মারা গেছেন জনপ্রিয় ফরাসি অভিনেত্রী ব্রিজিট বারডো
জনপ্রিয় ফরাসি অভিনেত্রী ও গায়িকা ব্রিজিট বারডো মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। একসময় তাকে বলা হতো আন্তর্জাতিক 'সেক্স সিম্বল'। পরে অবশ্য সিনেমা জগতকে বিদায় জানিয়ে প্রাণী অধিকার কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
রোববার বার্তা সংস্থা এএফপিকে পাঠানো এক বিবৃতিতে তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। 'ব্রিজিট বারডো ফাউন্ডেশন' তাদের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতির মৃত্যুর খবর জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, বিশ্বখ্যাত এই অভিনেত্রী ও গায়িকা তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার ছেড়ে প্রাণী কল্যাণে নিজের জীবন ও শক্তি উৎসর্গ করেছিলেন। তবে তার মৃত্যুর সময় বা স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।
সিনেমার জগতে উত্থান
১৯৫৬ সালে 'অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান' সিনেমার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পান বারডো। সিনেমাটি লিখেছিলেন ও পরিচালনা করেছিলেন তার তৎকালীন স্বামী রজার ভাদিম। পরবর্তী দুই দশক ধরে তিনি 'সেক্স কিটেন' বা আবেদনময়ী নারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে সত্তরের দশকের শুরুতে তিনি অভিনয় থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। এরপর তিনি রাজনীতিতে বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠেন। প্রাণী অধিকার নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি জাতিগত সংখ্যালঘু এবং ফ্রান্সের কট্টর ডানপন্থী 'ফ্রন্ট ন্যাশনাল'-এর পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তিনি সমালোচিত হন। জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে তার কয়েকবার সাজাও হয়েছিল।
১৯৩৪ সালে প্যারিসে জন্ম বারডোর। এক সমৃদ্ধ ও রক্ষণশীল ক্যাথলিক পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। তবে নাচে পারদর্শী হওয়ায় ব্যালে শেখার অনুমতি পান। জায়গা করে নেন বিখ্যাত 'কনজারভেতরি দে প্যারিস'-এ। একই সময়ে মডেল হিসেবেও কাজ শুরু করেন। ১৯৫০ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে 'এলে' পত্রিকার প্রচ্ছদে জায়গা পান তিনি।
মডেলিংয়ের সূত্র ধরেই সিনেমার প্রস্তাব পেতে থাকেন। এক অডিশনে ভাদিমের সঙ্গে তার দেখা হয়। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর ১৯৫২ সালে তারা বিয়ে করেন। ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তার যাত্রা শুরু হয়। ১৯৫৫ সালে যুক্তরাজ্যের হিট সিনেমা 'ডক্টর অ্যাট সি'-তে ডার্ক বোগার্ডের বিপরীতে অভিনয় করেন তিনি।
তবে ভাদিমের 'অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান' তাকে আন্তর্জাতিক আইকনে পরিণত করে। এই সিনেমায় তিনি সেন্ট-ট্রোপেজের এক বাধাহীন কিশোরীর চরিত্রে অভিনয় করেন। সিনেমাটি ফ্রান্সে তো বটেই, আন্তর্জাতিকভাবেও বিশাল হিট হয়। এটি বারডোকে ফরাসি পর্দার শীর্ষ সারির অভিনেত্রীদের কাতারে নিয়ে যায়।
প্রভাব ও পরবর্তী ক্যারিয়ার
সিনেমা দর্শকদের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের কাছেও অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন বারডো। তরুণ জন লেনন ও পল ম্যাককার্টনি এতটাই প্রভাবিত ছিলেন যে, তারা তাদের প্রেমিকাদের বারডোর মতো করে চুল রাঙাতে বলতেন। ১৯৫৮ সালে কলামিস্ট রেমন্ড কার্টিয়ার 'প্যারিস-ম্যাচ' পত্রিকায় তাকে নিয়ে দীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন। ১৯৫৯ সালে সিমোন দ্য বোভোয়ার তার বিখ্যাত প্রবন্ধ 'ব্রিজিট বারডো অ্যান্ড দ্য ললিতা সিনড্রোম' প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি বারডোকে ফ্রান্সের সবচেয়ে স্বাধীন নারী হিসেবে অভিহিত করেন। ১৯৬৯ সালে ফরাসি প্রজাতন্ত্রের প্রতীক 'মারিয়ান'-এর প্রথম বাস্তব মডেল হিসেবে তাকে বেছে নেওয়া হয়।
ষাটের দশকের শুরুতে তিনি বেশ কিছু আলোচিত ফরাসি সিনেমায় অভিনয় করেন। এর মধ্যে রয়েছে হেনরি-জর্জেস ক্লুজোতের অস্কার-মনোনীত ড্রামা 'দ্য ট্রুথ', লুই মালের 'ভেরি প্রাইভেট অ্যাফেয়ার' এবং জঁ-লুক গদারের 'কনটেম্পট'। দশকের শেষ ভাগে তিনি হলিউডের বেশ কিছু সিনেমায় কাজ করেন। জিন মরোর সঙ্গে কমেডি সিনেমা 'ভিভা মারিয়া!' এবং শন কনেরির সঙ্গে ওয়েস্টার্ন সিনেমা 'শালাকো' উল্লেখযোগ্য।
অভিনয়ের পাশাপাশি গানের জগতেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। সার্জ গেইনসবার্গের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক থাকাকালে তিনি বিখ্যাত গান 'জে তেম... মোয়া নন প্লাস'-এর মূল সংস্করণটি রেকর্ড করেছিলেন। তবে স্বামী গুন্টার সাচস জেনে যাওয়ার ভয়ে গানটি প্রকাশ না করতে গেইনসবার্গের প্রতি অনুরোধ জানান বারডো। পরে গেইনসবার্গ জেন বারকিনের সঙ্গে গানটি রেকর্ড করেন এবং তা ব্যাপক ব্যবসায়িক সাফল্য পায়।
তবে তারকাখ্যাতির চাপ বারডোর কাছে ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছিল। ১৯৯৬ সালে গার্ডিয়ানকে তিনি বলেছিলেন, 'আমার চারপাশের উন্মাদনা সবসময় অবাস্তব মনে হতো। তারকার জীবনযাপনের জন্য আমি আসলে প্রস্তুত ছিলাম না।' ১৯৭৩ সালে ৩৯ বছর বয়সে তিনি অভিনয় থেকে অবসর নেন। এরপর তিনি পুরোপুরি প্রাণী রক্ষায় মন দেন। ১৯৭৭ সালে সিল শিকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে যোগ দেন এবং ১৯৮৬ সালে 'ব্রিজিট বারডো ফাউন্ডেশন' প্রতিষ্ঠা করেন।
বিতর্ক ও ব্যক্তিগত জীবন
পরবর্তীতে তিনি রোমানিয়ায় কুকুর নিধন, ফ্যারো আইল্যান্ডে ডলফিন হত্যা এবং অস্ট্রেলিয়ায় বিড়াল জবাইয়ের মতো ইস্যুতে বিশ্বনেতাদের কাছে প্রতিবাদলিপি পাঠান। ধর্মীয় রীতিতে পশু জবাই নিয়েও তিনি নিয়মিত সোচ্চার ছিলেন। ২০০৩ সালে প্রকাশিত বই 'আ ক্রাই ইন দ্য সাইলেন্স'-এ তিনি ডানপন্থী রাজনীতির পক্ষে কথা বলেন। সেখানে সমকামী, স্কুলশিক্ষক এবং ফরাসি সমাজের তথাকথিত 'ইসলামীকরণের' বিরুদ্ধে লিখেন। এর ফলে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোর দায়ে তার সাজাও হয়।
ফ্রান্সের 'ফ্রন্ট ন্যাশনাল' (বর্তমানে ন্যাশনাল র্যালি) দলের দীর্ঘদিনের সমর্থক ছিলেন বারডো। গার্ডিয়ানকে তিনি বলেছিলেন, 'অভিবাসনের ভয়াবহ জোয়ারের বিষয়ে আমি পুরোপুরি [জঁ-মেরি ল পেন-এর] মতের সঙ্গে একমত।' ২০০৬ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস সারকোজিকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেন, ফ্রান্সের মুসলিম জনসংখ্যা 'তাদের কর্মকাণ্ড চাপিয়ে দিয়ে আমাদের দেশকে ধ্বংস করছে'।
ব্যক্তিগত জীবনে চারবার বিয়ে করেছিলেন বারডো। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত ভাদিমের সঙ্গে সংসার করেন। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ছিলেন জ্যাক চারিয়ারের সঙ্গে। তাদের নিকোলাস নামে এক ছেলে রয়েছে। এরপর ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ছিলেন সাচসের সঙ্গে। সবশেষে ১৯৯২ সালে ল পেনের সাবেক উপদেষ্টা বার্নার্ড ডি'অরমালেকে বিয়ে করেন। এ ছাড়া জঁ-লুই ট্রিনটিগন্যান্ট এবং গেইনসবার্গের সঙ্গেও তার আলোচিত প্রেমের সম্পর্ক ছিল।
