রপ্তানি কমায় স্বস্তি নেই ঈদেও, শুল্কচাপে হিমশিম খাচ্ছে ট্যানারি খাত

একদিকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, অন্যদিকে রপ্তানি কমে যাওয়া ও দরপতন—এই ত্রিমুখী চাপে পড়েছে দেশের চামড়া শিল্প খাত। এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-চীন শুল্কযুদ্ধ নতুন করে চাপ সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায় ঈদকে সামনে রেখে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ট্যানারি মালিকরা।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনার কারণে বাড়তি খরচের কথা বলে চীনের আমদানিকারকেরা ১০–১৫ শতাংশ মূল্য হ্রাসের দাবি জানাচ্ছেন। অথচ এদিকে ঈদ সামনে রেখে কাঁচা চামড়া সংগ্রহে নগদ অর্থের প্রয়োজন থাকায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ট্যানারি মালিকরা।
বর্তমানে ১০০ থেকে ১২০টি কনটেইনারে প্রক্রিয়াজাত চামড়া বিভিন্ন ট্যানারিতে আটকে আছে, ক্রেতাদের ছাড়পত্র না মেলায় এসব পণ্য রপ্তানি করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সালমা ট্যানারির মালিক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত বছরের সংগৃহীত পশুর চামড়ার ২৫–৩০ শতাংশ এখনো অবিক্রিত। এ অবস্থায় ঈদের জন্য চামড়া সংগ্রহে নগদ অর্থ দরকার, অথচ চীনা বায়াররা ১০–১৫ শতাংশ কম দামে পণ্য নিতে বলছে। আমরা এমনিতেই উৎপাদন খরচ তুলতে পারছি না।"
তিনি জানান, এলডাব্লিউজি সনদ না থাকায় বাংলাদেশের প্রধান বাজার এখন চীন। বিকল্প বাজার না থাকায় পুরো খাতটি চীননির্ভর হয়ে পড়েছে, আর এই সুযোগ নিচ্ছেন চীনা ক্রেতারা।
তিনি আরও বলেন, "চামড়া রপ্তানি গত বছরের তুলনায় গড়ে ১০–১৫ শতাংশ কমেছে। বিপরীতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ।"
"শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ১৩,৫০০ থেকে বেড়ে ১৮,৫০০ টাকা হয়েছে। ৭৪ কেজির লবণের বস্তার দাম ৭০০ টাকা থেকে বেড়ে ১,০০০ টাকা হয়েছে। ঈদের মৌসুমে এক লাখ মেট্রিক টন লবণের প্রয়োজন হয়। ব্যাংক সুদও ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৪–১৬ শতাংশ হয়ে গেছে," যোগ করেন তিনি।
তবে বিসিক লবণ সেলের প্রধান ও উপমহাব্যবস্থাপক (সম্প্রসারণ) সরোয়ার হোসেন জানান, "লবণের দাম বেড়েছে—এ অভিযোগ যৌক্তিক নয়। বরং মাঠ পর্যায়ে দাম কমেছে। কক্সবাজারে গত বছর মনপ্রতি দাম ছিল ৩০০ টাকা, এ বছর তা ২৭০ টাকা। এবং মিলে ১৩ টাকা কেজি দরে সারা দেশে লবণ সরবরাহ করা হচ্ছে, যা গত ঈদে ছিল ১৮ টাকা।"
রপ্তানি কমেছে
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে চামড়া রপ্তানি ৮.২৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১০৭.৬১ মিলিয়ন ডলারে, যা গত অর্থবছরে ছিল ১১৭.২৭ মিলিয়ন ডলার।
বিসিক চামড়া শিল্প নগরীর এক কারখানার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানি করেছে ৭৬ লাখ ৫৯ হাজার ৫৯২ বর্গফুট চামড়া, যার আয় ছিল ৬৩.৬ কোটি টাকা—প্রতি স্কয়ার ফুটে গড় মূল্য ৮৩.০৮ টাকা। চলতি অর্থবছরে একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৫৪ লাখ ১৩ হাজার ৫৯ বর্গফুট চামড়া, আয় ৩৯.৩৭ কোটি টাকা, গড় মূল্য ৭২.৭৪ টাকা।
ফলে ওই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি আয় কমেছে ৩৮.১২ শতাংশ, প্রতি স্কয়ার ফুটে দাম কমেছে ১০.৩৪ টাকা বা ১২.৪৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য ও এবিএস ট্যানারির এমডি ইমাম হোসাইন বলেন, "গত বছর যে চামড়া আমরা ১.৪০ ডলারে বিক্রি করেছি, সেটিই এখন চীনে বিক্রি হচ্ছে ০.৪৫ ডলারে। এমনকি, গত বছরও এটি ০.৭৫ ডলারে বিক্রি হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমার কারখানায় ৮ লাখ স্কয়ার ফুট চামড়া শিপমেন্টের অপেক্ষায় রয়েছে। বায়ারদের গ্রিন সিগনাল না মেলায় ডেলিভারি দেওয়া যাচ্ছে না। লবণের দাম বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা বেড়েছে। আবার ২০ শতাংশ চামড়া লাম্পি ডিজিজে আক্রান্ত হয়, যা একেবারে লোকসান। অর্থসংকট তো রয়েছেই।"
এই ব্যবসায়ী মনে করেন, এলডাব্লিউজি সনদ ছাড়া এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, "সরকার চাইলে সিইটিপি ও ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সমস্যা সমাধান করে বিনিয়োগ করতে পারে। আমরা প্রস্তুত আছি।"
তাজিন লেদার করপোরেশনের মালিক ও বিটিএ'র ভাইস চেয়ারম্যান আশিকুর রহমান বলেন, "এ বছর কাঁচা চামড়ার দাম বাড়লে সংকট আরও গভীর হবে। গত বছর যে চামড়া ৭০–৭২ সেন্টে বিক্রি করেছি, এ বছর তা শুরু হচ্ছে ৪৫ সেন্ট থেকে।"
তিনি জানান, "দেশের ফুটওয়্যার মার্কেটের ৯০ শতাংশ চামড়া বন্ড সুবিধায় আমদানি করা হয়, ফলে সেখানেও আমাদের দখল কম। কেমিকেল সংকটও রয়েছে। ক্রোমিয়ামের দাম ২৮০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে, যেখানে স্বাভাবিক দাম ১২৮–১৩০ টাকা।"
সিইটিপি আপগ্রেডেশন
এদিকে ব্যবসায়ীরা শিল্প নগরীকে এলডাব্লিউজি সনদের উপযুক্ত করতে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ দাবি করলেও এখনো সিইটিপির আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উত্তরণের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট রোডম্যাপ জানাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
তবে ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম শাহনেওয়াজ জানান, "এলডাব্লিউজি সনদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির কাজ চলছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ১৫ মাস মেয়াদী একটি প্রকল্প শুরু হয়েছে, যার আওতায় সিইটিপির ক্যাপাসিটি, ডিজাইন ও সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট মূল্যায়ন করা হবে। এরপর প্রয়োজনীয় সংস্কার নির্ধারণ করে রোডম্যাপ তৈরি করা হবে।"
এছাড়া বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি 'সেইফ ল্যান্ডফিল' তৈরির কাজও শুরু হয়েছে, যা ধলেশ্বরী নদী ও আশপাশের পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক হবে।
তিনি জানান, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এলডাব্লিউজি সনদে ১৫০ নম্বর নির্ধারিত আছে। সেইফ ল্যান্ডফিল বাস্তবায়িত হলে এলডাব্লিউজি অর্জনের পথে বড় অগ্রগতি হবে।
এছাড়া প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ শেভিং ডাস্ট সংগ্রহ করে ক্রোম পৃথক করে প্রোটিন উৎপাদনে একটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
সিইটিপির সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কারিগরি উন্নয়নের পাশাপাশি ঈদ সামনে রেখে ওভারহোলিং চলছে এবং অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে ঢাকার বাইরে দুই সপ্তাহ চামড়া সংরক্ষণ ও রেশনিং পদ্ধতিতে কারখানা পরিচালনার প্রস্তুতি নেওয়া হতে পারে বলেও জানান গোলাম শাহনেওয়া।
তার দাবি, অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে সিইটিপির অবস্থা অনেক ভালো।