ট্রাম্প-মামদানির অপ্রত্যাশিত 'বন্ধুসুলভ' আচরণে রাজনৈতিক মহলে প্রতিক্রিয়া মিশ্র
একে অপরের সঙ্গে হাসাহাসি ও রসিকতা ছিল দেখার মতো। সেই সঙ্গে সেদিন দুজনের মুখেই ছিল একে অপরের জন্য আন্তরিক প্রশংসা— হোক সেটা কূটনৈতিক কিংবা অন্যান্য বিষয়ে।
গত শুক্রবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের কাছে তাদের এমন বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ অপ্রত্যাশিতই ছিল। সাংবাদিকদের সামনেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উষ্ণভাবেই নিউ ইয়র্ক সিটির নতুন নির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানির হাতে হাত রেখে সরল উত্তর দেওয়ার পরামর্শ দেন।
এসময় মামদানিকে ট্রাম্প ফ্যাসিস্ট কিনা প্রশ্ন করা হলে মামদানিকে উদ্দেশ করে ট্রাম্প বলেন, 'আপনি শুধু হ্যা বলতে পারেন। এটা আপনার জন্য সহজ।'
ট্রাম্পের এমন স্নেহপূর্ণ দৃশ্য ছিল অবাক করার মতো। তার এ আচরণ সবাইকেই হতবাক করেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নিউ ইয়র্ক সিটিরি নতুন মেয়র জোহরান মামদানি মুখোমুখি হবেন তা অনেক নিউ ইয়র্কবাসীর জন্য অকল্পনীয়ই ছিল। কিন্তু তারা একে অপরের মুখোমুখী হয়েছেন এবং একে অপরের সঙ্গে বেশ আন্তরিকভাবেই মিশেছেন।
স্টেটেন আইল্যান্ডের রক্ষণশীল নেতা রিপাবলিকান কংগ্রেসওমেন নিকোল ম্যালিওটাকিস বলেন, 'আমার কাছে তাদের সাক্ষাৎ একটু ব্রোমান্সের মতোই লাগছিল। নির্বাচনের ফল দেখে আমরা জানতাম মামদানি বেশ আকর্ষণীয়, কিন্তু কে ভেবেছিল তিনি প্রেসিডেন্টকেও মুগ্ধ করতে পারবেন?'
কয়েক সপ্তাহ ধরে ট্রাম্প প্রশাসন এবং জোহরান মামদানি নেতৃত্বাধীন সিটি হলের মধ্যে সম্ভাব্য বিধ্বংসী মুখোমুখি সংঘাত দেখার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন নিউ ইয়র্কের নেতারা।
তারা ভেবে রেখেছিলেন—প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিউইয়র্ক সিটিতে ফেডারেল সেনা পাঠাতে পারেন কিংবা অভিবাসন প্রয়োগকারী এজেন্টদের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারেন। এছাড়া তহবিল কমিয়ে দেওয়ার বিষয় নিয়েও উদ্বিগ্ন ছিলেন তারা।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা দ্রুত সাড়া দেওয়ার জন্য দল গঠন করেছেন এবং ব্যবসায়িক নেতাদের সহযোগিতা চেয়েছেন।
তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণও ছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুধু নিউইয়র্ক সিটিকে হুমকি দিয়েছেন তা-ই নয়, বরং তিনি ব্যক্তিগতভাবেও মামদানিকে মেয়র নির্বাচনে জয়ী হওয়া থেকে আটকানোর চেষ্টা করেছেন। এমনকি তিনি রিপাবলিকানদের আহ্বান জানিয়েছিলেন যেন তারা নিজেদের দলের প্রার্থীকে বাদ দিয়ে ডেমোক্র্যাটদের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু এম. কুমোকে সমর্থন করেন।
কিন্তু শুক্রবার ওভাল অফিস থেকে সরাসরি প্রচার করা তাদের সাক্ষাতের দৃশ্য সব এলোমেলো করে দিয়েছে।
সেদিন সেখানে জোহরান মামদানি হাসি দিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং ট্রাম্প তাকে অকল্পনীয় প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছেন। এসময় মামদানির নিউ ইয়র্কে বর্তমান পুলিশ কমিশনারকে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত, তার বাসস্থানসংক্রান্ত ও সামর্থ্যবান শহর গড়ার নীতির প্রশংসা করেছেন ট্রাম্প। এর পাশাপাশি গণমাধ্যমের করা অস্বস্তিকর প্রশ্ন মোকাবেলায়ও মামদানিকে সহায়তা করেছেন ট্রাম্প।
ট্রাম্পের ভাষ্যমতে, ইসরায়েল ও গাজা নিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে থাকা এই দুই ব্যক্তি সেখানেও নাকি কোনো মিল খুঁজে পেয়েছেন।
নিজেকে পরিপূর্ণ শান্তিদূত হিসেবে তুলে ধরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, মি. মামদানি নিজেও 'মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি' নিয়ে খুব দৃঢ় অনুভূতি রাখেন।
রেডিও হোস্ট সিড রোজেনবার্গকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, মামদানি নাকি আরেকটি ৯/১১কে স্বাগত জানাতে যাচ্ছেন। তিনিও প্রেসিডেন্টের আচরণে হতবাক। তিনি বিষটি বিশ্বাস করতে পারছেন না। এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন, যার শুরুতে কিছু অশ্রাব্য ভাষাও ব্যবহার করা হয়। অবশ্য পড়ে তিনি ভিডিওটি সরিয়ে ফেলেন।
রোজেনবার্গ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'আমি ট্রাম্পকে ভালোবাসি এবং আমি প্রায় কখনোই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমালোচনা করি না। তিনি অনেকের সঙ্গে দেখা করেন। পুতিন থেকে কিম জং-উনের মতো ভয়ংকর মানুষ—যারা আমাদের মেরে ফেলতে চায়, তাদের সঙ্গেও তিনি দেখা করেন। এভাবেই তিনি সমস্যার সমাধান করেন। আমি বুঝি।'
কিন্তু, মি. মামদানিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, 'নিউইয়র্কের একজন ইহুদি হিসেবে এই লোকটিকে আমার খুবই খারাপ লাগে। আর তাদের হাত মেলানো আর হাসতে দেখা—এটা দেখে আমার বমি চলে আসছিল।'
মামদানির রাজনৈতিক উত্থানে সন্দেহবাদী ও বিরোধীদের মন জয় করার ক্ষমতা বড় ভূমিকা রেখেছে। ট্যাক্সিচালক থেকে শুরু করে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী—সবাইকে তিনি নিজের রাজনৈতিক দক্ষতায় মুগ্ধ করতে পেরেছেন। শুক্রবারও তিনি যেন আবার সেটাই প্রমাণ করলেন।
নিউইয়র্কের ওয়ার্কিং ফ্যামিলিজ পার্টির সহপরিচালক আনা মারিয়া আরচিলা হাসতে হাসতে দেখছিলেন ট্রাম্পের 'শিথিল আর আনন্দিত আচরণ, এমন একজন মানুষের সঙ্গে যাকে তিনি আগে দেশছাড়া করার হুমকি দিয়েছিলেন'। (জুলাইয়ে ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন মামদানিকে গ্রেপ্তার করবেন বলে, এমনকি তিনি আরও বলেছিলেন, 'অনেকে বলছে, সে নাকি অবৈধভাবে এখানে আছে।' মামদানি উগান্ডায় জন্মগ্রহণ করলেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন।)
মিস আর্চিলা স্বীকার করেন যে তিনি 'অল্প একটু স্বস্তি' অনুভব করেছেন—ভাবছেন, হয়তো ট্রাম্পের নিউইয়র্কের বিরুদ্ধে দেওয়া সব হুমকি শেষ পর্যন্ত বাস্তবে নাও পরিণত হতে পারে, যদিও প্রেসিডেন্ট নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে কথা বলতে এড়িয়ে গেছেন।
তিনি বলেন, 'হয়ততো সম্ভাবনা আছে যে নিউইয়র্ক সিটিতে ১ জানুয়ারি ফেডারেল সেনা ঢুকবে না।'
এমন গভীর জাতীয় বিভাজনের সময়ে এই বৈঠকটি স্টেটেন আইল্যান্ডের ট্রাম্পপন্থি রিপাবলিকান ও সাবেক কাউন্সিলম্যান জো বোরেল্লিকেও খুশি করতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, 'একজন নিউইয়র্কার হিসেবে আমি নির্বাচিত-মেয়র ও প্রেসিডেন্ট—দু'জনকেই নিয়ে গর্বিত। আমার মনে হয় এটা মানুষের জন্য একটি ভালো শিক্ষা—আপনি যেভাবে তাদের চরিত্র আঁকেন, বাস্তবে তারা সব সময় তেমন নাও হতে পারেন।'
ঘটনাটি আরও উল্লেখযোগ্য মনে হলো, কারণ জাতীয় পর্যায়ের বহু ডেমোক্র্যাটিক নেতা যাকে অতিমাত্রায় বামঘেঁষা বলে মনে করেন—সেই মামদানি মাত্র এক ঘণ্টায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এমন সম্পর্ক গড়ে তুললেন, যা তার দল ট্রাম্পের অফিসে থাকা পাঁচ বছরে কখনও করতে পারেনি।
ব্রুকলিনের ডেমোক্র্যাটিক সিনেট সংখ্যালঘু নেতা চাক শুমার—যিনি কখনোই মামদানির প্রচারণার সমর্থন করেননি—সংক্ষেপে প্রশংসা জানান। তার মুখপাত্র বলেন, 'শুমার মনে করেন, এমন একটি বৈঠক নিউইয়র্কের জন্য শুধু ভালোই হতে পারে।'
অন্য প্রতিক্রিয়াগুলো ছিল আরও মজার।
ফক্স নিউজ উপস্থাপক ব্রায়ান কিলমিড বলেন, 'আমার মনে হয় জেডি ভ্যান্স হিংসে করছে। তারা সত্যিই অসাধারণভাবে একে অপরের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন।'
রাজনৈতিক প্রতিবেদক রস বারকান, যিনি একসময় স্টেট সিনেট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় মামদানিকে নিজের প্রচার ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়েছিলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন, 'শুমারের আগেই ট্রাম্প মামদানিকে সমর্থন করল।'
যদিও অনেক নিউইয়র্কার সিটি হল এবং হোয়াইট হাউসের মধ্যে কার্যকর সম্পর্কের সম্ভাবনায় আনন্দিত হয়েছেন। তারা আবার একই সঙ্গে প্রশ্নও রেখেছেন যে—ট্রাম্প আবার কতো দ্রুত মামদানির উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন।
ডেমোক্র্যাটিক সোশালিস্টস অফ আমেরিকার স্থানীয় শাখার সহ-সভাপতি গ্রেস মাউসার বলেন, 'আমার মনে হয় না ট্রাম্প কোনো বিশেষভাবে ধারাবাহিক বা নৈতিকভাবে পরিচালিত ব্যক্তি, তাই শহরে সম্ভাব্য ফেডারেল কার্যক্রম বৃদ্ধির জন্য আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।'
তিনি আরও বলেন, 'কিন্তু মোটের ওপর, জোহরান সবসময় স্পষ্টভাবে যোগাযোগ করতে সক্ষম এবং কার্যকর রাজনৈতিক নেতা এবং যদি এটি ট্রাম্পকে শহরের বিরুদ্ধে আক্রমণ না করতে প্ররোচিত করে, আমি মনে করি এটি ভালো।'
