনুসরণ করেন, আবার কেউ নতুন ধাঁচে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিজের জন্য মানানসই স্টাইল বের করেন।
'লোর অলিম্পাস' ওয়েবটুনে গ্রিক পুরাণের হেডিস ও পার্সেফোনির প্রেমগাঁথা তুলে ধরা হয়েছে উজ্জ্বল রঙ ও এয়ারব্রাশ ইফেক্টে—যা ইতোমধ্যে পড়া হয়েছে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন বারেরও বেশি !
ওয়েবটুনের বিশাল পাঠকসংখ্যা ও জনপ্রিয়তার কারণে এটি গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি হিসেবে স্বীকৃত। ২০২০ সালের পর থেকে অন্তত ১০টিরও বেশি ওয়েবটুন অবলম্বনে তৈরি হয়েছে টিভি সিরিজ ও চলচ্চিত্র। 'সুইট হোম'এবং 'ইতাইয়োন ক্লাস'-এর মত জনপ্রিয় সব ওয়েবটুন এখন নেটফ্লিক্সে দেখানো হচ্ছে।
তবে প্রতিটি ওয়েবটুনকে পর্দায় রূপ দিতে গিয়ে নির্মাতারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন। সংক্ষিপ্ত এপিসোডের কারণে গল্পে গভীরতা কম থাকে, আর নাটকীয়তা বেশি হলে দর্শকের কাছে তা কৃত্রিম মনে হতে পারে।
ক্রাঞ্চিরোলের কনটেন্ট প্রধান আসা সুহেইরা বলেন, 'সোলো লেভেলিং' 'সিরিজটিকে টিভির জন্য উপযুক্ত করতে চরিত্রগুলোর মনস্তত্ত্বে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয়েছে। না হলে গল্পটি টিভির জন্য উপযুক্তই ছিল না।
তবে থেমে নেই হলিউড। বর্তমানে অন্তত ২০টির বেশি ওয়েবটুন নিয়ে কাজ চলছে।
'বার্বি' ছবির নির্মাতা লাকিচ্যাপ প্রতিষ্ঠানটি 'স্ট্যাগটাউন' নামের এক রহস্যময় শহর নিয়ে একটি ওয়েবটুন অবলম্বনে লাইভ অ্যাকশন সিনেমা বানাচ্ছে।
'লোর অলিম্পাস' ওয়েবটুন নিয়ে অ্যানিমেটেড সিরিজে নির্মাণ করছে 'দ্য মাপেটস' খ্যাত জিম হেনসন কোম্পানি। আর 'দ্য ওয়াকিং ডেড' সিরিজ নির্মাতা স্কাইবাউন্ড প্রতিষ্ঠান কিনে নিয়েছে 'ফ্রিকিং রোমান্স' ওয়েবটুনটি—যা একটি অতিপ্রাকৃত প্রেমের গল্প।
স্মার্টফোনে জনপ্রিয়তার পর, ওয়েবটুন এখন বড় পর্দায় উঠার পথে। শিগগিরই তারা জায়গা করে নিচ্ছে সিনেমা ও টিভির পর্দায়—আরও বড় দাপট নিয়ে।
অনুবাদ: আয়েশা হুমায়রা ওয়ারেসা