দক্ষিণ এশিয়ায় পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ যখন সংঘাতের ক্ষেত্র: হিমালয়ের উৎস থেকে রাজনীতি
দক্ষিণ এশিয়ার নদীগুলোকে নিয়ে রাজনীতি কখনোই শান্ত ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তা যেন আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। অক্টোবরের শেষ দিকে আফগানিস্তান ঘোষণা দেয়—তারা কাবুল নদীতে একাধিক বাঁধ নির্মাণ করবে। এই পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ পাকিস্তান, যার সঙ্গে সীমান্তে তখনও সংঘর্ষ চলছিল তালেবানের। একই মাসে, হাজার হাজার বাংলাদেশি প্রতিবাদ জানায় ভারতের বাঁধ নিয়ে, বিশেষ করে তিস্তা নদীর প্রবাহকে নয়াদিল্লির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত সিন্ধু নদী চুক্তি ভারত এপ্রিল মাসে স্থগিত করেছে, কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর। আর চীনের পরিকল্পনা ভারতের নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন ব্রহ্মপুত্র (তিব্বতে যার নাম ইয়ারলুং সাংপো) নদীর ভারত সীমান্ত থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার উজানে এক বিশাল বাঁধ নির্মাণ করতে যাচ্ছে। প্রায় ১৬৭ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পটি শেষ হলে হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাঁধ—এর প্রভাব যেমন হবে প্রতিবেশী দেশগুলোর পানিপ্রবাহে, তেমনি বিপর্যয় ঘটাতে পারে সমগ্র অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যে।
জলনীতি এখন শক্তির রাজনীতি
দক্ষিণ এশিয়ার নদীগুলোর এই নতুন অস্থিরতা কেবল পরিবেশ নয়, এখন তা পরিণত হয়েছে কৌশলগত শক্তির প্রদর্শনে। ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা এবং "সবুজ জ্বালানি"র চাপ দেশগুলোকে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে আরও বিনিয়োগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ একই সময়ে, জলবায়ু পরিবর্তনে হিমবাহ গলছে দ্রুত, বর্ষা অনিশ্চিত, নদীর প্রবাহও অস্থির—যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে প্রায় ২০০ কোটিরও বেশি দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের জীবিকায়।
এমন সময়ে প্রয়োজন প্রতিবেশীদের মধ্যে সহযোগিতা ও আস্থা, কিন্তু বাস্তবে ঘটছে সম্পূর্ণ বিপরীত।
হিমালয়ের বুকে রাজনীতির ছায়া
দক্ষিণ এশিয়ার তিন বৃহৎ নদী—সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র—সবই উৎসারিত হিমালয়ের হিমবাহ থেকে। সিন্ধু নদ চীনের তিব্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের লাদাখ ও বিতর্কিত কাশ্মীর অতিক্রম করে পাকিস্তানে প্রবেশ করে, শেষপর্যন্ত আরব সাগরে মিশেছে। ব্রহ্মপুত্রও চীনের তিব্বত থেকে শুরু হয়ে ভারত ও বাংলাদেশে প্রবাহিত। আবার নেপালের বিস্তৃত অংশও গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ভেতরে পড়ে।
এ অঞ্চলে পানির ভাগাভাগি সবসময়ই জটিল, কারণ সীমান্ত রাজনীতিতে আস্থার ঘাটতি চরম। ভারত-পাকিস্তান কাশ্মীর নিয়ে বিরোধে জড়িত; চীন-ভারত সীমান্ত নিয়ে উত্তপ্ত; আর বাংলাদেশ ও নেপালের আশঙ্কা—তাদের নদীর ভাগ্য নির্ভর করছে দিল্লি বা বেইজিংয়ের সদিচ্ছার ওপর।
২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় পানিবন্টন সংক্রান্ত বিরোধের সংখ্যা ছিল অন্তত ১৯১টি—প্যাসিফিক ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী। মধ্যপ্রাচ্য বাদে পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চল এতটা 'পানিসংকট-কেন্দ্রিক উত্তেজনা'-য় ভুগছে না।
পানি সংকট ও শক্তির চাহিদা: দ্বিমুখী চাপ
বিশ্বের সবচেয়ে জলসংকটপূর্ণ অঞ্চলগুলোর একটি এখন দক্ষিণ এশিয়া। চীনের লুডং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে—যেসব অঞ্চলে পানির অভাব প্রকট, সেখানেই সংঘাতের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
একইসঙ্গে, জ্বালানির চাহিদা অভাবনীয়ভাবে বেড়েছে। শিল্পায়ন, নগরায়ন ও ডেটা সেন্টারের বিস্তারে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রয়োজন। সৌর ও বায়ুশক্তির অনিয়মিত উৎপাদনের তুলনায় জলবিদ্যুৎকে এখন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য "সবুজ শক্তি" হিসেবে দেখা হচ্ছে।
পাকিস্তান ইতিমধ্যে তার এক-পঞ্চমাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জলবিদ্যুৎ থেকে এবং এই অনুপাত আরও বাড়াতে চায়। ভারতও ২০৩২ সালের মধ্যে তাদের বিদ্যমান ৪২ গিগাওয়াট ক্ষমতা ৫০ শতাংশের বেশি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে—পরবর্তী কয়েক দশকে ২০০টি নতুন বাঁধ নির্মাণের সম্ভাবনা রয়েছে। নেপাল ইতিমধ্যেই নিজের ব্যবহারের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে এবং সেই অতিরিক্ত শক্তি ভারত ও সম্প্রতি বাংলাদেশেও বিক্রি শুরু করেছে—ভারতীয় গ্রিড ব্যবহার করে।
চুক্তিহীন বাঁধই সবচেয়ে বিপজ্জনক
যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির জলনীতি বিশেষজ্ঞ অ্যারন উলফের মতে, কোনো নদীতে উজানে অবস্থিত দেশের ভাটির দেশের সঙ্গে চুক্তি ছাড়াই বাঁধ নির্মাণই জলসংঘাতের সবচেয়ে বড় পূর্বাভাস। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবেশগত বিধ্বংসী প্রভাব—বাঁধ ভাটি অঞ্চলে নদীর গতিপথ ভাঙে, বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করে। হিমালয়ের নরম ভৌগোলিক গঠনে এসব ক্ষতি আরও গভীর। এ কারণেই ভারতের প্রস্তাবিত মেগা ড্যাম প্রকল্পের বিরুদ্ধে স্থানীয় সম্প্রদায় ইতিমধ্যে বিক্ষোভ শুরু করেছে।
গলতে থাকা হিমবাহ, গলতে থাকা আস্থা
দক্ষিণ এশিয়ার পরিবেশ এখন সবচেয়ে নাজুক অবস্থায়। হিমবাহ দ্রুত গলছে, নদীর প্রবাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে, পাহাড়ি ভূমি অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে, আর বন্যার ঝুঁকি বেড়েছে বহুগুণে। বর্ষার ধরণও বদলে যাচ্ছে—অনেক বেশি অপ্রত্যাশিত ও অসময়ে আসছে বৃষ্টি।
এই বাস্তবতায় পানিচুক্তি স্থগিত নয়, বরং আরও শক্তিশালী ও সময়োপযোগী করা প্রয়োজন—যাতে সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের নতুন বাস্তবতার প্রতিফলন থাকে।
সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ভঙ্গুর পরিবেশ এখন কূটনৈতিক তৎপরতার প্রয়োজনীয়তাকে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও জোরালো করে তুলেছে।
তবু কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিতও মিলছে। এপ্রিলে সিন্ধু চুক্তি স্থগিত রাখলেও ভারত এখনো পাকিস্তানের সঙ্গে বন্যা-সংক্রান্ত পূর্বাভাস শেয়ার করছে—যা ইঙ্গিত দেয়, পানিসম্পর্কিত সহযোগিতার সম্পূর্ণ অবসান ঘটেনি। ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক অ্যারন উলফের গবেষণায় দেখা যায়, গত এক শতকে পানি নিয়ে বিরোধ সরাসরি কোনো যুদ্ধের কারণ হয়নি। তবে পরোক্ষভাবে ভূমিকা অবশ্যই রেখেছে।
তবে অঞ্চলটির নদীর পানি ব্যবস্থাপনা এখনো এক বিশৃঙ্খল দ্বিপাক্ষিক চুক্তির জালে আটকে আছে, যেখানে দেশগুলো নদীকে একটি যৌথ প্রতিবেশব্যবস্থার পরিবর্তে দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। অথচ, আরও ঘনিষ্ঠ আঞ্চলিক সহযোগিতাই পারে নদীর স্রোত সচল রাখতে—এবং দক্ষিণ এশিয়ার নাজুক শান্তিকে টিকিয়ে রাখতে।
