বিএনপির ঝটিকা মিছিল: অবস্থান নাও, ছবি তোলো, এরপর দুই মিনিটের মধ্যে সটকে পড়ো!

হেমন্তের এক পড়ন্ত বিকালে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ২০-২৫ জন নেতাকর্মী রাজধানীর মিরপুরের এক জায়গায় অবস্থান নিয়েছেন।
ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বেগম খালেদা জিয়ার অবিলম্বে মুক্তির দাবিতে তারা একটি পিভিসি ব্যানার নিয়ে এসেছেন সঙ্গে।
ঝটপট তৈরি হয়ে গেলেন সবাই, মিছিলের জন্য প্রস্তুত। এর মধ্যে একজন আন্দোলনকারীর কাজ হলো শুধু ছবি তোলা ও তাদের এই সমাবেশের ভিডিও করা।
মিছিল শুরুর দুই মিনিট পরে বেনারসি পল্লী পার হওয়ামাত্র কেউ একজন চিৎকার করে উঠলেন, 'পুলিশ আসছে! পুলিশ!'
এই চিৎকার কানে পৌঁছামাত্র বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। দ্রুত তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে পাশের গলিতে ঢুকে পড়ল চোখের নিমেষে।
চটজলদির আয়োজনের এই মিছিল স্থায়ী হলো মাত্র দুই মিনিট।
বিরোধী দল বিএনপি এখন মিছিল-পিকেটিংয়ের মতো প্রতিবাদের কাজটি করছে নতুন এক কৌশলে, তারা দ্রুত কোথাও ঝড়ের বেগে একত্র হয়, ত্বরিত শুরু হয় ঝটিকা মিছিল-স্লোগান। এবং এই মিছিলের মূল বিষয় হলো : একত্র হও! ঝটপট তার কিছু ছবি তোলো, ভিডিও করো, এবং তারপর পুলিশ আসার সঙ্গে সঙ্গে উধাও হয়ে যাও।
এরপরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো: এসব ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত পোস্ট করে ছড়িয়ে দাও। প্রচারের জন্য এসব ছবি, ভিডিও বিভিন্ন গণমাধ্যমের রাজনৈতিক বিটের সাংবাদিকদের কাছেও পাঠানো হয়।

এভাবেই বিএনপি দ্রুত ছবি ছড়িয়ে সারা দেশে তাদের বিক্ষোভের জানান দিচ্ছে ও আন্দোলনের বিস্তৃতি নজরে আনতে চাচ্ছে।
ফলে বর্তমানে বিক্ষোভের অবস্থা—এতে অংশ নেওয়া মানুষের সংখ্যা, শক্তি ও সামর্থ্য—সবই এক ধরনের ডিজিটাল বিভ্রমে পরিণত হয়েছে।
আদতে বিক্ষোভ মিছিলের আয়ু এখন সামান্য কয়েক মিনিট! এই মিছিল হলো তো এই আর নেই।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহামন আওয়ালকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান: 'পুলিশ এমন আচরণ করছে যেন তারা "সরাসরি যুদ্ধে আছে"।'
তিনি বলেন, 'আমরা আজ (২০ নভেম্বর) সকালে মগবাজার থেকে হাতিরঝিল পর্যন্ত মিছিলের পরিকল্পনা করেছিলাম। সকাল সাড়ে ৭টায় মিছিল শুরুর আগেই আমরা দেখি মগবাজার মোড় ও পাশের রেলগেট এলাকায় ৪০-৫০ জন পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
'দেখা গেল, এফডিসি থেকে হাতিরঝিল পর্যন্ত চারটি পথেই পুলিশ।
তারপরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতির মুখেই এফডিসি পার হয়ে মিছিলটি শুরু হয়, এবং কারওয়ান বাজারের প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের সামনে গিয়ে দ্রুতই শেষ হয়।
আওয়াল বলেন, 'আমরা তিন-চার মিনিটের বেশি মিছিল করতে পারিনি। যদি পুলিশ বা আওয়ামী লীগ আমাদের ধরতে পারে, তাহলে মারধরের শিকার হতে হবে। পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দিতে পারে। আর যদি ধরে থানায় নেওয়া হয়; তাহলে সেখানে পুলিশ তো আছেই, সাথে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরাও পেটাবে।'
তিনি আরও বলেন, 'কোনো রাজনৈতিক দলের নিরস্ত্র কর্মীরা রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে লড়াই করে পারে না। আমরা তো পুলিশ বা আওয়ামী লীগের মতো সশস্ত্র না।'
এই পরিস্থিতিতে বিএনপির কর্মীদের সামনে এখন একমাত্র পথ হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে ধরা না দিয়ে দ্রুত মিছিল করে সরে পড়া।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (মিরপুর অঞ্চল) হাসান মুহাম্মদ মুহতারিম জানান, তারা খুব কমই বিএনপি-জামায়াতকে মিছিল করতে দেখেছেন।
তিনি বলেন, 'তারা গোপনে কাজ করে। তারা এমন জায়গা বেছে নেয় যেখানে পুলিশ নেই, সেখানে অবস্থান নিয়ে ছবি তোলে, এরপর চলে যায়। তারা মূলত গ্রেপ্তারের ভয় পান, কারণ তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ আছে।'
কিন্তু এখন পরিস্থিতি মিছিল-সমাবেশের জন্য আরও কঠিন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নিরাপত্তা বাহিনীর চাদরে শহর ঢেকে ফেলা হয়েছে; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীমুক্ত জায়গা খুঁজে পাওয়াই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে সারা দেশে র্যাাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ৪২৫টি ইউনিট এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ২৩১টি প্লাটুন মোতায়েন রয়েছে।
এছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলোর বিক্ষোভ কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে দেশজুড়ে ২ লাখ ১৩ হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে বর্তমানের হরতালে এক দশক আগের হরতালের চিত্র পুরোই অনুপস্থিত।
আগে হরতালে পিকেটিং ছিল সাধারণ দৃশ্য, পিকেটারেরা হরতালের দিন রাস্তায় চলাচলকারী রিকশা উল্টে দিত। রাস্তায় গাড়ি বের করা যেত না, পুরো শহর একেবারেই নিশ্চল হয়ে যেত।
হরতাল বলতে আগে ছিল সব কিছু বন্ধ থাকবে, দোকানপাট, বিপণিবিতান, গাড়ি চলবে না।
কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন এবং নির্বাচনী তফসিল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের জোটের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার হরতালের দ্বিতীয় দিনেও সোমবার রাস্তায় গাড়ি চলাচল প্রায় স্বাভাবিকই ছিল।
যুবদল নেতা সাইফুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পুলিশ কাউকে ছাড়বে না।
'কারও বিরুদ্ধে মামলা থাক আর না থাক, তাকে ছাড়া হবে না। পুলিশের একমাত্র লক্ষ্যই হলো যেখানেই পাওয়া যাবেম বিএনপির কর্মীদের গ্রেপ্তার করা।'
তিনি আরও বলেন, 'পুলিশ আমাদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচিও করতে দেয় না। তারা আমাদের সঙ্গে মোস্ট ওয়ান্টেড অপরাধীর মতো আচরণ করছে। বিক্ষোভ করা বা মিছিল করার কোনো অধিকারই এখন আমাদের নেই।'