রাশিয়ার আক্রমণের পর যুদ্ধ শুরু করার জন্য জেলেনস্কিকে দায়ী করলেন ট্রাম্প

রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে দায়ী করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। রাশিয়ার একটি বড় হামলায় ইউক্রেনে ৩৫ জন নিহত এবং ১১৭ জন আহত হওয়ার পরদিন এ মন্তব্য করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। খবর বিবিসি'র।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধে 'লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর' জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পাশাপাশি ইউক্রেনীয় নেতা জেলেনস্কিরও দায় আছে।
'আপনি আপনার চেয়ে ২০ গুণ বড় প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে তারপর আশা করতে পারেন না যে, সবাই আপনাকে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাবে,' সাংবাদিকদের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে আলাপকালে বলেন ট্রাম্প। একইসঙ্গে তিনি এই যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকেও দায়ী করেন।
রোববার ইউক্রেনের সুমি শহরে রাশিয়ার এক ভয়াবহ হামলার ঘটনায় ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর ট্রাম্প এই মন্তব্য করেন। এটি চলতি বছরের মধ্যে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সবচেয়ে প্রাণঘাতী রুশ হামলা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
হামলার বিষয়ে এর আগে প্রশ্ন করা হলে ট্রাম্প বলেন, এটি ছিল 'ভয়ঙ্কর' এবং তাকে বলা হয়েছিল রাশিয়া 'ভুল করেছে'। তবে তিনি এ বিষয়ে আর বিস্তারিত কিছু বলেননি।
'তিনজন ব্যক্তির কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে,' সোমবার বলেন ট্রাম্প। 'ধরা যাক, একজন পুতিন। দ্বিতীয়জন বাইডেন, যিনি জানতেন না তিনি কী করছিলেন। আর তৃতীয়জন জেলেনস্কি।'
ধারণা করা হয়, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় হামলা শুরু করার পর থেকে যুদ্ধরত দুই দেশের বহু মানুষ হতাহত হয়েছেন—এ সংখ্যা কয়েক মিলিয়ন (১০ লাখের বেশি) না হলেও কয়েক লাখ হতে পারে।
জেলেনস্কির যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ইউক্রেনীয় এই নেতা 'সবসময় ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে চাইছেন'।
'যখন আপনি যুদ্ধ শুরু করেন, তখন আপনাকে জানতে হবে যে আপনি এটি জিততে পারবেন কি না,' বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
২০১৪ সালে রাশিয়া প্রথম ইউক্রেনে আক্রমণ চালায়। জেলেনস্কি তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। তিনি প্রেসিডেন্ট হন তার পাঁচ বছর পর, এবং ২০২২ সালে যুদ্ধ আরও বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ট্রাম্প বারবারই জেলেনস্কি ও বাইডেনকে সংঘাতের জন্য দায়ী করে আসছেন।
সোমবার ট্রাম্প আরও বলেন, 'বাইডেন চাইলে যুদ্ধ থামাতে পারতেন, জেলেনস্কিও পারতেন। আর পুতিনের তো এটি শুরুই করা উচিত হয়নি। সবাই দোষী।'
ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসের এক বৈঠকে ট্রাম্প ও জেলেনস্কির মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা হয়।
সেই বৈঠকে ট্রাম্প অভিযোগ করেন, জেলেনস্কি 'তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন' এবং তিনি [জেলেনস্কি] রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু না করায় তাকে তিরস্কার করেন।
অন্যদিকে, ট্রাম্প মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা করেন।
তিনি বলেন, গত মাসে পুতিনের সঙ্গে তার 'দারুণ' ফোনালাপ হয়েছে এবং এক সপ্তাহ পর রুশ প্রেসিডেন্ট তাকে উপহার হিসেবে একটি প্রতিকৃতি পাঠিয়েছেন।
ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে একটি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয়, যেখানে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে 'আগ্রাসী' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে ব্যর্থ হওয়ার পর ট্রাম্প জানান, তিনি পুতিনের ওপর 'খুব ক্ষুব্ধ', যদিও যোগ করেন, রুশ নেতার সঙ্গে তার 'ভালো সম্পর্ক' রয়েছে।
শুক্রবার সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের দূত স্টিভ উইটকফ।
তার ভাষ্য অনুযায়ী, রুশ নেতার পক্ষ থেকে 'যুদ্ধবিরতির বাইরেও স্থায়ী শান্তির' আহ্বান জানানো হয়েছে। আলোচনায় পাঁচটি ইউক্রেনীয় অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোচনা হয়, যেগুলো রাশিয়া দাবি করছে তারা সংযুক্ত করেছে। আলোচনায় 'নো ন্যাটো, আর্টিকেল ৫'-এর প্রসঙ্গও উঠে আসে—যেখানে বলা আছে, কোনো সদস্য রাষ্ট্র আক্রান্ত হলে অন্য সদস্যরা তার প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসবে।
'আমি মনে করি, আমরা এমন কিছু একটা পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে আছি যা বৃহৎ পরিসরে বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে,' সোমবার ফক্স নিউজকে বলেন উইটকফ।
তিনি আরও বলেন, 'রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক পুনর্গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে, যা কিছু আকর্ষণীয় বাণিজ্যিক সুযোগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, এসব সুযোগ এই অঞ্চলে প্রকৃত স্থিতিশীলতা এনে দেবে। অংশীদারিত্ব থেকেই স্থিতিশীলতা আসে।'
তবে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এ বিষয়ে তুলনামূলকভাবে কম আশাবাদী মন্তব্য করেছেন। তিনি এই যোগাযোগকে ইতিবাচক বলে উল্লেখ করলেও কোনো চুক্তির সুস্পষ্ট কাঠামো ছিল না বলে জানান।
সুমিতে রাশিয়ার প্রাণঘাতী হামলার আগে রেকর্ড করা এক সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কি বলেন, যুদ্ধ শেষ করার জন্য পুতিনের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে যাওয়ার আগে তিনি চান, ট্রাম্প যেন ইউক্রেন সফরে এসে পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখেন।
'অনুগ্রহ করে, যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা আলোচনা শুরুর আগে—মানুষকে দেখুন, বেসামরিক নাগরিকদের দেখুন, যোদ্ধাদের, হাসপাতাল, গির্জা, ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন, মৃত শিশুদের চোখে দেখুন,' সিবিএসের '৬০ মিনিটস' অনুষ্ঠানে বলেন জেলেনস্কি।
রোববার সুমির কেন্দ্রস্থলে রুশ বাহিনী দুটি ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করলে কমপক্ষে ৩৫ জন নিহত হন।
ইস্টারের এক সপ্তাহ আগে 'পাম সানডে' উপলক্ষে অনেক বেসামরিক নাগরিক গির্জায় যাচ্ছিলেন। সেই সময় কয়েক মিনিটের ব্যবধানে এই দুটি বিস্ফোরণ ঘটে।
হামলায় একটি বাস ধ্বংস হয়ে যায় এবং শহরের রাস্তার মাঝখানে মরদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে।
মস্কো দাবি করে, তারা ইউক্রেনীয় সেনাদের একটি সমাবেশ লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে ৬০ জনকে হত্যা করেছে। তবে সেই দাবির পক্ষে তারা কোনো প্রমাণ হাজির করেনি।
ট্রাম্প জোর দিয়ে বলেন, তিনি 'হত্যা বন্ধ করতে' চান এবং শিগগিরই প্রস্তাব আসবে বলে ইঙ্গিত দেন। তবে বিস্তারিত কিছু জানাননি।
ইউক্রেন সংকট এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলমান। ২০১৪ সালে কিয়েভের রুশপন্থি প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে দেওয়ার পর রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে এবং পূর্ব ইউক্রেনে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিদ্রোহীদের সমর্থন দিতে শুরু করে।