গাজায় ইসরায়েলের তীব্র বিমান হামলা, নিহত ১০৪: হামাসের বিরুদ্ধে সেনা হত্যার অভিযোগ
 
গাজা উপত্যকায় গত মঙ্গলবার রাতে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের হামলায় কমপক্ষে ১০৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। খবর বিবিসির
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, তারা মার্কিন-মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘনের জবাবে "ডজন ডজন সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তু ও যোদ্ধার" ওপর হামলা চালিয়েছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অভিযোগ করেন, হামাস গাজায় একজন ইসরায়েলি সৈন্যকে হত্যা করেছে এবং নিহত জিম্মিদের মরদেহ ফেরতের শর্ত ভঙ্গ করেছে। তবে হামাস দাবি করে, এ ঘটনার সঙ্গে তাদের "কোনো সম্পৃক্ততা নেই" এবং তারা এখনো যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে অটল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, যুদ্ধবিরতি কোনোভাবেই "ঝুঁকির মুখে পড়বে না", তবে ইসরায়েলের ওপর হামলা হলে তারা "প্রতিশোধ নিতে পারে"।
ইসরায়েলি বিমান হামলা গাজা সিটি ও উত্তরের বেইত লাহিয়া, মধ্যাঞ্চলের বুরেইজ ও নুসেইরাত এবং দক্ষিণের খান ইউনুস এলাকায় বাড়ি, স্কুল ও আবাসিক ভবনগুলোতে আঘাত হানে।
গাজার প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, হামলা চলাকালে শহরের বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় "আগুন ও ধোঁয়ার স্তম্ভ" দেখা যায় এবং একের পর এক বিস্ফোরণে গোটা এলাকা কেঁপে ওঠে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে ৪৬ শিশু ও ২০ নারী রয়েছে, আহত হয়েছে আরও ২৫০ জনের বেশি।
হামাস সরকারের সিভিল ডিফেন্স সংস্থা জানায়, দক্ষিণ গাজার সাবরা পাড়ায় আল-বান্না পরিবারের বাড়ির ধ্বংসস্তূপ থেকে তিন নারী ও এক পুরুষের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বুরেইজ শরণার্থী শিবিরের ব্লক ৭-এ আবু শারার পরিবারে পাঁচ সদস্য এক হামলায় নিহত হন। এছাড়া খান ইউনুসের উত্তর-পশ্চিমের এক সড়কে বিমান হামলায় আরও পাঁচজন নিহত হন।
আজ বুধবার সকালে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) জানায়, তারা "যুদ্ধবিরতির পুনঃপ্রয়োগ শুরু করেছে", এবং এর অংশ হিসেবে "ডজন ডজন সন্ত্রাসী ও কমান্ডারকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে"।
আইডিএফ জানায়, তারা যুদ্ধবিরতি মেনে চলবে, তবে "যেকোনো লঙ্ঘনের কঠোর জবাব" দেবে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে মঙ্গলবার রাতে জানানো হয়, তিনি সেনাবাহিনীকে "প্রবল পাল্টা হামলা" চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন, যদিও কারণ নির্দিষ্ট করা হয়নি।
তবে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেন, হামাস "একটি স্পষ্ট লাল রেখা অতিক্রম করেছে", এবং সৈন্যদের ওপর হামলার জন্য "বহুগুণ বেশি মূল্য দিতে হবে"।
বুধবার সকালে আইডিএফ জানায়, তাদের এক রিজার্ভ সৈন্য মাস্টার সার্জেন্ট ইয়োনা ইফরাইম ফেল্ডবাউম নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের সামরিক সূত্র জানায়, হামলাটি গাজার দক্ষিণে রাফাহ শহরের ইসরায়েল-নিয়ন্ত্রিত অংশে সংঘটিত হয়, যেখানে যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী আইডিএফ টহল পরিচালনা করে।
সূত্র মতে, আইডিএফের একটি প্রকৌশল দল ভূগর্ভস্থ টানেল ধ্বংসের কাজ করছিল, তখন তাদের একটি যানবাহন "সন্ত্রাসীদের গোলায়" আঘাতপ্রাপ্ত হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই এলাকায় আরও একটি সাঁজোয়া যানকে লক্ষ্য করে অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়, যদিও তাতে কেউ আহত হয়নি।
হামাস এক বিবৃতিতে ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে, এবং ইসরায়েলি হামলাকে "যুদ্ধবিরতি চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন" বলে অভিহিত করে।
হামাস জানায়, "রাফাহ-তে গোলাগুলির ঘটনায় আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমরা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।"
হামাসের সামরিক শাখা জানায়, ইসরায়েলি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে তারা এক জিম্মির মরদেহ ফেরত দেওয়া স্থগিত করেছে, কারণ ইসরায়েল "চুক্তি লঙ্ঘন করেছে"।
এমন মারাত্মক রক্তক্ষয়ের পরও অবশ্য ট্রাম্প প্রশাসন পুরো ঘটনায় ফের পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ পুনরায় শুরু হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়।
এশিয়া সফরকালে নিজস্ব বিমান এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, "আমার জানা মতে, তারা একজন ইসরায়েলি সৈন্যকে হত্যা করেছে। তাই ইসরায়েলিরা প্রতিশোধ নিয়েছে — এবং তাদের তা নিতেই হবে।"
তিনি যোগ করেন, "কোনোকিছুই যুদ্ধবিরতিকে বিপন্ন করবে না। হামাস মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির খুবই ক্ষুদ্র অংশ, আর তাদের আচরণ করতে শিখতে হবে।"
 
মঙ্গলবার বিকেলে নেতানিয়াহু ঘোষণা করেন, হামাসের বিরুদ্ধে "প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ" নেওয়া হবে, কারণ আগের দিন তারা যে মরদেহ ফেরত দেয়, তা বাকি থাকা ১৩ জিম্মির কারও নয়।
ইসরায়েল জানায়, ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা গেছে সেই দেহাংশ ২০২৩ সালের শেষ দিকে গাজায় নিহত ওফির জারফাতির, যার মরদেহ আগেই উদ্ধার করা হয়েছিল। এটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির "স্পষ্ট লঙ্ঘন"।
আইডিএফ এক ভিডিও প্রকাশ করে জানায়, ফুটেজে দেখা যায় হামাস যোদ্ধারা পূর্ব গাজায় এক স্থাপনা থেকে মরদেহের অংশ সরিয়ে কাছেই কবর দেয় এবং পরে রেড ক্রসকে ডেকে 'জিম্মির মরদেহ আবিষ্কারের ভান' করে।
হামাস এ অভিযোগকে "ভিত্তিহীন" বলে প্রত্যাখ্যান করে এবং ইসরায়েলকে "নতুন আগ্রাসনের অজুহাত তৈরি করার চেষ্টা"র অভিযোগ তোলে।
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি) পরে জানায়, তারা ঘটনাস্থলে গিয়েছিল "হামাসের অনুরোধে" এবং "সৎ বিশ্বাসে", তবে ভিডিও ফুটেজ অনুযায়ী তারা জানত না যে মরদেহ আগেই সেখানে রাখা হয়েছিল।
আইসিআরসির বিবৃতিতে বলা হয়, "আমাদের কাজ মৃতদেহ উত্তোলন নয়; আমরা শুধু ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে যা ঘটেছে তা পর্যবেক্ষণ করেছি। এটি দুঃখজনক যে এমন 'ভুয়া উদ্ধার' মঞ্চস্থ হয়েছে — যখন এই চুক্তির প্রতি বিশ্বাসই এখন সবচেয়ে প্রয়োজনীয়।"
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় সম্পাদিত যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি ট্রাম্পের ২০ দফা গাজা শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ।
চুক্তি অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হামাসকে ৪৮ জন জীবিত ও মৃত জিম্মি ফেরত দিতে হবে।
গত ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ১৩ অক্টোবর হামাস ২০ জীবিত ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেয়, বিনিময়ে ২৫০ ফিলিস্তিনি বন্দি ও গাজা থেকে আটক ১,৭১৮ জনকে মুক্তি দেয় ইসরায়েল।
ইতিমধ্যে ইসরায়েল ১৩ ইসরায়েলি ও ২ বিদেশি জিম্মির মরদেহের বিনিময়ে ১৯৫ ফিলিস্তিনির দেহ ফেরত দিয়েছে। এখনও গাজায় থাকা ১৩ জন মৃত জিম্মির মধ্যে ১১ জন ইসরায়েলি, একজন তানজানিয়ান ও একজন থাই নাগরিক।
হামাসের প্রধান আলোচক খালিল আল-হাইয়া শনিবার বলেন, ইসরায়েলি হামলায় "গাজার ভূচিত্র বদলে গেছে" এবং কিছু ব্যক্তি যারা মরদেহ কবর দিয়েছিল, তারা নিহতের দাফনস্থল ভুলে গেছে।
তবে ইসরায়েলি সরকার দাবি করেছে, হামাস সব মৃতদেহের অবস্থান জানে।
চুক্তি অনুযায়ী, হামাস নির্ধারিত সময়ে সব মরদেহ ফেরত দিতে না পারলেও, ট্রাম্প শনিবার সতর্ক করে বলেন, "অবশিষ্ট দেহগুলো দ্রুত হস্তান্তর করতে হবে, না হলে অন্য অংশগ্রহণকারী দেশগুলো পদক্ষেপ নেবে।"
হামাসের কাছে এখনও যেসব ইসরায়েলির মরদেহ রয়েছে, এদের মধ্যে একজন বাদে সবাই ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলার সময় অপহৃত ২৫১ জনের দেহাবশেষ। সেই হামলায় প্রায় ১,২০০ ইসরায়েলি নিহত হয়। যদিও এরমধ্যে ইসরায়েলি পাল্টা হামলায় নিহত ইসরায়েলি নাগরিকরাও রয়েছে।
এরপর ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে, যেখানে এখন পর্যন্ত ৬৮,৬০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায় — এর মধ্যে যুদ্ধবিরতির পর থেকে ২০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।

 
             
 
 
 
 
