মহাকাশে বিশ্বের প্রথম সুপারকম্পিউটার গড়তে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করলো চীন

মহাকাশে স্যাটেলাইট-নির্ভর সুপারকম্পিউটার সিস্টেম স্থাপন করছে চীন। 'কম্পিউটিং কনস্টেলেশন' ধরনের এ কম্পিউটার প্রযুক্তি পৃথিবীতে ডেটা (তথ্য) পাঠিয়ে বিশ্লেষণ করার পরিবর্তে মহাকাশেই তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রথম ধাপের ১২টি স্যাটেলাইট সফলভাবে উৎক্ষেপণ করেছে দেশটি। প্রকল্পটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সুপারকম্পিউটারগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বুধবার দুপুরে লং মার্চ-২ডি রকেটের মাধ্যমে জিউকুয়ান স্যাটেলাইট লঞ্চ সেন্টার থেকে স্যাটেলাইটগুলো মহাকাশে পাঠানো হয়। প্রতিটি স্যাটেলাইটে রয়েছে বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কম্পিউটিং সিস্টেম এবং আন্তঃস্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থা। রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম গুআংমিং ডেইলির প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এই প্রকল্পের নাম থ্রি-বডি কম্পিউটিং কনস্টেলেশন, যা চীনের ঝেজিয়াং ল্যাবের তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হচ্ছে।
পুরো স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক (কম্পিউটিং কনস্টেলেশন) পুরোপুরি চালু হলে, এটি প্রতি সেকেন্ডে ১ হাজার পেটা বা ১ কুইন্টিলিয়ন (১০ লাখ ট্রিলিয়ন) গণনা বা কম্পিউটার অপারেশন করতে পারবে।
তুলনামূলকভাবে, ২০২৩ সালে বিশ্বের দ্রুততম সুপারকম্পিউটার যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির 'এল ক্যাপিটান' প্রতি সেকেন্ডে ১ দশমিক ৭২ কুইন্টিলিয়ন অপারেশন সম্পন্ন করতে পারে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও মহাকাশ ইতিহাসবিদ জনাথন ম্যাকডাওয়েল জানিয়েছেন, বর্তমানে মহাকাশে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের ধারণাটি অত্যন্ত আলোচিত। তার ভাষায়, 'মহাকাশে থাকা ডেটা সেন্টার সৌরশক্তি ব্যবহার করতে পারে এবং তাদের তাপ মহাকাশে বিকিরণ করতে পারে—ফলে বিদ্যুৎ খরচ ও কার্বন নিঃসরণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।'
তিনি বলেন, ভবিষ্যতে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ—সবকটি অঞ্চলই মহাকাশে এ ধরনের ডেটা সেন্টার স্থাপন করতে পারে। বুধবারের উৎক্ষেপণকে তিনি মহাকাশভিত্তিক নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থার প্রথম বড় পরীক্ষা বলে অভিহিত করেন।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (এইইএ) মতে, ২০২৬ সালের মধ্যে বৈশ্বিক ডেটা সেন্টারগুলো বছরে ১ হাজার টেরাওয়াট ঘন্টার বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারে—যা পুরো জাপানের বার্ষিক বিদ্যুৎ ব্যবহারের সমান। শুধু শীতলীকরণের (কুলিং) জন্য ২০২২ সালে গুগল ১৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন লিটার পানি ব্যবহার করেছে।
এভাবে বিদ্যুৎ ও পানির চাহিদা বাড়তে থাকায় স্থলভিত্তিক কম্পিউটিংয়ের সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রচলিত ব্যবস্থায় স্যাটেলাইটে সংগৃহীত তথ্য পৃথিবীতে পাঠিয়ে তা বিশ্লেষণ করতে হয়। তবে স্থলভিত্তিক স্টেশনের সীমিততা ও ব্যান্ডউইথ সংকটের কারণে কেবল ১০ শতাংশ তথ্যই বিশ্লেষণের জন্য পৃথিবীতে পাঠানো যায়, তাও দেরিতে।
গুআংমিং ডেইলির তথ্যানুযায়ী, সদ্য উৎক্ষেপিত প্রতিটি স্যাটেলাইট প্রতি সেকেন্ডে ৭৪৪ ট্রিলিয়ন অপারেশন সম্পন্ন করতে পারে। উচ্চগতির লেজার লিংকের মাধ্যমে স্যাটেলাইটগুলোর মধ্যে প্রতি সেকেন্ডে ১০০ গিগাবিট গতিতে তথ্য আদান-প্রদান সম্ভব। পুরো নেটওয়ার্ক একসঙ্গে ৫ পেটা অপারেশন পার সেকেন্ড এবং ৩০ টেরাবাইট অন-বোর্ড স্টোরেজ (নিজস্ব ডাটা স্টোরেজ) সুবিধা দিচ্ছে।
এছাড়া, প্রতিটি স্যাটেলাইটে রয়েছে ৮ বিলিয়ন প্যারামিটার বিশিষ্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক মডেল, যা স্যাটেলাইটেই সরাসরি তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারে। এসব স্যাটেলাইট ক্রস-অরবিট লেজার কমিউনিকেশন ও জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহৃত হবে।
এই পুরো প্রকল্পের কম্পিউটিং সিস্টেম ও মহাকাশভিত্তিক এআই মডেল তৈরি করেছে ঝেজিয়াং প্রদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ঝেজিয়াং ল্যাব। স্যাটেলাইটের ডিজাইন ও সংযোজন করেছে চেংডুভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গোসিং অ্যারোস্পেস। আর স্যাটেলাইটগুলোর মধ্যে হাই-স্পিড ডেটা আদান-প্রদানের জন্য লেজার টার্মিনাল তৈরি করেছে হাইস্টারলিংক নামের একটি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান।