জাপানে ভূমিকম্পের পর ‘মেগাকুয়েক’ আতঙ্ক: আবারও আলোচনায় ‘দ্য বিগ ওয়ান’
সোমবার জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৭.৫ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানার পর কর্তৃপক্ষ আবারও ভবিষ্যতে একটি 'মেগাকুয়েক' বা মহাবিপর্যয়কারী ভূমিকম্পের আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। এর ফলে জাপানিদের মনে নতুন করে দানা বাঁধছে শতাব্দী-সেরা ভয়াবহ এক ভূমিকম্পের ভয়, যাকে বলা হচ্ছে 'দ্য বিগ ওয়ান'।
গত সেপ্টেম্বরে জাপানের ভূমিকম্প তদন্ত প্যানেল জানিয়েছিল, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে 'নানকাই ট্রফ' এলাকায় একটি মেগাকুয়েক হওয়ার সম্ভাবনা ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ। নানকাই হলো জাপানের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল বরাবর একটি অতি ভূমিকম্পপ্রবণ ফাটলরেখা।
এর আগে গত এপ্রিলে কর্তৃপক্ষ সতর্ক করে বলেছিল, এই মেগাকুয়েক ২০ মিটারের (৬৬ ফুট) চেয়েও উঁচু সুনামি তৈরি করতে পারে, যা টোকিওসহ অন্যান্য অঞ্চলে আঘাত হানবে। তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এতে প্রায় ৩ লাখ মানুষের প্রাণহানি এবং ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
সোমবারের ভূমিকম্পের পর, উত্তরের হোক্কাইডো থেকে মধ্য জাপানের চিবা পর্যন্ত সাতটি জেলার বাসিন্দাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলেছেন কর্মকর্তারা। এই বিশাল এলাকায় কয়েক কোটি মানুষের বসবাস।
একজন সরকারি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওই অঞ্চলে '৮ বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার আরেকটি বড় ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।'
কর্তৃপক্ষ মানুষকে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার পথ দেখে রাখতে, আসবাবপত্র সুরক্ষিত করতে এবং খাবার, পানি ও পোর্টেবল টয়লেটের মতো জরুরি সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখতে বলেছে। তবে এখনই কাউকে এলাকা ছাড়ার বা ইভাকুয়েশনের নির্দেশ দেওয়া হয়নি।
এক সংবাদ সম্মেলনে জাপানের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, বৈশ্বিক ভূমিকম্পের ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বড় কম্পনের 'সম্ভাবনা' রয়েছে, তবে এটি নিশ্চিত কোনো 'পূর্বাভাস' নয়। কর্মকর্তাদের মতে, বড় ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা এখন ১০০ ভাগের মধ্যে এক ভাগ।
মেগাকুয়েক আসলে কী?
'রিং অব ফায়ার'-এ অবস্থিত জাপানে বছরে প্রায় দেড় হাজার ভূমিকম্প হয়। এর বেশিরভাগই মৃদু। তবে কিছু ভূমিকম্প ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। যেমন—২০১১ সালের ৯ মাত্রার ভূমিকম্প ও সুনামিতে দেশটির উত্তর-পূর্ব উপকূলে ১৮ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল।
কিন্তু কর্তৃপক্ষের ভয়, ঘনবসতিপূর্ণ দক্ষিণাঞ্চলে যদি মেগাকুয়েক আঘাত হানে, তবে তা ২০১১ সালের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। 'নানকাই ট্রফ' বরাবর ভূমিকম্পে অতীতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ১৭০৭ সালে এই ফাটলরেখার পুরো ৬০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কম্পনের ফলে জাপানের ইতিহাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভূমিকম্প হয়েছিল, যার পরপরই মাউন্ট ফুজিতে অগ্নুৎপাত শুরু হয়।
সাধারণত প্রতি ১০০ বছর পর পর এমন 'মেগাস্রাস্ট' বা অতি শক্তিশালী ভূমিকম্প জোড়ায় জোড়ায় আঘাত হানে। সর্বশেষ ১৯৪৪ ও ১৯৪৬ সালে এমনটি ঘটেছিল। ভূতাত্ত্বিক কাইল ব্র্যাডলি এবং জুডিথ এ হুবার্ডের মতে, এটিই মূলত 'দ্য বিগ ওয়ান'-এর প্রকৃত সংজ্ঞা। গত বছর তাদের 'আর্থকোয়েক ইনসাইটস' নিউজলেটার তারা উল্লেখ করেন, 'নানকাইয়ের বড় ভূমিকম্পের ইতিহাস বিশ্বাসযোগ্যভাবেই ভীতিজনক।'
ভূমিকম্প কি আসলেই আগে থেকে বলা সম্ভব?
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিসমোলজির ইমেরিটাস অধ্যাপক রবার্ট গেলার মনে করেন, ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়। গত বছর ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্পের পর যখন কর্তৃপক্ষ মেগাকুয়েকের সতর্কতা জারি করেছিল, তখন তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, এই সতর্কবার্তাগুলোর সঙ্গে 'বিজ্ঞানের সম্পর্ক নেই বললেই চলে'।
তার মতে, ভূমিকম্প যে 'গুচ্ছাকারে' ঘটে তা জানা থাকলেও, কোনটি 'ফোরশক' (মূল ভূমিকম্পের আগের কম্পন) আর কোনটি 'আফটারশক', তা আগে থেকে বলা অসম্ভব। ব্র্যাডলি ও হুবার্ডের মতে, মাত্র ৫ শতাংশ ভূমিকম্পই মূলত 'ফোরশক' হিসেবে চিহ্নিত হয়। তবে ২০১১ সালের বড় ভূমিকম্পের আগে ৭.২ মাত্রার একটি কম্পন হয়েছিল, যা তখন উপেক্ষা করা হয়েছিল।
২০১১ সালের বিপর্যয়ের পর বড় ক্ষতি এড়াতে জাপানে এই সতর্কবার্তা পদ্ধতি চালু করা হয়। ২০২৪ সালের আগস্টে জাপান মেটিওরোলজিক্যাল এজেন্সি (জেএমএ) প্রথমবারের মতো এটি ব্যবহার করে। জেএমএ বলছে, 'বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, তবে এর মানে এই নয় যে বড় ভূমিকম্প নিশ্চিতভাবেই ঘটবে।'
