অবাস্তব রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা না নির্ধারণে অর্থ মন্ত্রণালয়কে এনবিআর-এর অনুরোধ

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আগামী তিন অর্থবছরের জন্য আরও বাস্তবসম্মত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে।
অর্থ বিভাগের সচিবকে পাঠানো এক চিঠিতে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সতর্ক করে দিয়ে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ব্যবসায়িক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা উচিত। তিনি বলেন, "অন্যথায়, আগের বছরের মতোই লক্ষ্যমাত্রা অপূর্ণ থাকবে, আর দায় চাপানো হবে এনবিআরের ওপর।"
তিনি আরও উল্লেখ করেন, অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং তা অর্জনে ব্যর্থতা এনবিআরের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ পরিস্থিতি এড়াতে তিনি বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণের পরামর্শ দেন, যেখানে রাজস্ব প্রবৃদ্ধির হার প্রকৃত সংগ্রহের তুলনায় ১৫ শতাংশ রাখা যেতে পারে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যানদের কেউ কেউ বাজেট-সংক্রান্ত অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে বাস্তবসম্মত লক্ষ্যমাত্রার পক্ষে মত দিলেও, এই প্রথমবারের মতো কোনো চেয়ারম্যান আনুষ্ঠানিক চিঠির মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়কে "অবাস্তব" লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ না করার অনুরোধ জানালেন বলে জানিয়েছেন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা।
বিশেষজ্ঞরা এনবিআর চেয়ারম্যানের চিঠির ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কেউ কেউ তার অবস্থানকে স্বাগত জানালেও, অন্যদের মতে, এনবিআরের উচিত রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর কৌশল নির্ধারণ করা, কেবলমাত্র লক্ষ্যমাত্রা কমানোর দাবি জানানো যথেষ্ট নয়।
টিবিএসের হাতে আসা এনবিআর চেয়ারম্যানের চিঠিতে বলা হয়েছে, "আগামী তিন বছরের রাজস্ব অনুমান ও পূর্বাভাস নির্ধারণ করা উচিত আগের বছরগুলোর রাজস্ব প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে। কিন্তু বর্তমানে প্রস্তাবিত লক্ষ্যমাত্রাগুলো অবাস্তব এবং সঠিক গবেষণার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়নি।"
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, "যথাযথ পর্যালোচনা ও গবেষণা ছাড়া লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হলে, আগের বছরের মতো এবারও তা অপূর্ণ থাকবে।"
এতে দেশের উৎপাদন ও ব্যবসায়িক খাতের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, বিগত বছরগুলোতে বারবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি এড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
'দেশের অর্থনীতিতে রাজস্ব বৃদ্ধির উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে'
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, "দেশের রাজস্ব আহরণ জিডিপির তুলনায় কম— ৭ শতাংশের সামান্য ওপরে, যেখানে আদর্শভাবে এটি ১৫ শতাংশ হওয়া উচিত। অর্থাৎ, রাজস্ব বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে, তবে তা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না।"
তিনি আরও বলেন, "শুধু লক্ষ্যমাত্রা কমানোর পক্ষে সাফাই গাওয়ার বদলে এনবিআরের উচিত নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানো, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ করা এবং অপ্রয়োজনীয় কর ছাড় কমানোর ব্যবস্থা করা। এসব পদক্ষেপ রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।"
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, "এনবিআরের কাঙ্ক্ষিত সংস্কার, ডিজিটাইজেশন ও কার্যকর নজরদারি চালু করা হলে রাজস্ব আহরণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে পারে।"
এনবিআরের সাবেক সদস্য আলী আহমেদ বলেন, "সরকার অর্থনীতির আকার বড় দেখাতে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বড় বাজেট ও উচ্চ রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।" তবে তিনি উল্লেখ করেন, এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার প্রয়োজন, যা বাস্তবে সম্ভব হয়নি। "ফলে গত এক দশক ধরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অধরা থেকে গেছে," বলেন তিনি।
সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান আরও বাস্তবসম্মত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়ায় এনবিআর চেয়ারম্যানকে স্বাগত জানান।
তিনি বলেন, "রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী হওয়া উচিত, তবে তা যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়। বাস্তবসম্মত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলে তা অর্জনও সহজ হবে।"
তিনি আরও বলেন, "তবে বছরের পর বছর ধরে তৎকালীন হাসিনা সরকার অবাস্তব রাজস্ব সংগ্রহ ও সরকারি ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে আসছে, যা সামগ্রিক আর্থিক শৃঙ্খলার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।"
এক দশকে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে এনবিআর কখনোই বাজেটে নির্ধারিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। বেশিরভাগ বছরেই রাজস্ব সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ কম হয়েছে, ফলে বছরের মাঝামাঝি সময়ে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হয়েছে। তবে সংশোধনের পরও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।
তবে ২০১৩ অর্থবছরের আগের এক দশকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অন্তত চারটি অর্থবছরে এনবিআর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছিল। এমনকি ঘাটতি হলেও তা সাধারণত ১ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গড় রাজস্ব প্রবৃদ্ধির হার ১৫ শতাংশের আশপাশে থাকলেও, নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাগুলো আগের বছরের প্রকৃত রাজস্বের তুলনায় ৩০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি রাখা হয়েছে। ফলে অর্থবছরের শেষ দিকে এসে প্রায় প্রতি বছরই সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হয়েছে।