ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কতদিন টিকতে পারবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে দাবি জানিয়েছে তা কোনো ভাবেই মেনে নেবে না হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়। তহবিল না পেলেও তারা এ দাবি মানবে না বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। খবর বিবিসির।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট অ্যালান গারবার বলেন, "যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কী পড়ানো হবে তা কোনো সরকারই নির্ধারণ করতে পারে না।"
বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে চলবে, নিয়োগ ও পাঠদানসহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে হোয়াইট হাউসের দেওয়া নির্দেশনা প্রত্যাখান করেছে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়ে অস্বীকৃতি জানালে তাদের জন্য নির্ধারিত ২.২ বিলিয়ন ডলারের ফেডারেল তহবিল স্থগিত করে ট্রাম্প প্রশাসন।
গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্প লেখেন, "সবাই জানে হার্ভাড পথ হারিয়েছে। হার্ভাড এখন সবার কাছে হাসির পাত্র। সেখানে শুধু ঘৃণা ও মূর্খতা শেখানো হয়। এ ধরণের প্রতিষ্ঠানকে তহবিল দেওয়া উচিত না।"
হার্ভাডের অনেক বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে 'আনাড়ি' আখ্যা দিয়েছেন। তিনি হার্ভার্ডকে উচ্চশিক্ষার জন্য এক অনুকরণীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করেন।
এমন সিদ্ধান্তের জন্য দেশটির শিক্ষা বিভাগ হার্ভাডের মানসিকতাকে 'উদ্বেগজনক' বলে অভিযোগ করেছে। তাদের ভাষায়, এমন উদ্বেগজনক মানসিকতা দেশের আরও অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়েরই রয়েছে। তারা বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফেডারেল তহবিল পেতে চায় ঠিকই কিন্তু তারা কোনো বেসামরিক দায়িত্ব পালন করতে চায় না।
বিলিয়ন ডলারের ফেডারেল তহবিল হয়ত এখন ঝুঁকির মুখে। কিন্তু সরকার ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে 'নৈতিক অবস্থান' ধরে রাখার লড়াই হয়ত ক্রমেই বাড়বে। আর এ লড়াইয়ের শুরুটা করেছে হার্ভার্ড।
হার্ভার্ডের ওপর ট্রাম্পের এ আক্রমণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। ইতোমধ্যেই সরকার ইহুদি-বিরোধী টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে। এ বিষয়ে পর্যালোচনার জন্য টাস্ক ফোর্স কমপেক্ষ ৬০ টি বিশ্ববিদ্যালয়কে চিহ্নিত করেছে।
তবে সর্বশেষ এই পদক্ষেপ হঠাৎ করে আসেনি। ট্রাম্প ও তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন। ২০২১ সালে এক বক্তৃতায় ভ্যান্স বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে 'শত্রু' বলে মন্তব্য করেছেন।
ট্রাম্পের দলের মতে, গত বছর ফিলিস্তিনের সমর্থনে হওয়া আন্দোলনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। তাদের দাবি, আন্দোলন চলাকালে অনেক ইহুদি শিক্ষার্থী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন এবং হেনস্তার শিকার হয়েছেন।
গত মাসে সরকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০০ মিলিয়ন ডলারের তহবিল কমিয়ে দিলে ট্রাম্প প্রশাসনের অনেক শর্তই মেনে নিতে রাজি হয় বিশ্ববিদ্যালয়টি।
হার্ভার্ডও এক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে ছাড় দিয়েছে। তারা সরকারের ইহুদি-বিরোধী টাস্কফোর্সকে সহযোগিতা করার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি মধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়ন কেন্দ্রের নেতাদের বরখাস্ত করেছে এবং ইসরায়েল বিরোধী বিভিন্ন ধর্ম, সংঘাত এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা বিষয়ক উদ্যোগ স্থগিত করেছে।
এছাড়া জানুয়ারিতে, হার্ভার্ড ইহুদি শিক্ষার্থীদের দায়ের করা দুটো মামলারও সমাধান করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়নি। তারা ইহুদি শিক্ষার্থী ও কর্মীদের প্রতি সমর্থনের প্রতিশ্রুতির বিষয়েও পদক্ষেপ নিয়েছে।
তবে গত শুক্রবার হোয়াইট হাউসের সব দাবি মেনে নিতে একমত হয়নি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামাইয়া ইভান্স একজন অধিকারকর্মী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আফ্রিকান এবং আফ্রিকান-আমেরিকান রেজিস্টেন্স অর্গানাইজেশনের সদস্য। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্তটি একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পদক্ষেপ ছিল।
তিনি বিবিসিকে বলেন, "হার্ভার্ড শুধু সেই কাজই করবে যার জন্য তাকে জবাবদিহি করতে বাধ্য।" তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তি যে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে ও সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
ইভান্স আরও বলেন, "তাছাড়া হার্ভাডের স্বার্থের জন্য অস্বাভাবিক এমন কোনো কাজই তারা করবে না।"
তাছাড়া হার্ভার্ডের ৫৩.২ বিলিয়ন ডলারের একটি বিশাল তহবিল রয়েছে—যা কিছু ছোট দেশের জিডিপি'র চেয়েও বেশি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, তবুও বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য এটি একটি সংকট।
আমেরিকান কাউন্সিল অন এডুকেশনের মুখপাত্র স্টিভেন ব্লুম বলেন, "বেশিরভাগ নীতিনির্ধারকরা এন্ডাউমেন্টকে (দানকৃত তহবিল) একটি চেকিং অ্যাকাউন্ট বা ডেবিট কার্ড হিসেবে ভাবেন, যেখানে টাকা উত্তোলন করা যায় এবং যেকোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বিষয়টি আসলে তা নয়।"
ব্লুমের মতে, হার্ভার্ডের এন্ডাউমেন্টের পরিমাণ চমকপ্রদ হলেও, এর ৭০ শতাংশ অর্থ বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ।
হার্ভার্ডকে দেওয়া দাতাদের অর্থ তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী খরচ করতে হবে, নাহলে আইনি ঝুঁকি থাকতে পারে।
তাছাড়া হার্ভার্ডের খরচও অত্যন্ত বিশাল। ২০২৪ সালে এর বাজেট ছিল ৬.৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ তহবিল এসেছে এন্ডাউমেন্ট থেকে এবং ১৬ শতাংশ এসেছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে। সরকারের তহবিল সাধারণত এমন প্রকল্পগুলোর জন্য ব্যবহৃত হয় যা সার্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উপকারী, যেমন বায়োমেডিক্যাল গবেষণা।
স্টিভেন ব্লুম বলেন, এন্ডাউমেন্ট ফাইনান্সের অন্যতম মূলনীতি হল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বছরে তাদের মোট এন্ডাউমেন্টের ৫ শতাংশের বেশি খরচ করতে পারে না।
একটি ২ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়কে তার এন্ডাউমেন্ট ৪০ বিলিয়ন ডলার বাড়াতে হবে।
ব্লুম বলেন, "আর এ ৪০ বিলিয়ন ডলার আপনি কোনো পাথর চাপা অবস্থায় পাবেন না।"
তাছাড়া হার্ভার্ডের এ সংকট ট্রাম্প আরও বাড়াতে পারবেন যদি তিনি তার হুমকি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কর-মুক্ত স্ট্যাটাস বাতিল করেন। এই স্ট্যাটাসের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়কে তার বিনিয়োগ ও সম্পদের উপর কোনো কর দিতে হয়না। হার্ভার্ডের গ্রেটার বোস্টন এলাকায় অনেকগুলো ক্যাম্পাস রয়েছে এবং ব্লুমবার্গের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে এটি তার সম্পত্তির কর বিল থেকে ১৫৮ মিলিয়ন ডলার সঞ্চয় করেছে।
গতকাল বুধবার সকালে হার্ভার্ডকে 'মৌলবাদী বাম' বলে আখ্যা দিয়ে ট্রাম্প বলেন, প্রতিষ্ঠানটি আর শিক্ষার উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
এ পরিস্থিতি কিছু শিক্ষার্থীদের ভাবিয়ে তুলছে।
হার্ভার্ডের ছাত্র পরিষদের শিক্ষা বিষয়ক প্রতিনিধি ম্যাথিউ টোবিন বলেন, "যদি সরকার চায় তারা হার্ভাডের সঙ্গে অনেক কিছুই করতে পারে এবং শুধু ২.২ বিলিয়ন ডলারের তহবিল কমিয়ে ট্রাম্প থেমে যাবেন এমনটা আশাও করছি না।"
টোবিন বলেন, হার্ভার্ডকে সাহায্য করতে ট্রাম্প প্রশাসন এসব করছে এ দাবি একেবারেই 'মিথ্যাচার'।
তিনি বিবিসিকে বলেন, আক্রমণটি সম্পূর্ণ খারাপ ইচ্ছা থেকে করা হয়েছে। ট্রাম্প বিশ্বাস করে বিশ্ববিদ্যালয়টি উদারপন্থি। তহবিল কমানোর মাধ্যমে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান। বিশ্ববিদ্যালয় মানুষকে কী শেখায়, শিক্ষার্থীরা কীভাবে শেখে ও কী ভাবে তার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি।