খারাপ তালেবান এখন ভালো তালেবান! ভারতের নতুন চেহারা ও তালেবান প্রেম

১০ অক্টোবর নয়াদিল্লির ঐতিহ্যবাহী হায়দরাবাদ হাউসের প্রবেশদ্বারে যখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি একে অপরের সঙ্গে করমর্দন করেন, সেই দৃশ্যে নিহিত ছিল এক গভীর পরিহাস।
কারণ, এ ঘটনা দেখিয়ে দেয়—ভারত কতদূর পথ পাড়ি দিয়েছে সেই সময় থেকে, যখন মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট সরকার তালেবানকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, "ভালো তালেবান" ও "খারাপ তালেবান"-এর মধ্যে পার্থক্য করার মার্কিন ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছিল, এবং কট্টরপন্থী পুরো গোষ্ঠীটিকে "সন্ত্রাসী সংগঠন" হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল।
২০১০ সালে, যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক বাহিনী যখন বুঝতে পারে যে আফগানিস্তানে তাদের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান ব্যর্থ, এবং খোদ আমেরিকায় যুদ্ধবিরোধী জনমত প্রবল হয়ে উঠছে, তখন তারা এই কঠোর মতাদর্শিক গোষ্ঠীর সঙ্গে সংলাপে বসার প্রয়োজনীয়তার প্রচার শুরু করে— আফগানিস্তানের মৃত্যুকূপ থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্য থেকে।
সেই সিদ্ধান্তেরই প্রাসঙ্গিক ফলস্বরূপ, ওয়াশিংটন "ভালো তালেবান"-এর সঙ্গে আলোচনায় সম্পৃক্ততার এবং "খারাপ তালেবান"-এর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার তত্ত্ব তুলে ধরে।
আমেরিকার সংশোধিত ব্যাখ্যা ছিল, আফগান সংকটের সমাধান হতে হবে "আফগানদের নেতৃত্বে" ও "আফগানদের অধীনে।" লন্ডন কনফারেন্সে ২০১০ সালে সেই "ভালো তালেবান"দের পাশে টানার জন্য ১৪ কোটি মার্কিন ডলারের একটি তহবিলও গঠন করা হয়।
কিন্তু, সে সময় ভারত ছিল অল্প কয়েকটি দেশের মধ্যে অন্যতম, যারা এই "ভালো বনাম খারাপ তালেবান" বয়ান প্রত্যাখ্যান করে দৃঢ়ভাবে বলে, তালেবান হলো আদতে একটি "সন্ত্রাসী সংগঠন।"
তবে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ঘূর্ণিপাকে দিল্লির এই নীতিগত অবস্থানের একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা দেয়। আফগানিস্তান বিষয়ক আন্তর্জাতিক গতিপ্রবাহ এবং উদ্যোগগুলোর যতোটা সম্ভব বাইরেই রাখা হয় ভারতকে।
তারও আগে, ১৯৯৮-৯৯ সালে কাঠমান্ডু থেকে কান্দাহারগামী ভারতীয় এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ (ফ্লাইট আইসি-৮১৪) ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। উড়োজাহাজে থাকা ২০০-র বেশি যাত্রীর জীবন বাঁচাতে ভারতকে তার জেল থেকে শীর্ষ কয়েকজন 'সন্ত্রাসীকে' মুক্তি দিতে হয়, এবং পুরো ঘটনাটিতে, বিশেষ করে তালেবান-পাকিস্তান আঁতাত, নয়াদিল্লির কৌশলকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল।
এখন ভারত যেন সেই অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে প্রস্তুত।
২০২১ সালে যখন তালেবান আশরাফ গনি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে কাবুল দখল করে, তখন ভারত বাধ্য হয় তার দূতাবাস বন্ধ করে দিতে। এর সঙ্গে তুলনায় জয়শঙ্কর-মুত্তাকির উষ্ণ করমর্দন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দৃশ্য। কারণ আশরাফ গনি এবং তার পূর্বসূরি হামিদ কারজাই উভয় সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ ও সহযোগিতামূলক, যা ছিল তালেবানের বিরুদ্ধে।
প্রশ্ন হচ্ছে—কীভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের আফগানিস্তান নীতি এভাবে বদলে গেল?
এই পরিবর্তনের আভাস আসলে অনেক আগেই পাওয়া গিয়েছিল। মুত্তাকি'র এই সফর দুই পক্ষের ধারাবাহিক যোগাযোগের ফল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি দুবাইয়ে মুতাকির সঙ্গে দেখা করেন। এরপর মুতাকি ও জয়শঙ্করের মধ্যে টেলিফোনে আলাপ হয়, এবং এপ্রিল মাসে ভারতের আফগান বিষয়ক বিশেষ দূত কাবুল সফর করেন রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে।
তবে জয়শঙ্করের ভাষায়, দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখোমুখি বৈঠক "বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ", কারণ এটি "দুই পক্ষকে অভিন্ন স্বার্থ চিহ্নিত করতে, মতবিনিময়ের সুযোগ দিতে এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা গড়ে তুলতে সহায়তা করে।"
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড়টি আসে যখন তালেবান সরকার ২২ এপ্রিল পাহালগামে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানায়—যা ভারতের জন্য ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।
তাই মুত্তাকির সফরের বাস্তব ফলাফল হলো—চার বছর পর কাবুলে ভারতীয় দূতাবাস পুনরায় চালু করার ঘোষণা এবং আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নয়াদিল্লিতে কূটনীতিক পাঠানোর প্রস্তুতির কথা। মুত্তাকি ও জয়শঙ্কর তাঁদের বৈঠকে যথাযথ কূটনৈতিক বক্তব্যও দেন।
আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাঁর দেশ কোনো গোষ্ঠীকে "অন্যের বিরুদ্ধে নিজের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে না"—যা সীমান্ত সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ভারতের উদ্বেগকে লক্ষ্য করে দেওয়া বক্তব্য হিসেবে দেখা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমেরিকান দখলদারিত্ব চলাকালীন সময়ে বহু উত্থান-পতনের মধ্যেও তালেবান কখনও "ভারতের বিরুদ্ধে কোনো বিবৃতি দেয়নি," বরং "ভারতকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু" বিবেচনা করে সবসময়ই সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করেছে।
জয়শঙ্করের মন্তব্যও আফগানদের সন্তুষ্ট করার মতো ছিল—তিনি বলেন, ভারত আফগানিস্তানের "সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও স্বাধীনতার প্রতি পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ।"
এখন প্রশ্ন—ভারত কী কৌশলগত সুফল আশা করছে মুত্তাকির এই সফর থেকে? শুধুমাত্র আফগানিস্তানে উন্নয়ন সহযোগিতার পুনরুদ্ধার নয়—কারজাই ও গনি সরকারের সময় দেশটির বিদ্যুৎ, সড়ক, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে ভারত পূর্বে যেভাবে তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল, তা পুনরায় সক্রিয় করার ইঙ্গিতও আছে।
কাবুলে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক উপস্থিতি ভারতকে পাকিস্তান ও চীনের মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলায় ভারসাম্য আনতে সাহায্য করবে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বর্তমান তিক্ত সম্পর্কের প্রেক্ষিতে ভারত কোনোভাবেই কৌশলগত শূন্যতা তৈরি হতে দিতে চাইবে না।
মুত্তাকির সফর তালেবান প্রশাসনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার প্রচেষ্টারও প্রতিফলন। এখনো ভারত তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি, তবে এই সফরটি ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সফেরর মতোই রাষ্ট্রীয় মর্যাদাসম্পন্ন।
নয়াদিল্লি এখনো অপেক্ষা করছে—তালেবান সরকার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রতি তাদের নীতি কতটা দৃঢ় ও বাস্তবসম্মতভাবে প্রয়োগ করে, এবং তা পর্যবেক্ষণ করেই তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
লেখক: পল্লব ভট্টাচার্য ভারতের একজন সাংবাদিক ও বিশ্লেষক।