জাপানে শ্রমবাজারের দুয়ার খুলছে, জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ
বিশ্বের অন্যতম প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজার জাপানে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে সরকারের জোর প্রচেষ্টার ফলে চলতি বছর দেশটিতে বাংলাদেশি কর্মী যাওয়ার হার প্রায় তিন গুণ বেড়েছে।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২০ নভেম্বর অর্থ বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে জানিয়েছে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত মোট প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি কর্মভিসা অথবা ভাষা শিক্ষার কোর্সে ভর্তি হয়ে জাপানে গেছেন—যারা এক বছরের মধ্যেই সেখানকার কর্মসংস্থানের যোগ্যতা অর্জন করেন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে জাপানে যাওয়া বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ হাজার ৫৭৪ জন। এর আগের দুই বছরে এই সংখ্যা ছিল ৫ হাজারের ঘরে। মন্ত্রণালয় আশা করছে, আগামী বছর কর্মী নিয়োগের এই হার আরও বাড়বে।
সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. মো. নিয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়ার সাম্প্রতিক জাপান সফরের পর দেশটির নিয়োগকারীদের সঙ্গে ৪০টি নতুন চুক্তি সই হয়েছে। ক্রমবর্ধমান এই চাহিদা সামাল দিতে জরুরি প্রশাসনিক সহায়তা চেয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
মূলত গত মে মাসে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের টোকিও সফরের পর থেকেই জাপানের শ্রমবাজারে এই গতি সঞ্চারিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার ওই সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে শ্রম অভিবাসনকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে দুটি বড় সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়, যেখানে আগামী পাঁচ বছরে ১ লাখ কর্মী পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
এদিকে, জাপানি ভাষা দক্ষতা পরীক্ষায় অংশ নিতে চলতি ডিসেম্বরে ১৩ হাজারের বেশি বাংলাদেশি নিবন্ধন করেছেন। মন্ত্রণালয় ২০২৬ সালের মাঝামাঝি নাগাদ পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা করেছে।
মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, ভাষা শিক্ষা কোর্সে ভর্তির হার দ্রুত বেড়েছে, যা সম্ভাব্য অভিবাসীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ এবং প্রস্তুতির মান বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরে। জাপান বাংলাদেশের এই প্রস্তুতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। প্রস্তুতির বিষয়টি সন্তোষজনক হলে বা সক্ষমতা প্রমাণ করতে পারলে আগামী বছর থেকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কর্মী নিয়োগ দ্রুত বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাপান সেলের প্রধান মো. শহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'সমঝোতা স্মারকগুলোতে (এমওইউ) নির্দিষ্ট কর্মী সংখ্যার উল্লেখ না থাকলেও এটি কর্মী নিয়োগের পথ প্রশস্ত করেছে।'
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি জানান, শিক্ষার্থী হিসেবে যারা যাচ্ছেন, তাদের অনেকেই মূলত চাকরিপ্রত্যাশী। তারা এক বছরের ভাষা কোর্স শেষ করে কাজে যোগ দেন; যে কারণে তাদেরও কর্মসংস্থানের হিসাবের মধ্যে ধরা হচ্ছে।
জাইকার সহায়তা চাইছে বিএমইটি
জাপানের জন্য বিশেষভাবে দক্ষ কর্মী তৈরি করতে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব জাইকার সহায়তায় বাস্তবায়নের জন্য জমা দিয়েছে ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিএমইটি)।
বিএমইটির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে জানান, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ইতোমধ্যে জাইকার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে এবং প্রস্তাবটি পর্যালোচনাধীন রয়েছে।
মন্ত্রণালয়ে জাপান সেল, মিশনে জনবল বৃদ্ধি
বিস্তৃত শ্রমবাজারের চাহিদা সামাল দিতে মন্ত্রণালয়ে একটি আলাদা জাপান সেল গঠন করেছে সরকার। পাশাপাশি টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইংয়েও জনবল শক্তিশালী করা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকীর মাধ্যমে এই উদ্যোগটি তদারক করা হচ্ছে—জাপানের শ্রমবাজার সম্প্রসারণের এ বিশেষ দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি।
তবে সাম্প্রতিক অগ্রগতির পরও জাপানের শ্রমবাজারে প্রবেশে সবচেয়ে বড় বাধা রয়ে গেছে দক্ষ কর্মীর ঘাটতি। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দক্ষ জনশক্তির পরিধি বাড়াতে তারা কাজ করছেন, কিন্তু অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে—এ ক্ষেত্রে আরও দ্রুত ও কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।
ভাষার দুর্বলতা পিছিয়ে দিচ্ছে
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষ কর্মীর ঘাটতাই মূল কারণ, যার কারণে বাংলাদেশ এখনও প্রতিযোগীদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। গত বছর জাপানে কর্মী পাঠিয়েছে নেপাল ৫৬,৭০৭ জন, যেখানে বাংলাদেশ পাঠিয়েছে মাত্র ৩,৫৭৪—প্রায় ১৬ গুণ কম। এই ব্যবধান আগের দুই বছরেও ছিল একই রকম; ২০২২ ও ২০২৩ সালে নেপাল পাঠায় যথাক্রমে ৪২ হাজারের বেশি ও ৩৬ হাজারের বেশি কর্মী, আর বাংলাদেশ পাঠায় বছরে মাত্র ৫ হাজারের কিছু বেশি।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাপানে যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য ১,৪০৬টি ক্লিয়ারেন্স কার্ড দেওয়া হয়েছে। এগুলো মূলত কৃষি (৯৭), ইঞ্জিনিয়ারিং (৮৬), স্ক্যাফোল্ডিং (৫৪), কেয়ারগিভিং (৫২), মেটাল পেইন্টিং (৪১), স্কিল্ড ওয়ার্ক (৪০), সেলাই (৩৭) ও সাধারণ শ্রমিক (৩৪) খাতে।
বিএমইটির সাবেক প্রশিক্ষণ পরিচালক ও বর্তমানে আইএলও পরামর্শক নূরুল ইসলাম বলেন, 'স্পেসিফায়েড স্কিল্ড ওয়ার্কার্স (এসএসডব্লিউ) কর্মসূচির আওতায় কেয়ারগিভার ও নির্মাণশ্রমিকের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। উভয় ক্ষেত্রেই এন৪-লেভেলের জাপানি ভাষা সার্টিফিকেট প্রয়োজন।'
তিনি বলেন, নেপাল ভাষা প্রশিক্ষণে এগিয়ে কারণ এন৪ প্রস্তুতির জন্য নেটিভ [স্থানীয়] প্রশিক্ষক লাগে, যা বাংলাদেশে পর্যাপ্ত নেই। 'ভাষাজ্ঞানের দুর্বলতার কারণে কেয়ারগিভার চাকরিতে যাওয়া অনেক বাংলাদেশি সমস্যায় পড়েছিলেন, পরে চাকরি বদলাতেও বাধ্য হন,' বলেন তিনি।
জাপানি ভাষাজ্ঞানের পাঁচটি স্তর আছে—এন৫ সবচেয়ে সহজ, এন১ সবচেয়ে উচ্চতর। জাপানের দক্ষ কর্মী নিয়োগে সাধারণত এন৪ কিংবা তার ওপরে দক্ষতা প্রয়োজন হয়, জানায় জাপানিজ-ল্যাঙ্গুয়েজ প্রফিসিয়েন্সি টেস্ট (জেএলপিটি) কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, জুন মাসের এক সেমিনারে প্রবাসী উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, জাপানি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশে টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) পরিচালনা উৎসাহিত করছে সরকার। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, মনোহরদী টিটিসি জাপানি অংশীদারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে, যাতে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ উন্নয়ন করা যায়।
তিনি আরও বলেন, জাপান এবং সৌদি আরবের অভিবাসন ব্যয় প্রায় সমান—প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা। জাপানে উচ্চ বেতন থাকা সত্ত্বেও বিশেষ কোনো দক্ষতার প্রয়োজন না হওয়ায় অনেক বাংলাদেশি কর্মী মধ্যপ্রাচ্যকেই বেছে নেন।
তবে, সরকারিভাবে জাপানগামী কর্মীদের জন্য মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় ১ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, 'এই হার সংশোধন করা প্রয়োজন। কারণ এটি বর্তমান ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং এটি বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা উচিত।'
যাওয়ার পথসমূহ
বর্তমানে চারটি উপায়ে বাংলাদেশিরা জাপানে অভিবাসনের সুযোগ পাচ্ছেন—স্পেসিফায়েড স্কিল্ড ওয়ার্কার্স (এসএসডব্লিউ), টেকনিক্যাল ইন্টার্ন ট্রেনিং প্রোগ্রাম (টিআইটিপি), প্রকৌশলসহ সাদা-কালার চাকরি এবং শিক্ষার্থী ভিসা।
এসএসডব্লিউ কর্মসূচির আওতায় নার্সিং কেয়ার, শিল্প উৎপাদন, অটোমোবাইল মেরামত, ড্রাইভিং, জাহাজ নির্মাণ, কৃষিসহ মোট ১৬টি খাতে কর্মী নেওয়া হয়।
সিনিয়র সচিব নিয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়া তালিকাটি আরও সম্প্রসারণের প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি খাদ্য ও পানীয় উৎপাদন, ফুড সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি এবং বনসংরক্ষণ খাতকে যুক্ত করার সুপারিশ করেছেন।
মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরে জাপানে ১ লাখ ৩৫ হাজার নার্সিং কেয়ার কর্মী, ১ লাখ ৭৩ হাজার শিল্প উৎপাদন খাতের কর্মী, ২৪ হাজার ৫০০ চালক, ৭৮ হাজার কৃষিশ্রমিক এবং ৩৬ হাজার জাহাজ নির্মাণখাতের কর্মীর প্রয়োজন হবে।
বর্তমানে বিএমইটি অনুমোদিত প্রায় ৯৬টি এজেন্সি জাপানে কর্মী পাঠানোর অনুমোদনপ্রাপ্ত।
জাপানি শ্রমবাজার নিয়ে কাজ করা শীর্ষস্থানীয় এজেন্সি সাদিয়াটেকের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'প্রধান উপদেষ্টার সফরের পর থেকে আমরা সরকার এবং জাপান—উভয় পক্ষের কাছ থেকেই জোরালো সমর্থন পাচ্ছি। আমাদের কর্মীদের জন্য বাজারটি ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে।'
