সাভারে ট্যানারি দূষণ রোধে ১০ কোটি টাকার ‘সেইফ ল্যান্ডফিল’ প্রকল্প

সাভার চামড়া শিল্পনগরীর কঠিন বর্জ্য থেকে ধলেশ্বরী নদী ও মাটি দূষণ ঠেকাতে 'সেইফ ল্যান্ডফিল' তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এই প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ডাম্পিং ইয়ার্ড বা ল্যান্ডফিল বা ভাগাড়ে কেবল কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হবে, যাতে করে নিঃসৃত পানি ভূগর্ভে মিশে যেতে না পারে এবং দূষণ রোধ করা যায়।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে ১০ কোটি টাকার এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর, এক বছরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিসিক কর্মকর্তারা মনে করছেন, প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে তা সাভারের ট্যানারিগুলোর 'লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ' (এলডব্লিউজি) সনদ পেতে সহায়ক হবে। এই সনদ হলো, ট্যানারি পরিচালনায় বৈশ্বিক পরিবেশ ও সামাজিক মানদণ্ড মেনে চলার স্বীকৃতি।
এই সনদ অর্জনের মোট ১,৭১০ নম্বরের মধ্যে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ১৫০ নম্বর নির্ধারিত রয়েছে। অন্যান্য শর্ত পূরণ হলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কাঙ্ক্ষিত নম্বর অর্জিত না হওয়ায় ট্যানারিগুলো এলডব্লিউজি সনদ অর্জন করতে পারেনি।
বর্তমানে সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে ট্যানারির কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কোনো নির্ধারিত উদ্যোগ নেই। ধলেশ্বরী নদীর তীরে উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য ফেলে দেওয়া হয়, যা নদীর পানি ও মাটি দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্প শেষ হওয়ার চার বছর পর কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ল্যান্ডফিল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
২০২১ সালের জুনে সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (সিইটিপি) প্রকল্প সম্পন্ন হলেও এটি এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। পরে ট্যানারির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা একটি কোম্পানি গঠন করা হয়।
গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অক্টোবরে 'ধলেশ্বরী রক্ষা: বিসিক শিল্পনগরী ট্যানারি বর্জ্য লিচিং পানি এবং মাটি দূষণ প্রতিরোধ' শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের ৬১তম সভায় এটি অনুমোদিত হয়।
প্রকল্প অনুমোদনের প্রায় পাঁচ মাস পর, গত মার্চে বিসিক থেকে একজন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সিইটিপি-তে পরিশোধনের পর চামড়ায় ব্যবহৃত ক্রোমিয়ামযুক্ত পানি ধলেশ্বরী নদীতে নিঃসৃত করা হয়। তবে যেসব কঠিন বর্জ্য পরিশোধন করা সম্ভব নয়, তা উন্মুক্ত স্থানে ফেলা হয়।
নদী দূষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আপত্তি ছিল। কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত না হওয়ায় এক পর্যায়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ট্যানারির পরিবেশ ছাড়পত্র ইস্যু বন্ধ রেখেছিল। পরে ট্যানারি মালিকদের দাবির মুখে ছাড়পত্রের ইস্যু আবার চালু হয়।
এখন জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে সরকার কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ল্যান্ডফিল নির্মাণ করতে যাচ্ছে।
বিসিক কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে কঠিন বর্জ্য উন্মুক্ত স্থানে ফেলা হয়, যা থেকে তরল মাটিতে মিশে মাটি দূষণ করছে। ক্রোমিয়ামযুক্ত স্লাজ ভূগর্ভস্থ পানিতে পৌঁছানোর ঝুঁকি রয়েছে। এ ঝুঁকি দূর করতেই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে।
বিসিকের পরিকল্পনা ও গবেষণা বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ড. মো. ফরহাদ আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মূলত, ধলেশ্বরী নদীর তীরে সাভার শিল্পনগরী এলাকায় ট্যানারির কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কোনো বড় ধরনের উদ্যোগ নেই। নদীর তীরে উন্মুক্ত স্থানে বিশেষ করে ক্রোমিয়ামযুক্ত কঠিন বর্জ্য ফেলা হয়, যা পানি ও মাটি দুটোই দূষিত করছে।"
তিনি বলেন, "ল্যান্ডফিলের মতো কয়েক স্তরের একটি পুকুর নির্মাণ করা হবে, যাতে কঠিন বর্জ্যের নিঃসৃত পানি ভূগর্ভে যেতে না পারে। ওই পানিকে সিইটিপি-তে নিয়ে পরিশোধনের মাধ্যমে নদীতে নিঃসৃত করা হবে।"
ড. ফরহাদ আরও বলেন, "এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কঠিন বর্জ্য নিয়ে দীর্ঘদিনের সংকটের সমাধান হবে। পাশাপাশি এলডব্লিউজি সনদ পেতেও সুবিধা হবে, কারণ কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ১৫০ নম্বর রয়েছে।"
এলডব্লিউজি অ্যাসেসমেন্ট প্রোটোকল অনুযায়ী, ট্যানারিগুলোকে পরিবেশ, ট্রেসিবিলিটি, সামাজিক দায়িত্ব, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা এবং কেমিক্যাল ব্যবস্থাপনা-সহ মোট ১৭টি ক্যাটাগরিতে ১,৭১০ নম্বরে মূল্যায়ন করা হয়।
৮৫ শতাংশের বেশি নম্বর পেলে গোল্ডেন, ৭৫ শতাংশে সিলভার, ৬৫ শতাংশে ব্রোঞ্জ এবং ৫০ শতাংশ নম্বর পেলে অডিটেড সার্টিফিকেট পায় ট্যানারি প্রতিষ্ঠান।
এই মানদণ্ডে এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড গোল্ড, এবিসি লেদার অডিটেড এবং রিফ লেদার লিমিটেড ব্রোঞ্জ সনদ অর্জন করেছে।
এই সনদ অর্জনের ক্ষেত্রে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ১৫০ এবং ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্টে আরও ১৫০ নম্বর বরাদ্দ রয়েছে। সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে এই দুটি বিষয়ই সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (সিইটিপি) সম্পূর্ণভাবে নির্মাণ ও কার্যকরভাবে পরিচালনার ওপর নির্ভর করছে।