শক্তিশালী হতে ঠিক কতটা প্রোটিন লাগে?

সোফিয়া মলসন (২১) পশ্চিম সাসেক্সের একজন ফিটনেস ইনফ্লুয়েন্সার। ১৯ বছর বয়স থেকেই তিনি ফিটনেসকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। শুরুতে কেবল ওজন কমানোর লক্ষ্যে জিমে যাওয়া শুরু করলেও ধীরে ধীরে তিনি পেশি গঠনের দিকে মনোযোগ দেন। খবর বিবিসি'র।
মলসনের উন্নতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল পুষ্টি সম্পর্কে বিশদভাবে জানা। তখনই তিনি বুঝতে পারেন, পেশি গঠনের জন্য প্রোটিন কতটা জরুরি। তবে নিরামিষভোজী হওয়ায় শুধু খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে পর্যাপ্ত প্রোটিন পাওয়া তার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এরপর তিনি প্রোটিন পাউডার গ্রহণ শুরু করেন।
তিনি বলেন, 'পরিকল্পিত খাদ্য তালিকার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় প্রোটিন গ্রহণ করা সম্ভব। তবে এটি সময়সাপেক্ষ এবং যথাযথ পরিকল্পনার প্রয়োজন হয়। ব্যস্ত জীবনে প্রোটিন পাউডার একটি সুবিধাজনক সমাধান দিতে পারে।'
প্রোটিন মানবদেহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি হজমের পর অ্যামিনো অ্যাসিডে বিভক্ত হয় এবং শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন প্রোটিন তৈরির উপাদান হিসেবে কাজ করে। হিমোগ্লোবিন, এনজাইম, পেশি, ত্বক ও চুলের কেরাটিনসহ শরীরের প্রায় ২০,০০০ প্রোটিন বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়।
তবে একজন মানুষের প্রয়োজনীয় প্রোটিনের পরিমাণ নির্ভর করে বয়স, শারীরিক গঠন ও জীবনযাত্রার ওপর। লন্ডনের স্পোর্টস ডায়েটিশিয়ান লিনিয়া প্যাটেল বলেন, 'যুক্তরাজ্যের সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী, দৈনিক কম সক্রিয় প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতি কেজি ওজনের বিপরীতে ০.৮ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। অর্থাৎ, যদি কারও ওজন ৭০ কেজি হয়, তবে তার দৈনিক ৫৬ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন।'
সাধারণত মানুষ দৈনন্দিন খাদ্য থেকেই প্রয়োজনীয় প্রোটিন পেয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে একজন ব্যক্তি গড়ে তার দৈনিক ক্যালোরির ১৪-১৬ শতাংশ প্রোটিন থেকে গ্রহণ করেন। তবে শারীরিকভাবে অধিক সক্রিয় ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই চাহিদা প্রতি কেজিতে ১ গ্রাম বা তারও বেশি হতে পারে।
বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে পেশির ঘনত্ব কমতে থাকে, তাই বয়স অনুযায়ী প্রোটিনের চাহিদাও পরিবর্তিত হয়। বিশেষত, মেনোপজ-পরবর্তী নারীদের জন্য প্রোটিনের প্রয়োজন আরও বেশি হয়ে ওঠে।
প্যাটেল বলেন, 'সবার জন্য এক নিয়ম প্রযোজ্য নয়। আমার অভিজ্ঞতা বলে, মেনোপজ-পরবর্তী নারীরা এবং পেশাদার ক্রীড়াবিদরা অনেক সময় তাদের বয়স বা শারীরিক কার্যক্ষমতার তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণ প্রোটিন গ্রহণ করেন না।'
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ভারোত্তোলন করেন বা প্রতিযোগিতামূলক শারীরিক অনুশীলনে অংশ নেন, তাদের জন্য দৈনিক ১.৬-২.২ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন, যা তাদের ওজন অনুযায়ী নির্ধারিত হয়।
বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমেই প্রোটিনের চাহিদা পূরণের পরামর্শ দেন। নিরামিষভোজীদের জন্য বাদাম, বীজ, সয়া-ভিত্তিক খাবার ও ডাল জাতীয় খাদ্য অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। শাকাহারীদের জন্য ডিম, দই ও নির্দিষ্ট ধরনের চিজ বাড়ানো যেতে পারে, আর যারা মাংস খান, তারা মাছ ও মাংসের পরিমাণ বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় প্রোটিন পেতে পারেন।
অনেকের জন্য পর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণের অর্থ হলো বিভিন্ন ধরনের খাবারের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। তবে সবার জন্য শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় প্রোটিন পাওয়া সহজ নয়, বিশেষত যখন সময় ও বাজেটের সীমাবদ্ধতা থাকে।
ভারতের কেরালার রাজাগিরি হাসপাতালের লিভার বিশেষজ্ঞ সাইরিয়াক অ্যাবি ফিলিপস বলেন, 'চর্বিহীন মাংস, ডিম, দুগ্ধজাত খাবার ও ডালজাতীয় খাবার সমৃদ্ধ একটি ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যতালিকার মাধ্যমে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। তবে বাস্তবে, অনেকের জন্য এটি পরিপূরক খাদ্য [প্রোটিন পাউডার] ছাড়া সহজ নয়।'
মলসন বলেন, 'খাদ্য তালিকায় উদ্ভিজ্জ প্রোটিন পাউডার যুক্ত করলে প্রোটিনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা অনেক সহজ হয়ে যায়। আমি বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছি, চর্বিহীন প্রোটিন পাউডার বা হোয়ে প্রোটিন আমার জন্য সবচেয়ে ভালো কাজ করে। কারণ এতে ক্যালরি কম, কিন্তু প্রোটিনের পরিমাণ বেশি।'
তবে, প্রোটিন পাউডারের কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। ইঁদুরের ওপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, শারীরিক পরিশ্রম না করলে এটি লিভারের ক্ষতি করতে পারে। মানুষের ক্ষেত্রেও হোয়ে ও সয়া-ভিত্তিক প্রোটিন পাউডারের কারণে কিছু বিরল ক্ষেত্রে লিভারের বিষক্রিয়া দেখা গেছে।
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক সংস্থা 'ক্লিন লেবেল প্রজেক্ট' বাজারের জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোর প্রোটিন পাউডারের ওপর গবেষণা চালায়। গবেষকরা ১৩৪টি পণ্যে ১৩০ ধরনের বিষাক্ত উপাদানের উপস্থিতি পরীক্ষা করেন এবং দেখতে পান, অনেক প্রোটিন পাউডারে ভারী ধাতু, বিসফেনল-এ (যা প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়), কীটনাশক ও অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে, যা ক্যানসারসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
প্যাটেল বলেন, 'প্রতিটি খাবারে পর্যাপ্ত প্রোটিন নিশ্চিত করাই মূল বিষয়। আমরা চাই, প্রতিটি খাবারে অন্তত ২০-৩০ গ্রাম প্রোটিন থাকুক। উদাহরণস্বরূপ, দুটি ডিম, দই ও বাদাম বা মুরগির বুকের মাংস থেকে এ পরিমাণ প্রোটিন পাওয়া যেতে পারে।'
ফিলিপসের মতে, ভেষজ উপাদানযুক্ত 'ব্লেন্ডেড' প্রোটিন এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এতে ভেজাল বা দূষণের ঝুঁকি বেশি থাকে। এসব সাপ্লিমেন্টে ভারী ধাতু ও ছত্রাকজনিত বিষাক্ত উপাদান থাকতে পারে, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
ম্যানাকার মতে, ভোক্তাদের সচেতন হওয়া জরুরি। তিনি বলেন, 'যেসব প্রোটিন পাউডারে উচ্চমানের উপাদান রয়েছে এবং ফিলার বা কৃত্রিম মিষ্টি কম, সেগুলো বেছে নেওয়া উচিত।'
এছাড়া, প্রোটিন পাউডারের উৎসও গুরুত্বপূর্ণ। এটি হুই, কেসিন, সয়া, উদ্ভিজ্জ বা প্রাণিজ উৎস থেকে এসেছে কি-না, তা যাচাই করতে লেবেল পড়া প্রয়োজন।
প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের সময়ও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ম্যানাকা বলেন, 'ব্যায়ামের ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে প্রোটিন গ্রহণ করলে শরীর এটি সহজে শোষণ করতে পারে এবং কার্যকারিতা বাড়ে।'
তবে, প্রোটিন পাউডারের গ্রহণপদ্ধতিও বিবেচ্য। এটি উপকারী হলেও প্রধান পুষ্টির উৎস হিসেবে একে গ্রহণ করা উচিত নয়। সম্পূর্ণ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাদ্যাভ্যাসের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত। ম্যানাকার মতে, প্রোটিন পাউডারকে নিয়মিত খাবারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করলে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টির ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
বর্তমানে প্রোটিন পাউডার ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার সহজলভ্য হওয়ায় অনেকেই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি প্রোটিন গ্রহণ করছেন। সাধারণত একজন প্রাপ্তবয়স্কের দৈনিক ৪৫-৫৬ গ্রাম প্রোটিনের প্রয়োজন হয়।
যদিও প্রোটিন পেশি গঠনের জন্য অপরিহার্য, তবে অতিরিক্ত গ্রহণ করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে উচ্চমাত্রার প্রোটিন গ্রহণ কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত যাঁদের কিডনির সমস্যা রয়েছে, তাদের আরও সতর্ক থাকা দরকার। এছাড়া, হঠাৎ করেই প্রোটিনের মাত্রা বাড়ালে পেটের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন গ্যাস, পেট ফেঁপে যাওয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য।
প্রোটিন পাউডারের গ্রহণমাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। প্যাটেল বলেন, 'প্রোটিন পাউডারের মাধ্যমে দৈনিক ৮০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করা উচিত নয়। বেশিরভাগ মানুষের জন্য এত উচ্চমাত্রার গ্রহণ প্রয়োজন হয় না, কারণ এটি প্রাকৃতিক খাবারের জায়গা দখল করে নেয়, যেখানে ভিটামিন, মিনারেল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান থাকে। আমি আমার বেশিরভাগ ক্লায়েন্টকে দৈনিক ২০-৪০ গ্রাম প্রোটিন পাউডার গ্রহণের পরামর্শ দিই।'
ভারী ব্যায়ামের ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাসের ভারসাম্য বজায় রাখতে উচ্চমানের কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ এবং ভিটামিন ডি, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের মতো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এগুলো পেশির সংকোচন, হাড়ের স্বাস্থ্য ও শক্তি বাড়ানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, খাদ্য তালিকায় নিয়মিত ফল, সবজি এবং সপ্তাহে অন্তত একবার তেলযুক্ত মাছ রাখা উচিত।
প্যাটেলের মতে, শক্তিশালী পেশি গঠনের জন্য পর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণের পাশাপাশি সঠিক প্রশিক্ষণ, শারীরিক ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত ঘুমও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।