দেশে স্টারলিংকের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু, ২০টির বেশি প্রতিষ্ঠান যুক্ত

স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক করপোরেট গ্রাহকদের জন্য বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে। মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) প্রথমবারের মতো ব্যাংক খাতে ইস্টার্ন ব্যাংক এ সেবা গ্রহণ করেছে। এছাড়াও ইবনে সিনা গ্রুপ, চ্যানেল ২৪ ও অনন্ত গ্রুপসহ ২০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে স্টারলিংকের সেবা চালু করেছে।
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে স্থাপিত গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে এ সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এখানে মোট ৮০টি অ্যান্টেনা স্থাপন করা হবে, যা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টারলিংক গ্রাউন্ড স্টেশন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ উদ্যোগ শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোতেও সেবা বিস্তারের সক্ষমতা তৈরি করবে।
তবে করপোরেট প্যাকেজের উচ্চমূল্য অনেক প্রতিষ্ঠানকে সিদ্ধান্ত নিতে সতর্ক করছে। কেউ দ্রুত সেবা গ্রহণ করছে, আবার কেউ মূল্য ও সুবিধা যাচাইয়ের পর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
করপোরেট গ্রাহকরা সেবায় যুক্ত হচ্ছে
ফাইবার অ্যাট হোম লিমিটেডের চিফ মার্কেটিং অফিসার রাজীব আহমেদ সুলতান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ফেলিসিটি আইডিসি লিমিটেডের মাধ্যমে বাংলাদেশে করপোরেট গ্রাহকদের জন্য স্টারলিংক সেবা চালু করা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'ইস্টার্ন ব্যাংক সম্প্রতি তাদের কার্যক্রমে এ সেবা যুক্ত করেছে। ইবনে সিনা গ্রুপ, চ্যানেল ২৪ ও আনন্ত গ্রুপসহ ২০টিরও বেশি করপোরেট প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে সেবায় যুক্ত হয়ে ডিভাইস সক্রিয় করেছে।'
রাজীব আরও জানান, করপোরেট প্যাকেজের মূল্য সাধারণ ব্যবহারকারীর তুলনায় বেশি হলেও এতে আলাদা সুবিধা ও চারগুণ অগ্রাধিকার সেবা দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা নিয়মিত করপোরেট ক্লায়েন্টদের সঙ্গে বৈঠক করছি। অনেক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই সাইন আপ করেছে, আবার কেউ কেউ এখনো প্যাকেজের মূল্য ও উপযোগিতা পর্যালোচনা করছে।'
রিসেলার নেটওয়ার্ক বানাচ্ছে বিএসসিএল
অন্যদিকে, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) স্টারলিংক সেবার রিসেলার নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব ভাগাভাগির ভিত্তিতে দেশজুড়ে রিসেলার নিয়োগের জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে।
বিএসসিএলের জেনারেল ম্যানেজার (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) শাহ আহমেদুল কবির জানান, কয়েক কোটি টাকার হার্ডওয়্যার ক্রয়ের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমরা এখন করপোরেট পর্যায়ে স্টারলিংক প্যাকেজ বিক্রির জন্য প্রস্তুত। রিসেলার নিয়োগে ২৫টি আবেদন জমা পড়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে যোগ্য আবেদনকারীদের তালিকা স্টারলিংকে পাঠানো হবে। অনুমোদনপ্রাপ্তরাই কেবল রিসেলার হতে পারবে।'
তিনি আরও জানান, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাহকেরা এ সেবায় আগ্রহ দেখাচ্ছে।
রিসেলার হওয়ার যোগ্যতা মানদণ্ডে বলা হয়েছে—আবেদনকারীদের অবশ্যই লাইসেন্সপ্রাপ্ত আইএসপি, বৈধ বিবিটিভি লাইসেন্সধারী কেবল টিভি অপারেটর বা প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও গ্রাহকভিত্তিসম্পন্ন আইসিটি/ইলেকট্রনিকস কোম্পানি হতে হবে। পাশাপাশি ন্যূনতম ৩ কোটি টাকা আগাম জমা দিতে হবে, যা পরবর্তী ক্রয়ে সমন্বয় করা হবে।
প্রথম অনুমোদিত রিসেলার রবি আজিয়াটা
দেশের বেসরকারি অপারেটর রবি আজিয়াটা বাংলাদেশে স্টারলিংকের প্রথম অনুমোদিত পুনঃবিক্রেতা (রিসেলার) হিসেবে চুক্তি করেছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি করপোরেট গ্রাহক ও মোবিলিটি সেবার জন্য স্থানীয় অগ্রাধিকার এবং বৈশ্বিক অগ্রাধিকার—দুই ধরনের সেবা প্রদান করবে।
রবি জানিয়েছে, তারা করপোরেট বিক্রয় চ্যানেল ও খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে স্টারলিংক সেবা বিতরণ করবে। একই সঙ্গে গ্রামীণ অঞ্চলে 'কমিউনিটি শেয়ারিং ওয়াই-ফাই' চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে।
রবি অ্যাক্সিয়াটা পিএলসির প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শিহাব আহমেদ বলেন, 'এটি বাংলাদেশের ডিজিটাল বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে এক রূপান্তরমূলক পদক্ষেপ। প্রত্যন্ত অঞ্চলে উচ্চগতির স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পৌঁছে দিলে স্থানীয় জনগণ প্রয়োজনীয় ডিজিটাল সেবায় প্রবেশাধিকার পাবে। এতে অন্তর্ভুক্তি, উদ্ভাবন এবং টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।'
খুচরা সেবা ইতোমধ্যেই জনপ্রিয়
করপোরেট খাত যখন প্যাকেজ মূল্য বিবেচনা করছে, তখন খুচরা পর্যায়ে স্টারলিংকের সেবা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ফ্রিল্যান্সার, শিক্ষার্থী ও উদ্যোক্তাদের অনেকে বলছেন, প্রচলিত আইএসপির তুলনায় স্টারলিংকের সংযোগ অনেক বেশি স্থিতিশীল, এমনকি বৃষ্টি-ঝড়ের সময়ও।
খুচরা পর্যায়ে মাসিক দুই ধরনের প্যাকেজ আছে—উচ্চ অগ্রাধিকার প্ল্যান ৬ হাজার টাকা এবং লাইট প্ল্যান ৪ হাজার ২০০ টাকা। এ ছাড়া ডিশ, ট্রাইপড, রাউটার ও কেবলসহ স্ট্যান্ডার্ড কিট কিনতে হবে ৪৭ হাজার টাকায়।
কালিয়াকৈরের পাশাপাশি যশোর, কক্সবাজার ও ময়মনসিংহে নতুন গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে, যা কাভারেজ ও নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করবে।
পরিবর্তন আনবে নাকি সুবিধা সীমিত?
স্টারলিংকের আগমন বাংলাদেশের ইন্টারনেট বাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। এতদিন যে বাজার আইএসপি ও মোবাইল অপারেটরের দখলে ছিল, যাদের সেবার অনিয়মিত মান নিয়ে ব্যবহারকারীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে—সে ক্ষেত্রেই নতুন বিকল্প হিসেবে আসছে এই স্যাটেলাইট ইন্টারনেট। নিম্ন বিলম্ব ও উচ্চগতির সংযোগের কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট পাওয়া সম্ভব হবে, যা ফ্রিল্যান্সিং, দূরশিক্ষা ও ই-কমার্স খাতকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হতে পারে।
তবে খরচের দিকটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ পরিবারের জন্য মাসে ৪ হাজার ২০০ থেকে ৬ হাজার টাকা বিলের পাশাপাশি ৪৭ হাজার টাকার হার্ডওয়্যার খরচ বহন করা প্রায় অসম্ভব। ফলে দাম না কমা পর্যন্ত স্টারলিংকের ব্যবহার মূলত করপোরেট প্রতিষ্ঠান, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল গ্রাহক ও দুর্গম অঞ্চলের কিছু প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই সীমিত থাকবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।