চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা প্রকল্পে হাজারো কোটি টাকা ব্যয় হলেও নজর নেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়

চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে খুব কমই নজর দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বর্ষা এলেই জলাবদ্ধতার কবলে পড়লে খাল-নালা পরিষ্কারের সাময়িক উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় বাসাবাড়ি থেকে ফেলা আবর্জনার স্তূপের কারণে নালা-খালগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। খাল খনন, সংস্কারের পাশাপাশি সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে না পারলে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "যতই খাল খনন করেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক না হলে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের অর্ধেক সুবিধাও পাওয়া যাবে না। কারণ নালা বা খালগুলো পরিষ্কার করা হলেও কয়েক মাস পর তা স্তূপ হয়ে যায়। নালাকে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করে মানুষ।"
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক)। গত দুই দশকে মেয়র চেয়ারে বসা ব্যক্তিরা গ্রিন সিটি বা ক্লিন সিটি গড়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনাই গড়ে তুলতে পারেননি।
স্থানীয় প্রভাবশালীদের বর্জ্য বাণিজ্যের মতো রাজনৈতিক অর্থনীতির কারণে মেয়ররা এ দিকে হাত দেননি। ফলে বাসা-বাড়িসহ প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য স্থানীয় উদ্যোগে গ্রহণ করে নির্ধারিত স্থানে ফেলা হয়। সেখান থেকে সিটি কর্পোরশেনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কর্মীরা ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে আসেন।
কিন্তু এই ব্যবস্থাপনায় কোনো তদারকি নেই। ফলে বর্জ্য সংগ্রহ করার ব্যবস্থাপনার আওতার বাইরে রয়ে গেছেন অনেক মানুষ। ফলে নগরীর খাল-নালাগুলো বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ফলে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিতেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় নগরজুড়ে।
চসিকের তথ্যমতে, অর্ধ শতাধিক ড্রাম্প ট্রাক আর কয়েকটি স্কেভেটরই সংস্থাটির ভরসা। পরিচ্ছন্নতার কাজে আছেন প্রায় ৩,৫০০ জনবল। চট্টগ্রামের মতো বাণিজ্যিক শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সরঞ্জাম ও জনবলেও রয়েছে অপ্রতুলতা।
এছাড়া, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গত দশ বছরে মাত্র ৬৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে, যা অত্যন্ত কম।
ঘরে ঘরে ডাস্টবিন বিতরণ করার পাশাপাশি স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাসা-বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের মাধ্যমে উৎসে পৃথকীকরণ করার উদ্যোগ নিয়েছিল সংস্থাটি। যদিও দুটিই ব্যর্থ হয়েছে।
সংস্থাটির তথ্যমতে, চট্টগ্রাম নগরীতে প্রতিদিন প্রায় ২,১০০ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এসব বর্জ্য মানুষের ঘরবাড়ি থেকে সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে পৌঁছায় দুটি ল্যান্ডফিলে (ভাগাড়)। কিন্তু এসব বর্জ্য যথাযথ ব্যবস্থাপনায় নিঃশেষ না করায় আবর্জনার ভাগাড় দুটির (ল্যান্ডফিল) উচ্চতা বাড়ছে।
চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার আই ইউ এ চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "আমাদের ইক্যুইপমেন্ট সংকট আছে। আর জনবল যা আছে, তাও ঠিক মতো কাজ করে না। আমরা ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছি। আর নির্বাহী কর্মকর্তাদের অধীনে অতিরিক্ত কিছু লোক দেওয়া হয়েছে, যারা শুধু নালা ও খাল পরিষ্কার করবেন।"
তিনি আরো বলেন, "বাসা-বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের জন্য ৪১টি ওয়ার্ডে পৃথক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিতে নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এরপর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে, বোর্ডের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে দক্ষ প্রতিষ্ঠানকে নিয়োজিত করা হবে।"
বর্জ্যের পুনঃব্যবহারের প্রস্তাব আসে, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না
জাপান, চীন, যুক্তরাজ্য বা কোরিয়ার উন্নত শহরগুলোর মতো বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ, গ্যাস, সার উৎপাদনসহ বর্জ্যের পুনঃব্যবহারের বহু প্রস্তাব এসেছিল সিটি কর্পোরেশনে। প্রস্তাবগুলো আসলে সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা চলে। এরপর আবার নানান কারণে থমকে যায়।
সর্বশেষ কয়েক বছর আলোচনার পর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর চর বাকলিয়ায় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রস্তাবিত প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে গত বছর। জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং নদীদূষণের আশঙ্কায় পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীদের আন্দোলনের মুখে উদ্যোগ থেকে সরে আসে সংস্থাটি।
চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কয়েকটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে। একটি প্রস্তাব ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে রয়েছে।"
অগ্রগতি দেখতে চায় সরকার
গত এক দশকে চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে তিনটি সংস্থা চারটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা।
ইতোমধ্যে ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। কিন্তু এরপরওে বর্ষা মৌসুমে সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী।
মোট ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টি খালে প্রকল্পগুলো বাস্তাবায়ন হচ্ছে। চলতি বর্ষার আগে জলাবদ্ধতা নিরসনে অগ্রগতি দেখতে চায় সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চার উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দিয়েছেন কাজে তদারকি করার জন্য।
এছাড়া, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সুপারিশের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
চসিকের তালিকা অনুযায়ী, জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকা নগরীর আগ্রাবাদ, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, সরকারি কমার্স কলেজ, কাতলগঞ্জ, পাঁচলাইশ, প্রবর্তক, চকবাজার, বাকলিয়া, বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, মুরাদপুর, পতেঙ্গা ও ইপিজেড।
১৫৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের নগরীর ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ এলাকায় সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতা হয়। ভারী বর্ষণের সময় এসব এলাকায় ৩ থেকে ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত পানি জমে থাকে।
জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকাগুলো দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে অন্তত ১৬টি খাল। এলাকাগুলো চিহ্নিত করে খাল ও নালা-নর্দমাগুলো পরিষ্কার ও খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই কাজের জন্য আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের অধীনে ৬টি দল গঠন করা হয়েছে। প্রতি দলে সদস্য আছেন ২০ জন করে।
অন্যদিকে, সিডিএর 'চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন' শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় নগরীর ৩৬টি খাল থেকে ৩ লাখ ৬৪ হাজার ঘনমিটার ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এই কাজ শুরু হয়েছে।
প্রকল্পটির আওতায় চার মাসে খালের পাশে ১৫ কিলোমিটার প্রতিরোধ দেওয়াল, তিনটি সিল্টট্র্যাপ (বালু বা কাদা আটকানোর ফাঁদ), ৫ কিলোমিটার নতুন নালা, রাস্তার পাশে থাকা ৩২ কিলোমিটার নালা সংস্কার ও পরিষ্কারের কাজ করা হবে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান চারটি প্রকল্পের মধ্যে তিনটির আওতায় ৩৯টি টাইডাল রেগুলেটর রয়েছে। এরমধ্যে মাত্র ৫টি চালু আছে। বর্ষার আগে পুরোপুরি চালু হতে যাচ্ছে আরও ২৩টি রেগুলেটর।