‘অক্ষয় শক্তি’র চাবিকাঠি কয়েন আকৃতির ব্যাটারিতে, আর চীন ইতোমধ্যে তা তৈরি শুরু করেছে

ব্যাটারির জগতে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এর স্থায়িত্ব।
ছোট পরিধেয় ডিভাইস থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ গ্রিডের ব্যাকআপ—সবক্ষেত্রেই যেসব ব্যাটারি বেশি দিন চলে ও নির্ভরযোগ্য, সেগুলোই এগিয়ে থাকে।
গত ৭০ বছর ধরে পারমাণবিক ব্যাটারির উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। ১৯৫০-এর দশকে তারা প্রথম পারমাণবিক ব্যাটারি তৈরি করে। তবে এখন এ প্রযুক্তিতে চীন অনেক এগিয়ে গেছে। তারা এমন ব্যাটারি তৈরি করছে যা কয়েক দশক পর্যন্ত চার্জ না করেও কাজ করতে পারে।
এ ব্যাটারি ভবিষ্যতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির ভিত্তি হতে পারে—যেমন মানুষের মতো চিন্তাভাবনা করা রোবট বা গভীর মহাকাশ ভ্রমণের যন্ত্রপাতি।
২০২৪ সালের শুরুতে চীনের বেটাভোল্ট কোম্পানি 'বিভি১০০' নামে কয়েনের আকৃতির একটি ছোট পারমাণবিক ব্যাটারি প্রকাশ্যে আনে। এটি নিকেল-৬৩ নামে একটি তেজস্ক্রিয় উপাদান ব্যবহার করে এবং প্রায় ৫০ বছর ধরে চলতে পারে। এটি শুধু গবেষণার বস্তু নয়—ইতোমধ্যেই এর উৎপাদন শুরু হয়েছে। চিকিৎসা, মহাকাশ ও ভবিষ্যতের স্মার্টফোনে এটি ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে।
আমরা অনেকেই ব্যাটারিকে শুধু বাড়তি সুবিধা হিসেবে দেখি, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এটি জীবন-মরণ প্রশ্ন। যেমন মহাকাশে দীর্ঘদিনের গবেষণা বা জীবনরক্ষাকারী যন্ত্রের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি দরকার।
পারমাণবিক ব্যাটারিতে এমন উপাদান ব্যবহার করা হয়, যেগুলোর নিউক্লিয়াস নিজে থেকেই শক্তি হারায়। এ শক্তি কাজে লাগাতে বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। যেমন, ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে নাসা এমন ব্যাটারি তৈরি করেছিল, যা তেজস্ক্রিয় ক্ষয় থেকে সৃষ্ট তাপের মাধ্যমে চালিত হতো।
বর্তমানে নতুন এক ধরনের ব্যাটারি এসেছে, যেগুলো বিটা কণা দিয়ে চালিত হয়। এ কণাগুলো তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের সময় বের হয় এবং এক ধরনের সেমিকন্ডাক্টরের ওপর পড়ে বিদ্যুৎ তৈরি করে—যেমনটা বেটাভোল্টের ব্যাটারিতে হয়।
এ ব্যাটারিতে দুটি প্রধান অংশ থাকে—একটি তেজস্ক্রিয় উৎস, আরেকটি সেমিকন্ডাক্টর শোষক। তেজস্ক্রিয় উপাদান ক্ষয়ের সময় বিটা কণা ছাড়ে, যা সেমিকন্ডাক্টরের গায়ে পড়ে বিদ্যুৎ তৈরি করে। যেহেতু বিটা কণা সহজেই একটি পাতলা অ্যালুমিনিয়াম পাত দিয়ে আটকানো যায়, তাই এগুলো নিরাপদ বলে ধরা হয়।
নাসার পুরনো ব্যাটারিগুলোর মতো অনেক শক্তি দিতে না পারলেও বিটাভোল্টিক ব্যাটারি এক শতাব্দী পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে। এটি নির্ভর করে কোন তেজস্ক্রিয় উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে, তার ওপর।
এ ব্যাটারি এখনই আমাদের মোবাইলে ব্যবহৃত লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিকে বদলাবে না। কিন্তু যেসব জায়গায় ব্যাটারি বদলানো কঠিন—যেমন মহাকাশ যান, গভীর সমুদ্রের যন্ত্র বা পেসমেকার—সেখানে এটি খুবই উপযোগী।
যেহেতু বিশ্ব এখন কার্বনমুক্ত শক্তির দিকে এগোচ্ছে এবং স্মার্ট ডিভাইসের ব্যবহার বাড়ছে, তাই পারমাণবিক ব্যাটারির গুরুত্বও বাড়ছে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপ—সবাই এ প্রযুক্তিতে কাজ করছে।
চীনের বেটাভোল্ট একমাত্র কোম্পানি নয়। সম্প্রতি চীনের গানসু প্রদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় ১০০ বছর ধরে চলতে পারে এমন একটি নতুন ব্যাটারি ঘোষণা করেছে, যাতে কার্বন-১৪ ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও এটি একটি বিরল উপাদান, তবু চীনের একটি চুল্লিতে এর উৎপাদন চলছে। চীন এখন নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে এ ব্যাটারির জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ উৎপাদন ব্যবস্থাও গড়ে তুলছে।
চীন দ্রুত এগিয়ে গেলেও অন্য দেশগুলোও পিছিয়ে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার 'সিটি ল্যাবস' মহাকাশ গবেষণার জন্য বিটাভোল্টিক ব্যাটারি নিয়ে কাজ করছে।
২০২৪ সালের নভেম্বরে তারা পেসমেকারের জন্য দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি তৈরির প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য সংস্থা (এনআইএইচ) থেকে তহবিল পেয়েছে। ট্রিটিয়াম নামক একটি উপাদান ব্যবহার করে তারা ২০ বছর স্থায়ী ব্যাটারি তৈরি করছে।
এ প্রতিষ্ঠান মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই এ প্রযুক্তির জন্য পূর্ণাঙ্গ সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। এর প্রধান নির্বাহী জানান, বিভিন্ন গবেষণাগার ও কোম্পানি ইতোমধ্যেই সে পথে এগোচ্ছে।
সিটি ল্যাবস ১৯৭০-এর দশকে বিশ্বের প্রথম সফল বিটাভোল্টিক ব্যাটারি তৈরি করেছিল। কিন্তু তখন এর সীমিত কার্যক্ষমতা ও পারমাণবিক শক্তির প্রতি জনসাধারণের সন্দেহের কারণে প্রযুক্তিটি ছড়িয়ে পড়েনি। এখন পরিস্থিতি বদলেছে।
সিটি ল্যাবস ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের আরও দুটি কোম্পানি গত বছর এ প্রযুক্তিতে কাজ শুরু করেছে। একইভাবে, যুক্তরাজ্যের একটি কোম্পানি ২০২৪ সালে পারমাণবিক বর্জ্য দিয়ে ব্যাটারি তৈরি করেছে।
একটি 'না থেমে চলতে থাকা' ব্যাটারি ভবিষ্যতের প্রযুক্তিকে কীভাবে বদলে দিতে পারে, তা কল্পনা করা কঠিন নয়। আর ২০২৩ সালে বেটাভোল্ট যখন ৫০ বছরের ব্যাটারি প্রকাশ করে, তখন থেকেই বিশ্বের কোম্পানি, গবেষণাগার আর সরকারগুলো নড়েচড়ে বসেছে।
৭০ বছর আগে এ প্রযুক্তির যাত্রা শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এর প্রকৃত সময় এসে গেছে। আর নেতৃত্বে এবার যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং চীন।