রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি নিয়ে 'অবিলম্বে' আলোচনা শুরু করবে: ট্রাম্প
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার বলেছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন তাদের তিন বছর ধরে চলা সংঘাতের বিষয়ে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করবে। তবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দুই ঘণ্টার টেলিফোন আলাপে ট্রাম্প কোনো বড় ছাড় আদায় করতে পেরেছেন—এমনটা মনে হয়নি।
নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম 'ট্রুথ সোশ্যাল'-এ দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্প জানান, পুতিনের সঙ্গে আলাপের পর একটি যৌথ ফোনকলে তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি ও ফিনল্যান্ডের নেতাদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
ট্রাম্প বলেন, 'রাশিয়া ও ইউক্রেন অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির জন্য আলোচনায় বসবে এবং এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো—যুদ্ধ শেষের লক্ষ্যেই আলোচনা শুরু হবে।' পরে হোয়াইট হাউজে তিনি বলেন, 'আমার মনে হয় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।'
পুতিন জানান, যুদ্ধ বন্ধে নেওয়া পদক্ষেপগুলো 'সঠিক পথে' রয়েছে এবং মস্কো ইউক্রেনের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তির বিষয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত।
কৃষ্ণ সাগর-সংলগ্ন সোচি শহরের কাছে সাংবাদিকদের পুতিন বলেন, 'মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমাদের আলোচনা থেকে স্পষ্ট, রাশিয়া একটি ভবিষ্যৎ শান্তিচুক্তি নিয়ে কাজ করতে প্রস্তুত এবং এ বিষয়ে ইউক্রেনের সঙ্গে একটি চুক্তির খসড়া নিয়ে আলোচনা চায়।'
ইউরোপীয় নেতারা ও ইউক্রেন রাশিয়ার কাছে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি জানানোর দাবি জানিয়ে আসছে। ট্রাম্প এ নিয়ে জোর দিয়েছেন এবং পুতিনকে অন্তত ৩০ দিনের জন্য যুদ্ধবিরতিতে রাজি করাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে পুতিন তাতে সাড়া দেননি। তিনি বলেছেন, যুদ্ধবিরতির আগে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। সোমবারের আলোচনায়ও তিনি এ নিয়ে কোনো ছাড় দেননি বলে মনে হয়েছে। ট্রাম্প ও পুতিনের বক্তব্য ইঙ্গিত দেয়, যুদ্ধবিরতির বিষয়টি একটি বৃহত্তর শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
সাবেক সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী কার্ল বিল্ড এক্স-এ মন্তব্য করে বলেন, ট্রাম্প-পুতিন ফোনালাপ 'নিঃসন্দেহে পুতিনের জন্য একটি সাফল্য'। তিনি লেখেন, 'রুশ নেতা সরাসরি যুদ্ধবিরতির কথা এড়িয়ে গেছেন। এতে তিনি একদিকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবেন, আবার অন্যদিকে আলোচনা চলার কথাও বলবেন।'
উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের সম্ভাবনা
ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলার পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি জানান, যুদ্ধ শেষের নতুন উদ্যোগ হিসেবে ইউক্রেন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের পরিকল্পনা চলছে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই বৈঠক শিগগিরই তুরস্ক, ভ্যাটিকান বা সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে ট্রাম্প যে বলেছিলেন 'আলোচনা অবিলম্বে শুরু হবে', এই বৈঠক তারই অংশ কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
ট্রাম্প বলেন, 'পোপের প্রতিনিধিত্বে ভ্যাটিকান এ আলোচনা আয়োজনের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। এখন প্রক্রিয়া শুরু হোক!' তবে ভ্যাটিকান এ বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেন ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা 'গঠনমূলক' বলে উল্লেখ করে বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'
তবে ইউক্রেন ও তার মিত্রদের অভিযোগ, রাশিয়া আসলে আলোচনায় আগ্রহী নয়। বরং, নতুন নিষেধাজ্ঞা ঠেকাতে তারা কেবল ন্যূনতম পদক্ষেপ নিচ্ছে।
২০২২ সালে ইউক্রেনের রুশ অভিযান শুরুর পর ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় প্রথমবারের মতো দুই দেশের প্রতিনিধি দল গত সপ্তাহে ইস্তাম্বুলে বৈঠক করে। তবে সেখান থেকে কোনো আশাব্যঞ্জক ফল আসেনি। আলোচনা থমকে যায়, যখন পুতিন জেলেনস্কির সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং ট্রাম্প বলেন, 'আমি ও পুতিন একসঙ্গে না বসা পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হবে না।'
রুশ প্রেসিডেন্টের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ সাংবাদিকদের জানান, ট্রাম্প ও পুতিন দুই দেশের সম্পর্কের 'ভালো সম্ভাবনা' নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে একটি নতুন বন্দি বিনিময় নিয়েও আলোচনা চলছে।
এদিকে রোম সফররত মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স আবারও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, শান্তিপ্রক্রিয়ায় কোনো অগ্রগতি না হলে যুক্তরাষ্ট্র এই উদ্যোগ থেকে সরে যেতে পারে। তার ভাষায়, 'একসময় আমরা বলব—আমরা চেষ্টা করেছি, কিন্তু এখন আর করছি না।'
সংকটের মূল কারণ সমাধানে গুরুত্ব দিচ্ছেন পুতিন
ভবিষ্যতের সম্ভাব্য শান্তিচুক্তি নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেন যে স্মারকলিপি নিয়ে কাজ করছে, সেটিতে 'সমঝোতার নীতিমালা ও সময়সীমা'সহ কয়েকটি বিষয় থাকবে বলে জানান পুতিন।
তিনি বলেন, 'আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সংকটের মূল কারণগুলো দূর করা। কেবল শান্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার কার্যকর উপায়গুলোই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।'
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে সবচেয়ে ভয়াবহ এই যুদ্ধ শেষ করতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। আগ্রাসনের তিন বছর পর যখন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দিতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন থেকেই ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে আসছেন।
ইউরোপীয় নেতারা বলেছেন, যুদ্ধবিরতির অনুরোধ না মানায় রাশিয়ার ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা চায় তারা। যুক্তরাষ্ট্র এতে রাজি হলে, তা ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির জন্য একটি বড় সাফল্য হবে—এক সময়ে যখন তিনি রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন এবং আগের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইউক্রেনপন্থী নীতিমালা বাতিল করেছেন।
রুশ বাহিনী ইউক্রেনের এক-পঞ্চমাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে রেখে আরও অগ্রসর হচ্ছে। এর মধ্যেও যুদ্ধ থামানোর শর্তে একটুও ছাড় দিচ্ছেন না পুতিন। ট্রাম্পের প্রকাশ্য ও গোপন চাপ, ইউরোপীয় শক্তিগুলোর বারবার আহ্বান—কিছুতেই পুতিনের অবস্থান বদলাচ্ছে না।
