মহাকাশের সবচেয়ে পুরোনো স্যাটেলাইটগুলোকে কি বাঁচানো উচিত?
একদিক থেকে দেখলে, 'ভ্যানগার্ড ১' হলো মহাকাশের আবর্জনার এক জলজ্যান্ত উদাহরণ: অ্যান্টেনা লাগানো একটি অ্যালুমিনিয়ামের বল, যাকে একসময় সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ অবজ্ঞার সাথে একটি জাম্বুরার সাথে তুলনা করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৮ সালের মার্চ মাসে এটি মহাকাশে পাঠিয়েছিল এবং স্যাটেলাইটটি ১৯৬৪ সালের মে মাস পর্যন্ত পৃথিবীতে রেডিও সংকেত পাঠিয়েছিল।
তারপর থেকে এটি নিষ্ক্রিয় হয়ে কক্ষপথে ভেসে বেড়াচ্ছে আর সেখানে মানবসৃষ্ট সবচেয়ে পুরোনো বস্তু হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।কিন্তু মহাকাশ ইতিহাসবিদ ম্যাট বিলের চোখে, সেই জাম্বুরাটি হলো মহাকাশ যুগের শুরুর দিকের "সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদগুলোর মধ্যে একটি", যা স্মিথসোনিয়ান জাদুঘরে স্থান পাওয়ার যোগ্য। তিনি বলেন, মহাকাশে দীর্ঘ সময় ধরে থাকার ফলে কোনো বস্তুর ওপর কী প্রভাব পড়ে, তা বিজ্ঞানীরা এই স্যাটেলাইটটি থেকে ভালোভাবে জানতে পারবেন।
বিল এবং তার মতো আরও কিছু প্রকৌশলী ও ইতিহাসবিদ সম্প্রতি একটি সম্মেলনে এই বিষয়টি তুলে ধরেছেন এবং 'ভ্যানগার্ড ১'-কে কক্ষপথ থেকে নামিয়ে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার জন্য একটি কাল্পনিক মিশনের বিস্তারিত পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন। তারা জোর দিয়ে বলেছেন, যদিও এই মিশনটি খুবই ব্যয়বহুল এবং চ্যালেঞ্জিং, তবে এটি অসম্ভব নয়—এবং এটি কোনো রোবোটিক্স কোম্পানি বা মহাকাশ সংস্থার জন্য তাদের 'কোনো কিছু আঁকড়ে ধরার' প্রযুক্তি প্রদর্শনের একটি দারুণ সুযোগ হতে পারে।
এই ধারণাটি অনেকের মধ্যেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে এটি মহাকাশ প্রত্নতত্ত্বের মতো ক্রমবর্ধমান ক্ষেত্রে 'ইন সিটু সংরক্ষণ' বা 'যেখানে আছে সেখানেই রেখে দেওয়া'র ধারণাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে। মহাকাশ প্রত্নতত্ত্ববিদ অ্যালিস গোরম্যান বলেন, পুরোনো স্যাটেলাইটগুলোকে "যেখানে আছে সেখানেই রেখে দেওয়া উচিত।"
তার মতে, কক্ষপথে সেগুলো আরও নিরাপদ, যেখানে সেগুলো কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশের সম্পত্তি নয় এবং ছবি বা অন্যান্য রিমোট সেন্সিং পদ্ধতির মাধ্যমে সেগুলো দূর থেকেই অধ্যয়ন করা যেতে পারে।
কিন্তু বিল পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেন, মহাকাশ ক্রমশই ভিড়ে ঠাসা হয়ে উঠছে—১৪,০০০-এরও বেশি স্যাটেলাইট পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে, আবর্জনার কথা তো বাদই দিলাম। তিনি এবং তার সহ-লেখকরা তাদের এই গবেষণাপত্রটিতে প্রশ্ন করেছেন: আমাদের কি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পুরনো স্যাটেলাইটগুলোকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবা উচিত? যদি ভাবা হয়, তাহলে কোনগুলো সেই বিবেচনার যোগ্য হতে পারে? তারা ১১টি স্যাটেলাইটের নাম প্রস্তাব করেছেন, যার প্রতিটিই কোনো দেশের মহাকাশ যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ বা কোনো মিশন ছিল এবং বিলের মতে, চেষ্টা করলে সেগুলো পুনরুদ্ধার করাও সম্ভব।
ভ্যানগার্ড ১ (Vanguard 1)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
এটি ১৯৫৮ সালের ১৭ মার্চ উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল এবং এটি পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে ঘুরছে। এটি ছিল কক্ষপথে থাকা দ্বিতীয় মার্কিন স্যাটেলাইট (প্রথমটি, এক্সপ্লোরার ১, ১৯৭০ সালে পৃথিবীতে ফেরার সময় পুড়ে গিয়েছিল)। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল এটি প্রমাণ করা যে, আমাদের পৃথিবী পুরোপুরি গোলাকার নয়, বরং বিষুবরেখার চারপাশে কিছুটা ফোলা।
লুনা ১ (Luna 1)
সোভিয়েত ইউনিয়ন
এটি ১৯৫৯ সালের ২ জানুয়ারি উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল এবং এটি সৌর কক্ষপথে রয়েছে। এটি ছিল পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে জয় করে মহাকাশে বেরিয়ে যাওয়া প্রথম যান। সোভিয়েতরা এটিকে চাঁদের দিকে পাঠিয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এটি প্রায় ৩,৭০০ মাইল দূর দিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এর পরিবর্তে, লুনা ১ সূর্যের চারপাশে কক্ষপথে স্থির হওয়া প্রথম মহাকাশযানে পরিণত হয়।
পাইওনিয়ার ৪ (Pioneer 4)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
এটি ১৯৫৯ সালের ৩ মার্চ উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল এবং এটিও সৌর কক্ষপথে রয়েছে। লুনা ১-এর মতো, পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে যাওয়া প্রথম আমেরিকান যানটিও তার মূল লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। এটি চাঁদের খুব কাছ দিয়ে না যাওয়ায় ছবি তুলতে ব্যর্থ হয়। তবে, এটি পৃথিবীর চারপাশের বিকিরণ বলয় সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পাঠিয়েছিল।
টিরোস ১ (Tiros 1)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
এটি ১৯৬০ সালের ১ এপ্রিল উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল এবং এটি পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে রয়েছে। আজকের দিনে আমরা আবহাওয়া স্যাটেলাইটগুলোকে অতি সাধারণ বলে ধরে নিই, কিন্তু নাসা যখন প্রথমবার এটি পাঠিয়েছিল, তখন এটি আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আদৌ কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল।
টেলস্টার (Telstar)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
এটি ১৯৬২ সালের ১০ জুলাই উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল এবং এটিও নিম্ন ভূ-কক্ষপথে ঘুরছে। এটি ছিল প্রথম সক্রিয় যোগাযোগ স্যাটেলাইট, যা আটলান্টিক মহাসাগরের এপার থেকে ওপারে বিক্ষিপ্তভাবে টিভি ছবি পাঠাত। মহাকাশ ইতিহাসবিদ বিলের ভাষায়, "আমরা দুর্ঘটনাক্রমে এটিকে একরকম মেরেই ফেলেছিলাম।" একটি উচ্চ-উচ্চতার পারমাণবিক পরীক্ষার বিকিরণ সাত মাস পর এটিকে চিরতরে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
আলোয়েট ১ (Alouette 1)
কানাডা
এটি ১৯৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল এবং এটি নিম্ন ভূ-কক্ষপথে রয়েছে। কানাডা এই কর্মঠ স্যাটেলাইটটির মাধ্যমে মহাকাশে তৃতীয় দেশ হিসেবে নিজেদের নাম লেখায়। এটি বায়ুমণ্ডলের আয়নোস্ফিয়ার স্তর (যে স্তর রেডিও তরঙ্গ প্রতিফলিত করে) সম্পর্কে প্রায় দুই মিলিয়ন ডেটা পাঠিয়েছিল এবং রেকর্ড-ব্রেকিং ১০ বছর ধরে চালু ছিল।
ভেলা ১এ ও বি (Vela 1A & B)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
এটি ১৯৬৩ সালের ১৭ অক্টোবর উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল এবং এটি উচ্চ ভূ-কক্ষপথে রয়েছে। এই দুটি স্যাটেলাইট পারমাণবিক বিস্ফোরণ শনাক্ত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল এবং সীমিত পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক সপ্তাহ পরেই এগুলো মহাকাশে পাঠানো হয়।
আর্লি বার্ড (Early Bird)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
এটি ১৯৬৫ সালের ৬ এপ্রিল উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল এবং এটি ভূ-স্থির কক্ষপথে রয়েছে। এটি ছিল একটি স্থির কক্ষপথে থাকা প্রথম বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্যাটেলাইট, যা নিরবচ্ছিন্ন সম্প্রচারের পথ খুলে দিয়েছিল।
অ্যাস্টেরিক্স (Astérix)
ফ্রান্স
এটি ১৯৬৫ সালের ২৬ নভেম্বর উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল এবং এটি নিম্ন ভূ-কক্ষপথে রয়েছে। এটি ছিল কক্ষপথে ফ্রান্সের প্রথম পদক্ষেপ এবং একটি কমিক-বুক চরিত্রের নামে নামকরণ করা প্রথম স্যাটেলাইট।
পাইওনিয়ার ৬ (Pioneer 6)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
এটি ১৯৬৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল এবং এটি সৌর কক্ষপথে রয়েছে। এটি ছিল সৌর বায়ু এবং আন্তঃগ্রহ চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের মতো বিষয়গুলো অধ্যয়ন করার প্রথম প্রোব, যা ৯০-এর দশক পর্যন্ত নাসাকে ডেটা পাঠিয়েছিল।
ভেগা (Vega)
সোভিয়েত ইউনিয়ন
এটি ১৯৮৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল এবং এটি সৌর কক্ষপথে রয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের সেই উত্তপ্ত সময়েও বিজ্ঞানীরা এই বিশাল স্যাটেলাইটটির মিশনে সহযোগিতা করেছিলেন, যা শুক্র গ্রহের পাশ দিয়ে এবং হ্যালির ধূমকেতুর গ্যাস মেঘের মধ্য দিয়ে এক ঐতিহাসিক যাত্রা সম্পন্ন করেছিল।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা