ঘাটতি মোকাবিলায় ২০২৫ অর্থবছরে রেকর্ড ১২.৯৬ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করেছে সরকার

ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ধান উৎপাদনে ঘাটতির প্রেক্ষাপটে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেকর্ড ১২.৯৬ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করেছে সরকার।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে, এই খাদ্যশস্যের মধ্যে ৮ লাখ ৩০ হাজার টন চাল এবং ৪ লাখ ৬৬ হাজার টন গম রয়েছে। এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারি ব্যবস্থায় কোনো চাল আমদানি হয়নি, তখন শুধুমাত্র ৭ লাখ ৮৪ হাজার টন গম আমদানি করা হয়েছিল।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরে মূলত চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহসহ ধান উৎপাদনকারী প্রধান অঞ্চলগুলোতে পরপর চার দফা বন্যা হয়। এতে এসব অঞ্চলের উৎপাদন হ্রাস পায়। ফলে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি জরুরি হয়ে পড়ে। তবে এত বিপুল পরিমাণ আমদানি সত্ত্বেও মোটা চালের দাম খুচরা বাজারে বেড়েই চলেছে।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ১ জুলাই ঢাকার বাজারে মোটা চাল কেজিপ্রতি ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা এক বছর আগে ছিল ৪৮ থেকে ৫২ টাকা। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে কেজিতে ৭ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ মোটা চাল খেয়ে থাকেন।
খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সরকারের বিভিন্ন খাদ্য বিতরণ কার্যক্রম থেকে প্রায় ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ সরাসরি উপকৃত হচ্ছে।
খাদ্য সচিব মো. মাসুদুল হাসান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় টিবিএসকে জানান, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের কিছু চালান পরবর্তী অর্থবছরে এসে পৌঁছানোয় আমদানির পরিমাণ কিছুটা বেশি দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১২টি প্যাকেজের আওতায় (প্রতিটি প্যাকেজ ৫০ হাজার টনের) ৬ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে। এছাড়া জি-টু-জি ভিত্তিতে আরও ২ লাখ ৫০ হাজার টন চাল এবং ২ লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে খাদ্য অধিদপ্তর ও টিসিবির মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৩২.৪৩ লাখ টন খাদ্যশস্য সরবরাহ করেছে সরকার, যা আগের বছরের ৩২.১৯ লাখ টনের চেয়েও বেশি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারের খাদ্যশস্যের মজুত ছিল ১৭,৬৬,৬৮৬ টন।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪.১০ শতাংশ, যা অর্থবছর শেষে কমে দাঁড়িয়েছে ৮.২৬ শতাংশে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় খাদ্য সরবরাহ বাড়ায় মূল্যস্ফীতির এই হার কমেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
উৎপাদন ঘাটতির কারণে গেলো অর্থবছরে শুল্ক কমিয়ে বেসরকারি খাতে চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বেসরকারি খাত থেকে ৪.৬৯ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে।
সরকারি পর্যায়ে (জি-টু-জি) চাল এসেছে মিয়ানমার, পাকিস্তান ও ভিয়েতনাম থেকে, আর বাকি চাল সংগ্রহ করা হয়েছে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে। ডলার শক্তিশালী হওয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কম থাকায় খাদ্যশস্য আমদানিতে সরকারের ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৬ জুন দেশের বাজারে মোটা চালের দাম ছিল কেজিপ্রতি ৫৪ টাকা, যেখানে একই তারিখে আন্তর্জাতিক বাজারে একই মানের চালের দাম ছিল ৪৬.৪১ টাকা।
গত ২২ জানুয়ারি সচিবালয়ে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভা শেষে খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানির পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা পরে কমিয়ে ৭ লাখ টনে নামিয়ে আনা হয়। মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও মজুত বাড়াতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
গত ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে প্রকাশিত মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের আগস্ট ও অক্টোবর মাসে পরপর দুই দফা বন্যায় দেশে প্রায় ৩ লাখ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত কয়েক বছরে বিভিন্ন কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। এর ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানি হওয়ায় চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।
খাদ্য সচিব বলেন, "প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আগামী অর্থবছরে আমদানি কম হবে।" আগামী ১৫ জুলাই খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির বৈঠকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার ৬.৩৩ লাখ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬.৮৩ লাখ টন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫.৭২ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করেছিল।